আবহমান বাংলার শীতকাল ও ঐতিহ্যের পিঠা

বাসুদেব খাস্তগীর | বুধবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শীত হচ্ছে পঞ্চম ঋতু। আবহমান বাংলার শীতকাল কিন্তু নানা ঐতিহ্যে ভরপুর। বাঙালির এমন কিছু ঐতিহ্য আছে যা পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনা মেলা ভার। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব ঐতিহ্য বাঙালিদের ঘরে ঘরে দেখা দেয় তার আপন ঐতিহ্য নিয়ে। ঋতু শেষ হবার সাথে সাথে সেসব ঐতিহ্য আবার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। শীতকালে গ্রামের কুয়াশা ঢাকা ভোরের দৃশ্য সবার স্মৃতিতে চির অমলিন। একটু রোদের জন্য বাড়ির উঠোনে বসে প্রতীক্ষার প্রহরে কার না দিন কেটেছে? সকাল কিংবা সন্ধ্যাবেলা খড় কিংবা নাড়ার আগুনে শরীরকে তরতাজা রাখার প্রয়াসও মনের কোণে উঁকি দেয়। গ্রামের রাস্তার দু’পাশে খেজুর গাছের সারি, আর সেসব খেজুর গাছে ঝুলতো রসের হাঁড়ি। শীতকাল আসলেই গাছের মালিকরা খেজুর গাছকে ছেঁটে কেটে রসের জন্য তৈরি করে নিতো। খেজুরের রস উপাদেয় এক খাদ্য। সকাল বেলা কলসীতে করে রস বিক্রি করতে আসতো রসওয়ালারা। আর খেজুরের রসে খাওয়া হতো বাহারি সব পিঠা। গ্রামের বউ ঝিয়েরা নানা রকম পিঠা তৈরি করতো। গ্রামের এসব স্মৃৃতির মধ্যে সব দৃশ্য খুব স্বাভাবিক দৃশ্যমান হলেও খেজুর গাছ আর গ্রামে গ্রামে সেই পিঠা তৈরির মহোৎসবটা আজ অনেকটাই ম্লান। কারণ প্রযুক্তির এ যুগে আমরা গ্রামীণ এসব ঐতিহ্যকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি। গ্রামের পথে ঘাটে একসময় যে অজস্র খেজুর গাছ চোখে পড়তো সে গাছ এখন তেমন চোখে পড়ে না। খেজুর গাছ যেন আজ গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাওয়া এক গাছের নাম। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ গাছের চাষাবাদ নিয়ে তেমন কেউ কাজ করেছেন বলে জানা নেই। অথচ এ গাছই হতে পারে অর্থনীতির একটি অন্যতম উপজীব্য একটি গাছে। অতীতে যে সব খেজুর গাছ পথে ঘাটে চোখে পড়তো সে সব গাছ তখনকার সময়ে অনেকটা চাষাবাদের মাধ্যমে জন্ম লাভ করেনি,রাস্তায় সে গাছের বীজ পড়ে উঠেছে, পরে মানুষ সেটাকে ব্যবহার করে রস সংগ্রহ করেছে। আবার কেউ কেউ যত্ন করে রোপণও করেছে। অথচ বাঙালির নানান বাহারি পিঠা কিন্তু শীতকালীন খেজুর রসকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে। এখন গ্রাম বাংলার পথে ঘাটে হাঁটলেই রাস্তায় সে রকম খেজুর গাছ আজকাল আর তেমনটি চোখে পড়ে না। এ গাছ যেন গ্রামবাংলা থেকে ক্রমশঃ হারিয়ে যাওয়া এক প্রজাতির গাছে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশকে বলা হয় পিঠার দেশ। এই পিঠা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। এটা বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির চিরায়ত একটি অংশ। পৌষের ঠাণ্ডা হাওয়া ছাড়া যেমন শীত অর্থহীন, ঠিক তেমনি শীতকালীন পিঠা ছাড়াও বাঙালির ঐতিহ্য চিন্তা যেন অবান্তর। খেজুরের রস আর পিঠা যেন সমার্থক। একটিকে ছাড়া অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। খেজুরের রসে তৈরি হয় খেজুরের মণ্ডাই মিঠা। আর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের পিঠা লক্ষ করা যায়। এই শীতকালকে অনেকেই পিঠার মৌসুম বলে। তার কারণ এ সময়ে খেজুরের রস পাওয়া যায়। আর এ সময়ে বাংলাদেশের গ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় বা প্রতিষ্ঠানে পিঠাভিত্তিক সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন মহাসমারোহে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে। এ ধরনের বিভিন্ন পিঠা উৎসব অনেক সময় মেলায় পরিণত হয় এবং সে উৎসবে গান-বাজনারও ব্যবস্থা থাকে। মানুষজনও সে আয়োজনে ছুটে যায় দেশের ঐতিহ্যের টানে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আজকাল ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে পিঠা উৎসবের আয়োজন করতে দেখা যায়। শীতকালে শহর অঞ্চলের মোড়ে মোড়েও বিভিন্ন ব্যক্তি ব্যবসায় করার মানসে পিঠা বিক্রি করে। নানা পেশা শ্রেণির মানুষকে এসব পিঠা খেতে দেখা যায়। গ্রাম থেকে ছুটে আসা মানুষরা সে পিঠা খেয়ে হয়তো গ্রামের সে ছেলেবেলার স্মৃতিকে একটুও হলেও মনে করার চেষ্টা করে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় কবি সুফিয়া কামাল তাই শীতকে তাঁর কবিতায় স্মরণ করেছেন এভাবে- ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। কুলের কাঁটার আঘাত সহিয়া, কাঁচা-পাকা কুল খেয়ে/ অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছি গাঁয়ের দুলালী মেয়ে।’ পিঠাকে বলা যায় বাঙালির আভিজাত্যপূর্ণ খাদ্য। চালের গুঁড়ো, আটা, ময়দা, অথবা অন্য কোনও শস্যজাত গুঁড়ো হচ্ছে পিঠা তৈরির উপাদান। দেশের নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের পিঠার প্রাধান্য দেখা যায়। অঞ্চলভেদে পিঠার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত নতুন ধান তোলার পর থেকেই ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি হয়। তবে যুগের বিবর্তনে সে ঐতিহ্য ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। পিঠা সাধারণত মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকলেও ঝাল, টক বা অন্য যে কোনও ধরনের স্বাদের পিঠা তৈরি হয়। পিঠা এখন গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে শহরে অনেক বড় বড় খাবারে দোকানে স্থান দখল করে নিচ্ছে। অনলাইনেও পিঠার বাণিজ্যিকীকরণ বেশ বিস্তৃতি লাভ করেছে এখন। কিন্তু খেজুরের রসের সাথে বাহারি পিঠার রস আস্বাদন বাঙালির চিরায়ত যে ঐতিহ্য তার আবেদন চিরকালীন। বাঙালির এ পিঠা স্বাদের সাথে নামেরও রয়েছে নানা বৈচিত্র। তেমন কিছু পিঠার নাম যেমন- ভাপা পিঠা, খেঁজুর রসে ভাপা পিঠা, শাহি ভাপা পিঠা, খোলা চিতুই, দুধ চিতুই, রস চিতুই বা রসের পিঠা, ডিম চিতই, সিদ্ধ কুলি পিঠা,ভাজা কুলি পিঠা, ঝাল কুলি, তিলের পুলি, ছানার পুলি,দুধপুলি, নারকেলের তিল পুলি, ক্ষীরে ভরা পাটি সাপটা, চিংড়িমাছের নোনতা পাটিসাপটা, গাজর কপি পাটিসাপটা, তেলেভাজা পিঠা অথবা পাকান পিঠা, সুন্দরী পাকান পিঠা, ছিটকা রুটি পিঠা, গোলাপফুল পিঠা, চুসি পিঠার পায়েস, মেরা পিঠা, বিবিখানা পিঠা, কলার পিঠা, ইলিশ পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, আনারস পিঠা, আমিত্তি পিঠা, ডিম বিস্কুট পিঠা, কাস্তুরি পিঠা, চাপাতি পিঠা, নকশি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বাদাম-নারকেল ঝালপিঠা, মুগ ডালের নকশি পিঠা, ফুলন দলা, তালের বড়া, তালের কেক, তালের পরোটা, তালের রোল কেক, তালের পায়েস, চিড়ার মোয়া পিঠা, মুড়ির মোয়া পিঠা, নারকেল নাড়ু পিঠা, নারকেলের নশকরা, তিলের নাড়ু, নারকেল ও চালের নাড়ু, খই এর মুড়কি, মুরালি, কলাই রুটি,ডিমের ঝাল পোয়া পিঠা,লাল পুয়া পিঠা, মালপোয়া, খেজুর রসে মালপোয়া, দই-মালপোয়া, রসবড়া, রসের ক্ষীর, কাউনের পায়েস, কাউনের পায়েসের পাটিসাপটা, নতুন গুড়ের ফিরনি, ফুল পিঠা, রাবড়ি, কাটা পিঠা, আমের ঝালপিঠা, ঝিনুক পিঠা, তালের রসবড়া, তালের পাটি সাপটা, তালের রুটি, চিড়ার বরফি, চিড়ার পোলাও, চিড়ার লাচ্ছি, রাজাদৌলা পিঠা, পানিদৌলা, পাতা পিঠা, চুঙ্গাপিঠাসহ আরো নানা বাহারি পিঠার নাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ সব বাহারি পিঠা বাঙালি রমণীরা শীতকালে ঘরে ঘরে তৈরি করে। অঞ্চলভেদে কোন কোন অঞ্চলে কোন কোন পিঠার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। কোন কোন পিঠা তৈরির খরচ তুলনামূলকভাবে কম, আবার কোন কোন পিঠার তৈরির খরচ অনেক বেশি। আবার কোথাও কোথাও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁয় ব্যয়বহুল পিঠা তৈরি হয়। তবে যে যাই বলুক না কেন পিঠা খেতে ভালোবাসেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবহমান বাংলায় বাঙালির বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান এবং অতিথি আপ্যায়নে পিঠা এখন একটি মর্যাদাবান খাবারের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের এতসব বাহারি পিঠার মধ্যে বেশ কিছু পিঠা আছে যেগুলো প্রায় সব অঞ্চলে জনপ্রিয় এবং এগুলো তৈরি করা সহজ ও তৈরি করার খরচও অনেক কম। তেমন কিছু পিঠার নাম যেমন পাকন পিঠা বা নকশি পিঠা, ভাঁপা পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, পোয়া পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, ডিম বিস্কুট পিঠা, ফুলঝুড়ি পিঠা, ছিটকা রুটি পিঠা, ঝাল পিঠা, পুলি পিঠা ইত্যাদি। শীতকাল আসলেই বাঙালিরা পিঠার গন্ধে মাতোয়ারা হয়। এই শীতকালীন পিঠা এখন ধীরে ধীরে সব ঋতুর খাদ্য উঠছে। রবি ঠাকুর বলেছেন,‘ শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ এই শীতের হাওয়া লাগার সাথে সাথে বাঙালিরাও মেতে ওঠে পিঠার রস আস্বাদনে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ; প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাছে লোকে কিছু বলে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে