আমাদের যাপিত জীবন

ফারহানা ইসলাম রুহী | শুক্রবার , ২৭ মে, ২০২২ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

ধোঁয়াশা আকাশ। সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা। হিম হিম শীতল বাতাস বইছে। জারুল গাছের ডাল দুলছে। পুরো বারান্দায় পাতা ফুলের পাঁপড়ি ঝরে পড়ে আছে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া! বাতাসের বেগ বেড়ে উঠেছে আরো! বেশ ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে।

এত দিন তীব্র তাপ দাহে নাভিশ্বাস জনজীবন। মিষ্টি বাতাস ভালই লাগছিল। বেশ বৃষ্টি পড়বে দেখেই মনে হচ্ছিল। মন চায় বারান্দায় গ্রিল ধরে বৃষ্টি উপভোগ করি ভাল হয় যদি সঙ্গী হয় এক কাপ গরম চা। দেখলাম সেই সাত সকালে রহিমা একটা ঝোলা নিয়ে বাড়িতে হাজির। কি রে রহিমা বুয়া! তুমি এত সাত সকালে? এত দূর থেকে! বয়সের ভারে ন্যুজ সে। আগের মত কাজ করতে পারে না। তবুও কাজ খুঁজে বেড়ায় অভাব তো ছাড়েনা!

আফা আপনার ছাওয়ালদের জণ্নী আমার গাছের কটা পাকা আম নিয়া আইলাম।

ও তাই বল। সব সময় সাহায্য চাইতে, হাত পাততে ওর খুব লজ্জা লাগে। তাই কিছু না কিছু নিয়ে আসে। আর কিছু না পারলে শাক, মেহেদীপাতা অথবা দুটো নারিকেল। আমি বুঝি ওর খুব টাকার দরকার। কিনে নিই । বাজারদর থেকে ২০/৩০ একটু বেশি দেই। সাথে গাড়ি ভাড়াও দেই। যদিও সে নিজ থেকে এনেছে। ওটা ওর পান সুপারির খরচ। ভাত না খেলেও ওর পান খাওয়া চাই -ই চাই। হাত পেতে খাওয়ার চেয়ে কিছু একটা করা ভাল এটাই ওর কাছে শিক্ষণীয়। অনেক সময় ছুটির দিনে এত ভোরে চলে আসে, খুব বিরক্ত হলেও পরে খুব মায়া লাগে। আহারে! পেটের জ্বালা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। সময় সব শিখিয়ে দেয়। বলল, আফা একটা কথা কইতাম-শরম করে যদি কিছু মনে না করেন কই! কি বল না? লজ্জা কিসের! একটু পুরান তেল দেবেন আমারে! মাঝে মাঝে পাক সাক করি। তেল কিনি কইত্তে । সমস্যা নেই যখন লাগে -নিয়ে যেও বুয়া। খুশি মনে টাকা পয়সা ওর যা দরকার দিয়ে বিদায় করলাম। এরপর রহিমা যেতে না যেতে তুমুল ঝড় শুরু হলো! বিদ্যুৎ চমকানি! প্রবল বজ্রপাত! তেমনি বাদল! বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিচ্ছিলাম। ভাবছিলাম রহিমা বাড়ি ফিরবে কী করে? ছাতাও আনেনি।

অনেক দূর হেঁটে টেম্পো ধরবে সে।
কিন্তু একটু ভারী বর্ষণে নিচু এলাকা জুড়ে পানি উঠে যায়। এদিকে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল
ছোট বুয়া আজ যদি না আসে! হায়!
তবে তো মরেছি! বৃষ্টি পড়লে পানি উঠে যায় ওর কলোনী সামনে! আসতে পারে না অনেক সময়। বৃষ্টি থামার কিছুক্ষণ পর সকিনা বুয়া বেল দিল। আমার মনে ঈদের খুশি।
বললাম, তুমি বাঁচালে আমাকে !
উফ খুব ক্ষুধা লাগছে আফা! কিছু দেন আগে খাইয়া লই। কি যে করি ! খেতে খেতে বলছিল।
কেন কী হয়েছে?

আফা বাড়ি ওয়ালা ভাড়া বাড়াই দিছে আয় তো বাড়ে না! এ্‌থলা টেহা কইত্থে দেই ! চাল ডালের দাম বাড়তি। চা ফরোটা কিন্না খাইতাম টাও ফারতামনা। ঘরে কিছু খাইনা। মাইয়াডারে কিছু দেই, মাইয়া বাপে দুগা ভাত খায়া কদ্দুর কামে যায়। হোগ্‌গলে কয় টিবি ফেফারে দিসে দুই বড়লোক দেশে নাকি যুদ্দু লাগাইছে। তেলের দাম বাইরা গেছে। টাটকা তেল কিনি কেমনে! ফুরান তেল কাউরে দিয়েন না গো বইন ! আমার লাই রাইখেন।
আমরা কিডা খাইতাম গো ! কেমনে চলতাম কন? আমাগো দুঃখ কেউ বোঝেনা রে গো! বড়লোকে বড়লোকে যুদ্ধ করে আমরা গরিবেরা মরে ! এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার।

ওর কথায় আমিও ভারাক্রান্ত! নিশ্চুপ! রাশিয়া উইক্রেন যুদ্ধে পুরো বিশ্বই মহা মন্দায় পড়তে যাচ্ছে এই ভেবে। তফাৎ এই খানে, গরীব মানুষ এই রহিমা, সকিনারা অভাবের তাড়নায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকলেও জানুক আর নাই জানুক পোড়ানো ভোজ্য তেল খুঁজে খায়। ভোক্তার আইন ও অধিকার থাকলেও সঠিক প্রয়োগের অভাবে, আমরা সাধারণ ভোক্তারা হরহামেশা বেশি দাম দিয়ে খাদ্য কিনলেও বিশুদ্ধ খাবারের বদলে আমাদের সেই পোড়ানো ভোজ্য তেল ও মবিলে ভাজা খাদ্য সামগ্রী কিনে খাই, জেনে অথবা না জেনে। এবং প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকি।

তেলের দাম যতই বৃদ্ধি পাবে, সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ততই দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। তাই পোড়ানো ভোজ্য তেল থেকে মুক্তি নেই রহিমাদের সেই সাথে আমাদেরও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅলসতা এক প্রকার ব্যাধি
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হক