আমাদের অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা

মোহছেনা ঝর্ণা | শনিবার , ১২ আগস্ট, ২০২৩ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম’ বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী জনপদ। নামের সাথেই লেগে আছে গ্রাম। সেই গ্রামের পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর প্রকৃতির অপার মায়ায় মানুষগুলোর ভেতরটাও যেন গড়ে উঠে কোমল হয়ে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় এই নরম মনের মানুষগুলোও যে পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা নিয়ে শত্রু মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে, মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় পুরে জীবন নিয়ে আগুন খেলা খেলার সাহস সঞ্চয় করতে পারে, তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। এই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী, পুরুষ নির্বিশেষে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল, হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে ব্রিটিশদের শোষণ থেকে আমাদের মুক্তির বীজ বপন করে দিয়েছিল।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীর নারীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সন্তান বীরকন্যা প্রীতিলতার কথা কম বেশি সবাই জানে। জানে প্রীতিলতার কাছের বন্ধু আরেক অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত (যোশী)’র কথাও। কিন্তু এর বাইরে আরও অনেক অগ্নিকন্যা ছিলেন সেই অগ্নিযুগে যাদের অনেকের নামই আমরা সেরকম বিস্তারিত জানি না। জানি না আমাদের মুক্তির আন্দোলনে তাঁদের সাহসিকতার গল্প। আমাদের সাহসী নারীদের সাহসী গল্পগুলো সব লিপিবদ্ধ হয়নি বলে তাঁরা অনেকেই রয়ে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে। সেকারণে অনেক অতৃপ্তি আমাদের। সেই অতৃপ্তি কিছুটা হলেও দূর করার জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা আলম আমাদের উপহার দিয়েছেন “ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী” নামক তথ্যবহুল ইতিহাসের অসাধারণ এক দলিল।

প্রাচীন বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, ইলিয়াস শাহের শাসনামল পেরিয়ে ১৪৯২ সালে হাবশী বংশের পতন ঘটিয়ে সুলতান হোসেন শাহ এর গৌড় রাজ্যে অধিকার পরবর্তীকালে সুবর্ণ যুগের সূচনা হয় বাংলার ইতিহাসে। চট্টগ্রামের আধিপত্য নিয়ে হোসেন শাহ এর সাথে বেশ সংঘর্ষ হয় ত্রিপুরার রাজা ধন্যমাণিক্যের। ১৫৩৮ থেকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামে আফগান শাসন চলে এবং ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের অধিকারে থাকে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে (১৬৫৮১৭০৭) ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোগল সম্রাটের শাসনাধীনে আসে। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ দ্দৌলার পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর ও ১৫ অক্টোবর তারিখে পূর্ববর্তী সন্ধির শর্তানুসারে নবাব মীর কাশিম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চট্টগ্রাম জেলা সমর্পণ করেন।

ইংরেজ সরকারের কাছে চট্টগ্রাম ছিল প্রাচ্যের রাণী। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার নারী সমাজকে রাজনীতিমুখী করে তোলে। এ সময় সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বদেশী আন্দোলন। বাংলায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের সূচনা হয় ১৯২০ সালের দিকে। ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে চট্টগ্রামের মানুষের গণ জোয়ার দেখে মহাত্মা গান্ধী চট্টগ্রামকে ‘তরুণ ভারত’ সাপ্তাহিকে বলেছিলেন, চট্টগ্রাম সবার আগে– ‘Chittagong to the fore.’

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাস্টারদা সূর্যসেন তাদের বিপ্লবী দলে নারী সদস্য নেননি। পরবর্তীতে মেয়েদের সীমাহীন আগ্রহে তাদের দলে নিলেও তাদের কাজ থাকে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র রাখা, নিষিদ্ধ বই পড়া, অর্থঅলংকার দিয়ে সাহায্য করা এসব। কিন্তু চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে নারীদের বিপ্লবী সংগঠনের সরাসরি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। মাস্টারদা ঘোষণা করলেন– “বাংলার বীর যুবকের আজ অভাব নেই। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে…. ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছিয়ে নেই।”

ব্রিটিশদের দিন ফুরাতে যে অগ্নিকন্যারা মশাল হাতে সম্মুখভাগে থেকেছেন তাদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। এই বইতে লেখক বেশ কয়েকজন বীর কন্যার লড়াইয়ের কথা, আত্মত্যাগের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। পরিচিত কয়েকটি নামের পাশাপাশি নতুন কিছু নাম পেলাম আমরা। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ এই অজানাকে জানার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার আলোচনা সভা
পরবর্তী নিবন্ধরোটারি ক্লাব অফ চিটাগং রিভার শাইনের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর ভিজিট