আড্ডায় স্মৃতিতে সোনালি দিনে ফিরে যাওয়া

চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পুনর্মিলন ।। ‘চট্টগ্রাম কলেজের সাথে অধ্যাপক খালেদের সম্পর্ক সময়ের ফ্রেমে বাঁধা যাবে না’

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৪ মে, ২০২২ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

নগরীর টাইগারপাসের নেভি কনভেনশন সেন্টারের সম্মুখ অংশ ও আঙিনাজুড়ে বিশাল বিশাল ছবি। কোনোটায় প্রশাসনিক ভবন, কোনোটায় রেড বিল্ডিং। কোনো ছবিতে লেখা ‘বন্ধু, কেমন আছিস বল’। এসব ছবির সামনে জড়ো হয়ে ছবি তুলছেন অনেকে। কেউবা দল বেঁধে মেতেছেন আড্ডা-খুনসুটিতে।

এদের কারও বয়স ৩৫-৪০। কারও কারও ৫০-৭০। আছেন আশি-নব্বইয়ের ঊর্ধ্বেও। পেশায়ও রয়েছে ভিন্নতা। কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তা, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আবার সাংবাদিক। কি নেই, এখানে! বয়স আর পেশার ভিন্নতা ছাপিয়ে যেন তারা আবার ফিরেছেন একই ফ্রেমে, দুর্বার তারুণ্যে। এরা সবাই ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। নেভি কনভেনশন সেন্টারে কলেজটির প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পুনর্মিলনের সমাপনী ছিল গতকাল। তবে বিশাল বিশাল ছবির বদৌলতে সেখানেই (কনভেনশন সেন্টারেই) কলেজের পারিপার্শ্বিক আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়।

আর এসব ছবির সামনেই চলছিল ছবি তোলার হিড়িক। সেলফিতেও ব্যস্ত ছিলেন অনেকে। কলেজ জীবনের শিক্ষককে কাছে পেয়ে শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন পুরানো শিক্ষার্থীরা। আর সতীর্থদের জড়িয়েছেন আলিঙ্গনে। আড্ডায়, গানে ও স্মৃতিচারণায় ফিরে গেছেন যেন ফেলে আসা সোনালি দিনে। এভাবেই উৎসবের রঙে মাতোয়ারা একটি দিন কাটিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা। সকাল ৯টায় পুনর্মিলনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন কলেজের সবচেয়ে বয়স্ক সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক চিত্ত প্রসাদ তালুকদার (৯৮)। এসময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আহমদ কায়কাউস। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এসময় সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। জাতীয় সঙ্গীতের পর পুনর্মিলনী আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী আলী আহমদ ও সদস্য সচিব এস এম আবু তৈয়ব বক্তব্য দেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সমন্বয়ক একরামুল করিম। এরপর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা দেন চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবুল হাসান।

বক্তৃতায় তিনি বলেন, ১৮৬৯ সালে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম কলেজ দেশের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ। প্রতিষ্ঠানটি পথচলার ১৫৩ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির এই দীর্ঘ পথচলায় ৬ জন ব্রিটিশ অধ্যক্ষসহ অনেক জ্ঞানী-গুণী অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকবৃন্দ সম্পৃক্ত হয়েছেন জ্ঞান বিতরণের মহা কর্মযজ্ঞে। একই সাথে এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে অসংখ্য সফল ও দেশবরেণ্য শিক্ষার্থীদের। যাদের জ্ঞানে আলোকিত হয়েছে চারপাশ। তেমনি একজন ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। রাউজানে জন্ম নেয়া মোহাম্মদ খালেদ ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এখান থেকেই তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। যদিও চট্টগ্রাম কলেজের সাথে তার সম্পর্কটা সময়ের ফ্রেমে বাঁধা যাবে না।

দেশের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম কলেজের পুনর্মিলন যেন একই বৃন্তে তিনটি ফুল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীর সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।

বক্তব্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের শৈশব, শিক্ষা, চাকুরি, সংসার জীবনসহ সাংবাদিকতা ও রাজনীতি জীবন নিয়ে বিশদ আলোকপাত করেন স্মারক বক্তা অধ্যাপক মো. আবুল হাসান।

স্মারক বক্তৃতার পর শুরু হয় স্মৃতিচারণ পর্ব। স্মৃতিচারণায় অংশ নিয়ে নিজেদের সোনালি অতীত, কলেজ ক্যাম্পাসে ফেলে আসা দিন, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও সহপাঠীদের নানা বিষয়ে তুলে ধরেন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইসমাইল খান, সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম, এ কে খান গ্রুপের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন কাশেম খান, সাবেক মুখ্য সচিব ড. আবদুল করিম, সাবেক সচিব মো. নাসির উদ্দিন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহফুজা আখতার, লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, দৈনিক পূর্বকোণ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ডা. জসিম উদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকে।

স্মৃতিচারণায় এ কে খান ফাউন্ডেশনের নামে চট্টগ্রাম কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালুর ঘোষণা দেন সালাউদ্দিন কাশেম খান। স্মৃতিচারণায় অধ্যাপক চিত্ত প্রসাদ তালুকদার বলেন, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়েছি। আমাদের সময়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার বন্ধুদের কাউকে আজ আর দেখি না। ছাত্রদের অনেককেই আজ দেখলাম। খুব ভালো লাগছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মোহীত উল আলম, বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাসিনা জাকারিয়া বেলা, অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম, আইনজীবী আবুল হাশেম, ডা. শেখ শফিউল আজম প্রমুখ।

স্মৃতিচারণা শেষে মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর প্রায় ২২০০ প্রাক্তনী ফের মেতে উঠেন স্মৃতিমূলক অনুষ্ঠান, কৌতুক পরিবেশন, কুইজ প্রতিযোগিতা, কবিতা পাঠ ও গল্প বলা, কলেজ বন্ধুদের পরিবেশনায় গানের অনুষ্ঠানে। সন্ধ্যায় অতিথি শিল্পীদের সাথে গানে গলা মিলিয়ে সবাই যেন ফিরে যেতে চান ফেলে আসা দিনে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ এসেছেন বিদেশ থেকেও। সঙ্গে ছিল ছেলে-মেয়েরা। নিজেদের সোনালি অতীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই যেন নিয়ে এসেছিলেন সন্তানদের।

র‌্যাফেল ড্রতে দিনের আয়োজন শেষ হলেও এই শেষ যেন আরেক শুরুর বার্তা দিয়ে যায়। দিনভর আড্ডায় অনেক হারানো বন্ধুর খোঁজ মিলেছে। মনের কথা বলেছেন প্রিয় বন্ধুকে। নিয়েছেন ফোন নম্বর। আর ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও যুক্ত হয়েছেন পরস্পর। অনেকে নতুন এই সংযোগ যুক্ত হতে খুলেছেন ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। একদিনের মিলনমেলা শেষ হলেও এই যোগাযোগ রয়ে যাবে সারাজীবন। এবারের পুনর্মিলনী তাই শুধু এক দিনের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। এ যেন নতুন যাত্রার সূচনার শুভক্ষণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাউজানে কবর থেকে তোলা হলো ব্যবসায়ীর লাশ
পরবর্তী নিবন্ধআনন্দধারায় হঠাৎ বিষাদের ছায়া