আবদুল জলিল চৌধুরী ও তাঁর স্বপ্নের কলেজ

মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন | বৃহস্পতিবার , ২১ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দেশ বরেণ্য সাহিত্যিক সাংবাদিক প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনেক ত্যাগী ও বিপ্লবী নেতার জন্মস্থান, সাবেক মহকুমা পটিয়ার সবচাইতে পশ্চাদপদ ও অনগ্রসর অঞ্চল ছিলো পটিয়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম পটিয়া এলাকা বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলা। ১৯৯৭০ সাল পর্যন্ত পটিয়া কলেজ ও হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ ছাড়া এ অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার জন্য অন্যকোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না। যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাহীন দুরাবস্থার কারণে এ অঞ্চলের গরীব দুঃখী ছেলে মেয়েরা ঐ দুটি কলেজে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারতো না।

তাই এ অনগ্রসর এলাকার সাধারণ ঘরের গরীব দুঃখী ছেলে মেয়েদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার অভিপ্রায়ে ও এতদঞ্চলের দীর্ঘ দিনের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের প্রাক্তন সদস্য, দানবীর ও শিল্পপতি আবদুল জলিল চৌধুরী ১৯৭০ সালে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেন। জনাব আবদুল জলিল চৌধুরী ১৯০৮ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল সাত্তার চৌধুরী। ক্ষণজন্মা এ মনীষী ১৯৬২ সালের প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে এমপিএ নির্বাচিত হন। শিল্পপতি ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে তাঁর তৎকালীন ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালে বৃটেনের রাণী এলিজাবেথের আমন্ত্রণে তিনি ইংল্যান্ড সফর করেন।

কথিত আছে যে, রাণীর জন্মদিনের অতিথি হবার প্রধান শর্ত হিসেবে লন্ডনে বাড়ির মালিক হওয়া অপরিহার্য ছিল। আবদুল জলিল চৌধুরী সাহেবের একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা এতই প্রবল ছিলো যে, ইংরেজদের মাঝে বাঙালি জনসাধারণের ভাবমূর্তি উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য তিনি সহসা লন্ডনে একটি বাড়ির মালিক হন এবং রাণীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আতিথ্য গ্রহণ করেন। আবদুল জলিল চৌধুরী সাহেব সম্পদ, প্রাচুর্য ও শিল্পব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যতই কৃতিত্বের অবদান রাখছিলেন তাঁর জন্মস্থান শিকলবাহা গ্রামটি অবহেলা ও অন্ধকারে ততই ডুবতে থাকে।

এদিকে অবকাঠামো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে ১৯৭০ সালে ফিরিঙ্গি বাজার ও চরলক্ষ্যায় ভাসমান সেতু স্থাপনের মাধ্যমে। ঠিক তখনি আবদুল জলিল চৌধুরী সাহেব সন্দ্বীপ নিবাসী বাবু জ্ঞানদা রঞ্জন নাথকে অধ্যক্ষ নিয়োগ করে এ জে চৌধুরী কলেজ নির্মাণে এগিয়ে আসেন। চোখে তাঁর প্রবল স্বপ্ন; উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত এইসব মানুষগুলোকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। কলেজ ভবন নির্মাণের কাজ তরতর করে এগিয়ে যায়। পোড়ানো হয় ইট। শহর থেকে নির্মাণ শ্রমিক এসে নিয়োজিত হয় স্থাপনা কার্যে। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্বের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজ ১৯৭২ সালের ২২ এপ্রিল আবদুল জলিল চৌধুরীর মৃত্যুর কারণে আর চালু হয়নি। পরবর্তীতে মরহুম আবদুল জলিল চৌধুরী সাহেবের একমাত্র পুত্র আবদুল লতিফ চৌধুরীর অকাল মৃত্যুর কারণে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আবারো বাধাগ্রস্ত হলো। শ্বশুর আবদুল জলিল চৌধুরী সাহেব এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে এলেন তাঁরই একমাত্র পুত্রবধূ মরহুম আবদুল লতিফ চৌধুরীর সহধর্মিনী আলহাজ্ব নুরুন্নাহার বেগম চৌধুরী। তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ, দৃঢ় মনোবল ও নিরলস কর্মতৎপরতায় ১৯৮১ সালের শেষের দিকে এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি কলেজ স্থাপনের জন্য ৪১ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটির মধ্যে আবদুস সাত্তার মাস্টার, মোবারক আলী, এড. জি এম হারুন, লিয়াকত আলী চৌধুরী, হাফেজ মাহমুদ সৈয়দ, ডাক্তার হরিহর নাথ, আবদুর রহমান মাস্টার, গৌরচন্দ্র মহাজন, আহমদ হোসেন মাস্টার ও জনাব সোলায়মান চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা সকলে একসাথে জলিল টেক্সটাইল মিলস্‌ লি. এর অফিসে অনুষ্ঠিত এক সভায় মিলিত হয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর কলেজের নামকরণ করেন ‘পশ্চিম পটিয়া এ জে চৌধুরী কলেজ’।

জানা যায় সভায় কলেজের নামকরণের যথার্থতা তুলে ধরেন জনাব মোহাম্মদ সোলায়মান চৌধুরী। অবশেষে ১৯৮২ সালে বহু কাঙ্ক্ষিত ‘পশ্চিম পটিয়া এ জে চৌধুরী কলেজ’ টি কর্ণফুলী বিধৌত বীর প্রসবিনী চট্টলার দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার পশ্চিম পটিয়ার বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বর্তমানে কেএবি মহাসড়কের পার্শ্বে স্থাপিত হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন হাটহাজারী কলেজ ও হুলাইন ছালেহ নূর কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক বড়উঠান ইউনিয়নের অধিবাসী মোহাম্মদ সোলায়মান চৌধুরী। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আলহাজ্ব নুরুন্নাহার বেগম চৌধুরী ও তাঁর নাবালক ছেলে মেয়েদের পক্ষে এবং আবদুল জলিল চৌধুরী সাহেব এর তিন মেয়েসহ সর্বমোট ২.৮০ একর জায়গা ১৯৮২ ও ১৯৮৬ সালে দু’টি দলিলমূলে কলেজে দান করেন। পরবর্তীতে ডাক্তার হরিহর নাথ আরো ১৮ শতক জায়গা ১৯৮৬ সালে দলিলমূলে দান করেন। ১৯৮২ সালে এ জে চৌধুরী স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ঐকান্তিক আগ্রহ ও সহযোগিতায় স্কুলের দ্বিতীয় তলায় কলেজের কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে কলেজটি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

লেখক: অধ্যক্ষ, পশ্চিম পটিয়া এ জে চৌধুরী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাড়ির খবর
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল