স্কুল জীবনে পড়া হরলাল রায়ের ‘বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ বইয়ে ‘সংবাদপত্র’ বিষয়ক রচনাটির প্রারম্ভিক কথাটি ছিল এরকম-‘তিমির বিদারী সূর্যের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের দরজায় কড়াঘাত করে পৃথিবীর বাণীর বাহক সংবাদপত্র।’ রচনাটি বার বার পড়তাম। ভাবতাম আমাদের দরজায় কখন টোকা পড়বে! কখন পৃথিবীর বাণীর বাহক সংবাদপত্রে চোখ বুলাবো! কিন্তু আফসোস কোনো সংবাদপত্র আমাদের দরজায় কড়াঘাত করেনি। গ্রামে থাকতাম বলে সংবাদ পত্রের দেখা পেতাম না। একদিন শহর থেকে এক আত্মীয় বাড়িতে এলেন কাপড় চোপড় পত্রিকার কাগজে পেঁচিয়ে। রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে কাগজটি হাতে নিতেই চোখে পড়লো মোটা হরফে লেখা ‘দৈনিক আজাদী’ নামটি। শুধু প্রথম ও শেষ পাতা। অদ্ভুত এক শিহরণ নিয়ে দু’পাতার আজাদীটা বার কয়েক পড়লাম। প্রথম পাতার নিউজের শেষে যখন দেখি ৫ম পৃষ্ঠার ৪র্থ কিংবা ৫ম কলাম তখন সংবাদের শেষাংশ পড়ার জন্য মনে তৃষ্ণার্ত পাখির ছটফটানি। অবশেষে বাড়ির এক মুরব্বির সাথে খাতির করতে সক্ষম হই। প্রতি মাসে একটি আজাদী যোগাড় করে দিবেন। আমার অবস্থা তখন-‘হৃদয় আমার নাচেরে, আজিকে ময়ুরের মত নাচেরে’। সেই থেকে শুরু -আজাদী আমার প্রথম ভালোবাসা। আগামীদের আসরের লেখাগুলো অন্যরকম ভালো লাগতো। আসরের সভ্য হবার জন্য পত্রিকার নির্ধারিত অংশটি পূরণ করে পাঠিয়ে দিলাম। আমার সভ্য নম্বর ছিল ৭৯২৭। এস এস সির পর শহরে পাড়ি জমালাম। এবার আজাদী’র একেবারে কাছাকাছি। বোনের বাসায় সকালের আজাদী পড়ার জন্য ভাগিনা-ভাগনীদের সাথে সে কী প্রতিযোগিতা! নাস্তার টেবিলে বসে আমার কর্ণ থাকতো উৎকর্ণ। টুস্ শব্দ হতেই একদৌড়ে মেঝে থেকে আজাদীর দখল নিতাম। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হকার পত্রিকা ছুড়ে দিতেই একটা টুস্ শব্দ হতো, যা শুধু আমিই টের পেতাম। শেষ মেষ আমার প্রতিযোগিরাও এই শব্দ রহস্যের সাথে পরিচিত হয়ে গেলে পত্রিকার দখল নেয়াটা আরো কঠিন হয়ে গেলো। তারপরও রণে ভঙ্গ দেইনি। সেই থেকে আজ অবধি। এখনো ভোরের পাখির কিচিরমিচির শব্দের সাথেই আমার দরজায় কড়াঘাত করে পৃথিবীর বাণীর বাহক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদ পত্র-‘দৈনিক আজাদী’। অফিসের টেবিলেও কর্মের সাথী-আজাদী’র মান্থলি প্লেনার বুক- যেন সকাল-সন্ধ্যা আজাদী’র সাথেই মাখামাখি। গত সোমবার প্রিয় পত্রিকাটি ৬৩ বছরে পদার্পণ করেছে। যুগ যুগ ধরে আলো ছড়াক চট্টগ্রামের মানুষের মুখপত্র-দৈনিক আজাদী।