নাৎসি বাহিনির সর্বাধিনায়ক এডলফ হিটলারের বিশ্বস্থ ইনফরমেশন ও প্রেস সেক্রেটারি গোয়েবলস জীবিত আইজ্যাক আইনস্টাইনের মাথার মূল্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ঘোষণা করেছিলেন সেই সময়কার পাঁচ হাজার ডলার। কিন্তু মৃত আইনস্টাইনের মাথার দাম মাত্র প্রায় দশ ডলার। নিশ্চয়ই বিশ্বাস না হওয়ার কথা। কিন্তু একেবারে বানোয়াট কথা বলছি না। এই রহস্যভেদ করার আগে আইনস্টাইন সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করি! বিশ্বের বিস্ময় সীমাহীন মাপের এই প্রতিভার মূল্যায়ন খুবই দুরূহ কাজ। উপরিলিখিত মূল রহস্য জানানোর আগে আমি এখানে খুব সংক্ষেপে তাঁর জীবন ও কর্মের সামান্য পরিচিতি তুলে ধরা আবশ্যক বিবেচনা করেছি।
জার্মানির ওয়র্টেমবাগ (ডধৎঃঃবসনবৎম) শহরের রাজধানী ওমে (টষস) এক সচ্ছল ইহুদি পরিবারে ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ তাঁর জন্ম। বাবা হানম্যান আইনস্টাইন। বাবা ছিলেন সেলসম্যান ও ইঞ্জিনীয়ার। মায়ের নাম পওলিন আইনস্টাইন।
আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞান ও অঙ্কশাস্ত্রে স্নাতক হওয়ার পর দুই বছর শিক্ষকতার কাজে নিযুক্তির আশায় ছিলেন। কিন্তু তা তিনি না পেয়ে দুবছর বেকার জীবন কাটান। পরে পরিচিত লোকের সুপারিশে সুইস প্যাটেন্ট বা মেধাস্বত্ব নিরুপণের অফিসে সহকারি পরীক্ষকের পদে নিযুক্তি পান। অফিসে ও ঘরে বসেই তিনি লেখাপড়া করে যে অভিসন্দর্ভ পেশ করেন, তাঁর জন্য তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি ঈস্খদান করা হয়। তিনি ১৯০১ সালে ঈড়হপষঁংরড়হং ভৎড়স ঃযব ঈধঢ়রষষবৎু চযবহড়সবহড়হ শীর্ষক গবেষণাপত্র অহহধষবহ ফবৎ চযুংরশ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ১৯০৫ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি তাঁর অভিসন্দর্ভ (উরংংবৎঃধঃরড়হ) শেষ করেন। তাঁর আনুষ্ঠানিক পরামর্শদাতা ছিলেন এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর অ্যালফ্রেড ক্লেইনার। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
এর পর তিনি পর পর জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালটেক, প্রুশিয়ার একাডেমী অব সায়েন্সেস, কাইসার উইলহেম ইনস্টিটিউট, লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয় ও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিস-এ পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন।
তাঁকে সারাজীবন যাযাবরের মতো এদেশ সেদেশে নাগরিকত্ব নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। তিনি ১৮৯৬ সালে জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। অন্যথায় তাঁকে জার্মান সেনা বাহিনিতে যোগ দিতেই হত। বাস্তবে ১৮৭৯ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত জার্মানির নাগরিক ছিলেন। এর পর ১৮৯৬-১৯০১ সাল তাঁর কোনো রাষ্ট্র ছিল না। তিনি কোনো দেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারেননি। ১৯০১ সালে তিনি সুইস নাগরিকত্ব পান। জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত তিনি সুইস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। আমেরিকার নাগরিকত্ব নেন ১৯৪০ সালে। মাঝখানে ১৯১১-১৯১২ সালে অস্ট্রিয়া এবং ১৯১৪-১৯৩৩ পর্যন্ত আবার জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জার্মানির পদার্থবিজ্ঞান সমিতির সভাপতির পদেও অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
