বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম। যদিও মেগাসিটি বা একমাত্র নগর বলতে বোঝায় ঢাকা। সবকিছু রাজধানী কেন্দ্রিক বলে তারা মানতেই চায় না অন্য শহরগুলো কতোটা গুরুত্বপূর্ণ । বাণিজ্যিক রাজধানী নামে মাত্র। কর উন্নয়ন ব্যবসা বাণিজ্য আমদানী রপ্তানী সব বিষয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা চট্টগ্রাম সবসময় দাতার আসনে আসীন। এই শহরের সৌন্দর্য আর নান্দনিকতা প্রকৃতির মতো বিচিত্র। বিচিত্র আমাদর ভাষা ও। দুর্বোধ্য বলে পরিচিত এই ভাষা চট্টগ্রামের বাইরে তেমন কেউ বোঝেন না। অনেকে মনে করেন ভাষা সংস্কৃতিতে বিচিত্র একক ও অনন্য এই শহর তার নিজের বৃত্তেই নিজেকে ধরে রাখতে ভালোবাসে। কথাটা আংশিক সত্য হলেও দেশের মূলধারায় তার অবদান গৌরব উজ্জ্বল। এই গৌরবের পতাকা বহন করে এখানকার গান, বহন করে চট্টগ্রামের আঞলিক নামে পরিচিত শিল্প সাহিত্য আর একটি দৈনিক পত্রিকা। যার নাম আজাদী।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত দৈনিক আজাদীকে সময় সে ঊষালগ্নেই তার বিজয় তিলক পরিয়ে দিয়েছিল । জীবনের মতো সবকিছু ওঠা নামার ইতিহাস। আর সে গল্পের মতো ই এগিয়ে গেছে আজাদীর জীবনকাল। আমরা যখন কৈশোরে তখন আজাদীর আগামীদের আসর ছিলো এ শহরের শিশু কিশোরদের সাহিত্য বিকাশের একমাত্র আশ্রয়। সেখানেও ইতিহাসের ছোঁয়া আছে। আবুল কাশেম সন্দীপ নামের সে মানুষটি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি লগ্নে ঝলসে ওঠা চটৃগ্রাম রেডিওর কল্যানে এক কিংবদন্তি। তারপর আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম আমাদের চোখের সামনে শ্বেত শুভ্র পোশাকের শ্যামল বরণ এক মানুষ হয়ে উঠেছিলেন মহীরুহ। এই মানুষটিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় । ইনি পেশায় ছিলেন অধ্যাপক মরহুম আবদুল খালেক ইনজিনিয়ারের পত্রিকাটির হাল ধরেছিলেন অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে। যে স্বপ্ন শ্রদ্ধেয় আবদুল খালেক ইনজিনিয়ার দেখেছিলেন তাঁর সে স্বপ্নযাত্রার জাহাজের সুযোগ্য নাবিক আমাদের পরম প্রিয় আমার অগ্রজাধিক সৌম্য দর্শন মরহুম মোহাম্মদ খালেদ। যিনি সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তানের বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিকতাকারী শক্তির অন্যতম প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী। যাকে নির্বাচনে পরাজিত করা ছিলো স্বপ্নের মতো। সে দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তখনকার তরুণ অধ্যাপক পরবর্তীকালে বাকশালের গভর্নর বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন মোহাম্মদ খালেদ।
আমি তাঁর সাথে নিবিড় ভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পাই সদ্য প্রয়াত কবি সাংবাদিক সাহিত্য সম্পাদক অরুণ দাশগুপ্তের কল্যাণে। এই আরেকটি মানুষ যিনি তাঁর দরজা খুলে রাখতেন সবার জন্য। যদিও মুখে বলতেন তাঁর না আছে আবাহন বা বিসর্জন কাজে আজাদীর জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক শক্তিবলয়। যে সময়টায় আমি তাঁর ঘনিষ্ঠতা লাভ করি তখন আজাদীর সময় সুসময় ছিলো না। প্রতিযোগী আরেকটি দুটি দৈনিক তখন মাঠে। সত্যি বলতে কি ঝাঁ চকচকে আধুনিক মুদ্রণ আর তারুণ্যের বলে তারা অনেকটা এগিয়ে গেছিলেন। কিন্তু এই দৌড় যে হঠাৎ একশ মিটার দৌড়ে প্রথম হবার মতো কিছু না। সে কথাটা আমরা যৌবনে বুঝতে না পেরে আজাদীর সাথে থাকার জন্য মাঝে মধ্যে হতাশ হলেও অভিজ্ঞ জনেরা জানতেন এ দৌঢ় দীর্ঘ । একমাত্র সময় ই বলবে কে জেতে কে হারে। আমরা হারজিতের সাধারণ খেলার কথা বলছি না। তাতে বিশ্বাস ও করি না। কিন্তু survival of the fittest যদি সত্য না হবে তো আজাদী কেন যোজন যোজন এগিয়ে আজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী?
এইযাত্রা পথে অগুনিত মেধাবী মানুষের আগমন ঘটেছিল এই দৈনিকে। এর শক্তি যে কি সেটা আমরা প্রতিনিয়ত টের পেতাম। এখানে একটি খবরে এধার ওধার হলে বা ভুল কিছু হলে সারা চট্টগ্রাম কেঁপে উঠতো। আবার যখন কোন বিশ্বকাপ কিংবা তেমন কোন আর্ন্তজাতিক খেলাধুলা বা বিশেষ কিছু সামনে আসতো আজাদীকে ঘিরে মেতে উঠতো সমগ্র চট্টগ্রাম। মনে করবো যখন উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরান ইরাক লড়ছে বা ইরাক ও কুয়েতের ভেতর লড়াই চলছে তখন মানুষ মিছিল নিয়ে আসতো এই পত্রিকা অফিসের সামনে। উদ্দেশ্য ? আজাদী যেন তাদের হয়ে কথা বলে। তাদের কী বিশ্বাস! দূরের ছোট একটা দেশের ছোট একটা শহরের দৈনিক পত্রিকা অথচ তাঁরা মনে করছেন আর্জেন্টিনা ব্রাজিল এর জয় পরাঝব নির্ধারণ করবে আজাদী। সাদ্দাম হোসেন জিতবেন না হারবেন সেও যেন আজাদী বলে দেবে।
ততোদিনে তার সাথে যুক্ত হয়ে গেছে তরুণ তরুণীর দল। ডেস্ক জুড়ে প্রদীপ দেওয়ানজী – রাশেদ রউফ- দিবাকর ঘোষ এমন আরো অনেক নতুন মুখ। যারা চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্যর সরব। যাদের সাথে জড়িয়ে ছিল এ শহরের শিল্পচর্চা। এর কারণে আস্তে আস্তে আরো কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। একদিকে বিশ্বায়নের দুয়ার খুলছে নতুন নতুন জানালা উঁকি দিচ্ছে আরেকদিকে আধুনিকায়ানের ডাক। আজাদী তার গ্যাটাপে পুরনো থাকলেও বিষয় বৈচিত্র্য আর পরিবেশনায় হয়ে উঠছিল নতুনের দূত। এখন পেছনে তাকালে বিস্ময় লাগে ভালোভাবে বুঝতে না পারার পরো বেশ বড়সড় লেখা লিখেছিলাম বিশ্বায়নের প্রভাব নিয়ে। পরবর্তীকালে যার অনেকটাই সত্য হয়ে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে যে কথা বলি, আজাদী যেভাবে তারুণ্য ও তরুণ মেধাবী লেখকদের জায়গা দিয়েছে তা আর কেউ করতে পারে নি। এক সময় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ প্রয়াত হলেন। আজাদীর দায়িত্বে এলেন নেপথ্যচারী সজ্জন মিতভাষী মানুষ জনাব মোহাম্মদ আবদুল মালেক। এতোদিন তিনি ছায়ার মতো আগলে রাখলেও এবার ছায়াই হয়ে উঠলো চালিকা শক্তি। এই পরিবর্তনে আমূল পাল্টে গেলো আজাদী। আবদুল মালেক সাহেব বাইরে যতোটা গম্ভীর ভেতরে ততোটাই রসিক ও প্রাণবন্ত। এই মানুষটি সফল সমাজব্রতী ব্যবসায়ী এবং সংগঠক। তাই তিনি আধুনিক। আর আধুনিক বলেই জানেন পরিবর্তন হচ্ছে জীবনের মূল শক্তি। বদলে যাওবা আজাদীর সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ একদিকে যেমন শিল্প সাহিত্য পাতায় পরিবর্তন আনলেন, তেমনি বিশাল এক পরিবর্তন ঘটলো সম্পদাকীয় পাতায়। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য অবারিত উপসম্পাদকীয় বিভাগটি ঢাকার সাথে পাল্লা দেয়া এক বর্ণাঢ্য জগতে পা রাখলো। হল্যান্ড লন্ডন সিডনি থেকে শুরু করে মফস্বলের লেখকও লিখতে শুরু করলেন, আর পাতাটি হয়ে উঠলো সুখপাঠ্য বিষয় বৈচিত্র্যে মনোরম । তেমনি আরেক সংযোজন ফেসবুক বিভাগ। সামাজিক মিডিয়ার রমরমা সময়ে ফেসবুকের লেখাও যে পত্রিকায় ছাপা হয়ে আলোড়ন তুলতে পারে এবং লেখক তৈরী করতে পারে সেটাই দেখিয়ে দিলো আজাদী। আমি এ কথা হলপ করে বলতে পারি এই কাহিনী এই ইতিহাস একদিন মানুষের মুখে মুকে ফিরবে। আর এর ভেতর দিয়ে নারী শক্তি ও নবীন লেখকদের যে জয়জয়াকার তাও জমা থাকবে কালের গর্ভে।
পক্ষপাতহীন হয়ে বললে এ কথা বলতেই হবে দৈনিক আজাদী শাসন করে চট্টগ্রাম। মূল শহর থেকে কঙবাজার এ দিকে রাঙামাটি খাগড়াছড়ি কিংবা সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এক বিশাল জগত। এতো জনপ্রিয়তা এবং এতো সার্কুলেশান বহু জাতীয় দৈনিক নামে পরিচিত ঢাকার কাগজের ও নাই। ঢাকার দু একখানা কাগজ বাদ দিলে দেশের বৃহত্তম জনপ্রিয় আজাদীর বয়স বেড়েছে। আমার সমান বয়সী এই পত্রিকা এতোটাই আধুনিক আর তরুণ যে তার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ালে হাঁপিয়ে ওঠার বিকল্প থাকে না। শতবর্ষেও এমন দীপ্ত আর সমুজ্জ্বল থাকুক প্রিয় আজাদী।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট