আমাদের ভালোবাসা : বীরকন্যা প্রীতিলতা

ড. সেলিনা আখতার | বৃহস্পতিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্তির অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যুগের পর যুগ রক্তক্ষয় ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রিয় স্বাধীন সার্বভৈৗম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করতে গিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী যেসব বীর বিপ্লবী মুক্তি সংগ্রামী হাসিমুখে আত্বৌৎসর্গ করেছেন, দেশমাতৃকার সেই অমর সন্তানদের একজন চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা যার বীরত্বগাঁথা আমাদের ‘জোয়ান অব আর্কে’র কথা মনে করিয়ে দেয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বীর কন্যা বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশরিোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন দেন। ঔপনিবেশিককালে এ ভূখন্ডের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঙালির বহুমাত্রিক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাবটিতে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে নতুন বিপ্লবের সূচনা হয় সেটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভা দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির হেড কেরানি জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার নগরের আসকার দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে মাটির দোতলা বাড়ি করেছিলেন। সেখানেই কৈশোর কাটে তাঁর। সবাই তাকে রানী নামে ডাকত।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের এক মেয়ে। ছোটবেলায় ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে শুরু করে বাসন মাজার কাজে মাকে সাহায্য করতেন।তাঁর বেড়ে ওঠার মাঝে ছিল না কোনো আতিশয্য কিংবা আড়ম্বর। প্রখর মেধার অধিকারী হওয়ায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাবা জগদ্বন্ধু তার এই অন্তর্মুখী কন্যাকে ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন আরেক বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফল করে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রীতিলতা সব শিক্ষকের খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন, সেই শিক্ষকদের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি নিয়মিত প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈয়ের ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন এবং পরে লক্ষীবাঈয়ের ওপর লেখা বই পড়তেও দিয়েছিলেন; এটি পড়ে নিজের ভেতরে বয়ে গেল একটা বিপ্লবী চেতনার ঝড়।
স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসির কথা জানতে পারেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের নায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের সংগ্রামী জীবনের অনেক ঘটনা তার কিশোর মনে রেখাপাত করেছিল। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারত উপমহাদেশে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ সরকার ১ নম্বর বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামের এক জরুরী আইন পাস করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল, রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিনা বিচারে আটক রাখা। এই কালাকানুনের কারণে বিপ্লবীরা বাড়িতে বই রাখতেও ভয় পেতেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্য পূর্ণেন্দু দস্তিদার নিরাপদ ভেবে এসব নিষিদ্ধ বই এনে রাখতেন তাঁর বোন প্রীতিলতার কাছে। প্রীতিলতা কৌতূহল মেটাতে গিয়েই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলেন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’ নামের বইগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে আগুন ঝরানো বইটি ছিল ‘দেশের কথা’। অবাঙালি মারাঠি ব্রাহ্মণ সখারাম গনেশ দেউস্কর বাংলা ভাষা শিখে এই বই লেখেন। বহু সরকারি দলিল ঘেঁটে তিনি দেখিয়েছিলেন ইংরেজ শাসকেরা কীভাবে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ভারতকে লুণ্ঠন করছে।
১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় ইডেন কলেজে আইএ পড়তে যান প্রীতিলতা। দেশের কথার মতো নানা বই পড়ে ভেতরে তখন আগুন জ্বলছিল। তাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে যোগ দেন ‘দিপালী সংঘ’ নামের একটি সংগঠনে। লীলা নাগের (বিয়ের পর লীলা রায়) নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের আড়ালে স্বাধীনতার জন্য গোপন তৎপরতা চালাত। এ বিষয়ে পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন, ‘আইএ পড়ার জন্য ঢাকায় দুই বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।’ বোঝা যায়, সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছেটা ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছিল প্রীতিলতার মধ্যে। ১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনের সময় সে উদ্দেশ্য নিয়ে কল্পনা দত্তের সঙ্গে হাজিরও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেবার বিফল হয়ে ফিরে যেতে হয় তাঁদের। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এই আক্রমণগুলোতে প্রমীলা চক্রের আনা বোমাগুলোই ব্যবহৃত হয়েছিল। ইতিহাসে এটি ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবী দলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্র সমাজকে উদ্দীপ্ত করে।১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আইএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা।
১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধাতালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এই ফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়ার সুযোগ পান। প্রীতিলতা যখন কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ছেন, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কল্পনা দত্তসহ চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের আরো কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে গড়ে তুললেন ‘প্রমীলা চক্র’। এই ‘প্রমীলা চক্র’ নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করে বিপ্লবীদের পাঠাত। আচমকা একদিন বিপ্লবী দলের কাছ থেকে গোপন এক নির্দেশ আসে প্রমীলা চক্রের কাছে। কলকাতার গোপন কারখানায় তৈরি বোমার খোল নিয়ে আসতে হবে চট্টগ্রামে। যেমন আদেশ, তেমন কাজ। এরপর থেকে যখনই সুযোগ হতো, মেয়েরা বোমার খোল গোপনে চট্টগ্রামে নিয়ে আসত। পূজার ছুটিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বোমার খোল নিয়ে এসেছিল তারা। প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রক্ষিত; প্রত্যেকে চারটি করে মোট বিশটি।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস চট্টগ্রাম বিপ্লবীদলের সৈনিক। কলকাতার অলিপুর জেলে তখন ফাঁসির জন্য দিন গুনছিলেন সূর্য সেনের সহযোগী বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ টি জে ক্রেগকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালিয়ে তিনি ও কালীপদ চক্রবর্তী ভুলবশত চাঁদপুরের এসডিও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেছিলেন। এ ঘটনার পর গ্রেপ্তার হন দুজনই। কালীপদ চক্রবর্তীর নির্বাসন এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির সাজা হয়।
প্রীতিলতা অলিপুর জেলে গিয়ে বোন পরিচয় দিয়ে একেবারে অচেনা রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেন, রামকৃষ্ণ মৃত্যুর জন্য অসম্ভব প্রশান্তির সঙ্গেই অপেক্ষা করছেন। ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আগ পর্যন্ত ৪০ বার দেখা হয়েছিল তাঁদের। ফলে প্রীতিলতার মধ্যে এক নতুন বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী এই দেশপ্রেমিকের সাহচর্য প্রীতিলতার জীবনকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনার পর প্রীতিলতা যেন একটাই স্থির লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলছিলেন। আর সেই লক্ষ্যবিন্দুটা হলো দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ। ১৯৩২ সালে বেথুন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্ত’র পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। পরিবারের প্রয়োজনে অপর্ণাচরণ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদে চাকরিও নিলেন। মন থেকে তখন সমাজ-সংসার সবই লোপ পেয়েছে। রামকৃষ্ণের উজ্জ্বল মুখখানাই কেবল সত্যি মনে হতে লাগল তাঁর কাছে।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অনেক বিপ্লবী মারা গেছেন তত দিনে। অনেকে জেলে। আর আত্মগোপনে থাকা সূর্য সেনসহ কয়েকজনের মাথার দামও ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ সরকার। এমন কোণঠাসা অবস্থায়ও বিপ্লবীরা লড়াই জারি রেখেছিলেন। এই সময় আত্মগোপনে থাকা নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করে প্রীতিলতা তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষার কথা জানালেন। নির্মল সেন বুঝতে পারলেন টলানো যাবে না এই মেয়েকে। ১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড়-বৃষ্টির দিনে মাস্টারদার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে চট্টগ্রামের এক বাড়িতে নিয়ে আসেন। সাবিত্রী দেবী নামের এক নারীর ওই বাড়িতে মাস্টারদা ও নির্মল সেন ছাড়াও ছিলেন তরুণ বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা)। কিন্তু বিপ্লবী জীবনের শুরুতে কী অপেক্ষা করছে তা জানতেন না প্রীতিলতা।
বিপ্লবীদের অবস্থানের খবর জেনে ১৩ জুন সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে পুলিশ অভিযান চালায় ওই বাড়িতে। অভিযানে নির্মল সেনের গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মারা গেলেও পাল্টা গুলিতে তিনি নিজেও নিহত হন। মারা যান বিপ্লবী অপূর্ব সেনও। তবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন প্রীতিলতা ও সূর্য সেন।
এই ঘটনার পর ওই বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে একাধিক তল্লাশিতে প্রীতিলতার ছবি পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের বাড়িতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও হন তিনি। বুঝতে পারেন জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে তাঁকে। জুলাই মাসে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেন তিনি। নির্মল সেন ও অপূর্ব সেনের মৃত্যুর পর পাল্টা আঘাত হানার প্রয়োজন ছিল। আর সূর্য সেন সেটাই করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার পরিকল্পনা নিলেন। হামলার দায়িত্বভার তিনি দিতে চেয়েছিলেন কল্পনা দত্তকে। কিন্তু ঘটনার এক সপ্তাহ আগে কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হলে দায়িত্ব চাপে প্রীতিলতার কাঁধে।
হামলার দিন নিজ হাতে সূর্য সেন প্রীতিলতাকে সামরিক পোশাক পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় ৪০ জন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন রাত ১০টা নাগাদ। প্রীতিলতার পরনে ছিল খাকি শার্ট, ধুতি, মাথায় পাগড়ি ও কোমরে চামড়ার খোপে রিভলবার। অভিযানের শেষ দিকে হঠাৎ একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু সহযোদ্ধাদের সাথে আক্রমণ চালিয়ে যান। এরপর প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে দলের সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। কিন্তু আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন এবং যারা আহত হয়নি সেসব বিপ্লবীদের দ্রুত স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিপ্লবীরা সবাই স্থান ত্যাগ করেন। প্রীতিকে সায়ানাইড ক্যাপসুল দেবার জন্য সবসময়ই অনুশোচনা করেছেন সূর্যসেন। কল্পনাকে পরে তিনি বলেছিলেন, “প্রীতি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিল দেশবাসীর কাছে শুধু এটাই প্রমাণ করার জন্য যে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে এবং জীবন দিতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, বেঁচে ফিরে আসলেই বরং সে আরো বেশি কিছু করতে পারত।” পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামের একজন ইংরেজ নারী নিহত হন এবং চারজন পুরুষ ও সাতজন নারী আহত হন।
ওই দিন প্রীতিলতার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল তাঁর নিজের স্বাক্ষর করা প্রচারপত্র ও রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি। প্রচারপত্রের কয়েকটি লাইন ছিল এমন, “মেয়েরা যে এখনও পিছিয়ে আছে তার কারণ তাদের পেছনে রাখা হয়েছে। নারীরা এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যতই কঠিন ও বিপদসঙ্কুল হোক না কেন, ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমার বোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববেন না। এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্নদানে অগ্রসর হলাম।” আমার দেশের ভগিনীরা আর নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না।’ কেবল স্বাধীনতাকামী মানুষজন নয়, সব শ্রেণির নারীর কাছে প্রীতিলতা আজ এক উজ্জ্বল প্রেরণা।
বীরকন্যা প্রীতিলতা বইয়ে পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের একটি তরুণী নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করার জন্য যে “মরণ-স্বপন” দেখেছিল, তাঁর কর্মপন্থা যুগের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তার দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত, তার অটুট আদর্শনিষ্ঠা আজও প্রেরণা সঞ্চারী। ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, আরবভূমি ও বিশ্বের অনেক সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ শোষিত দেশে বহু মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদান করে নারীর সংগ্রামী মর্যাদা ও দক্ষতার নতুন ইতিহাস রচনা করেছে ও করছে। এরা প্রীতিলতার পতাকাবাহী।’ আজো যখন বাঙালি নারীর অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়া হয়, দেশপ্রেম, আদর্শ আর বিপ্লবের কথা লেখা হয় সবার আগে আসে প্রীতিলতার নাম। প্রীতিলতা এক ধূমকেতুর নাম। প্রীতিলতার দেশপ্রেম, আদর্শ, স্বাধীনতার জন্য অসীম ত্যাগ মানুষ স্মরণ করবে সব সময়। প্রীতিলতার মৃত্যুর দিনটি ছিল ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে মাত্র ২১ বছর ৪ মাস ১৯ দিন বয়সে নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছেন তিনি। আজকের এই দিনে বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধাভরে তাকে আমরা স্মরণ করছি।

লেখক : রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত ভিসি; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু টানেল : সমৃদ্ধির নতুন দুয়ার
পরবর্তী নিবন্ধকুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাকে কুপিয়ে হত্যা