আইনস্টাইনের বিখ্যাত গবেষণা কর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ (এবহবৎধষ জবষধঃরারঃু ধহফ ঝঢ়বপরধষ জবষধঃরারঃু), ফঠোইলেক্ট্রিক এফেক্ট (চযড়ঃড়বষবপঃৎরপ ঊভভবপঃ), ভর-শক্তি সাম্য (গধংং-ঊহবৎমু ঊয়ঁরাধষবহপব, ঊ=সপ২), ব্রাউনিয়ান গতি তত্ত্ব (ঞযবড়ৎু ড়ভ ইৎড়হিরধহ গড়ঃরড়হ), বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন (ইড়ংব-ঊরহংঃবরহ ঝঃধঃরংঃরপং), বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট (ইড়ংব-ঊরহংঃবরহ ঈড়হফবহংধঃব), বোস-আইনস্টাইন কোরিলেশনস (ইড়ংব-ঊরহংঃবরহ ঈড়ৎৎবষধঃরড়হং), একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব (টহরভরবফ ঋরবষফ ঞযবড়ৎু) ও ইআরপি প্যারাডক্স (ঊজচ চধৎধফড়ী) ইত্যাদি। এ ছাড়া তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণাপত্রের সংখ্যা তিনশ’র অধিক। বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে রচিত লেখার সংখ্যা দেড়শ’র বেশি।
আইনস্টাইন ১৯২১ সালে তাঁর ফঠোইলেক্ট্রিক এফেক্ট গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯২৬ সালে লাভ করেন মেটেসি পদক (গবঃঃবপর গবফধষ)। ম্যাক্স-প্ল্যাঙ্ক পদকে (গধী-চষধহপ গবফধষ) বৃত হন ১৯২৯ সালে। টাইম ম্যাগাজিন তাঁদের নিজস্ব জরিপের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালে তাঁকে বিশ শতকের শ্রেষ্ট মানব ঘোষণা করে ।
১৯৪৮ সালে তাঁর উদরের অভ্যন্তরে একটি শিরা ছিঁড়ে গেলে ডাঃ রুডলফ জোর করে তাঁর অপারেশন করেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁর উদরের ভিতরে একই সমস্যা আবার দেখা দিলে তাঁকে আমেরিকার প্রিন্সটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই সময় তিনি হাসপাতালে বসে ইসরাইলের সপ্তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকিতে প্রদেয় বেতার ভাষণ রচনা করছিলেন। কিন্তু তিনি এই লেখা শেষ করে যেতে পারেননি। বিজ্ঞানী পুনর্বার অপারেশনে গররাজী হন, এবং বলেন,
‘আমি যখন চাইবো চলে যাব। কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকায় আনন্দ নেই। আমি আমার অংশের কাজ শেষ করেছি। এখন যাওয়ার সময়। আমি সুচারুভাবে তা সম্পন্ন করবো।’
পরদিন সকালে ৭৬ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে তাঁর দেহাবশেষ আজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়, যার হদিশ আজও মেলেনি। তাঁর মৃত্যুর সাড়ে সাত ঘন্টার মধ্যে প্রিন্সটন হাসপাতালের প্যাথোলজিস্ট থমাস স্কোলজ হার্ভে বিজ্ঞানীর করোটির ভিতর থেকে ব্রেন বের করে নিয়ে সংরক্ষণ করেন। তাঁর ব্রেন রয়েছে পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে।
আইনস্টাইনের মাথার দাম নিয়ে আলোচনার শুরু করেছিলাম। তাঁর মাথার দাম কেবল ১০ ডলার। বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আসলে তা সত্যি। আপনার হাতে যদি থাকে আইপ্যাড আর পকেটে হাজারখানেক টাকা তা হলে সহজে নোবেলজয়ীর প্রতিভার বুদ্ধির আসল রহস্য ধরতে পারবেন। যে বুদ্ধি দিয়ে তিনি ঊ=সপ২ বা ভর-শক্তি সাম্য আবিষ্কার করেছিলেন।
প্যাথোলজিস্ট থমাস স্কোলজ হার্ভে বিশ শতকের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তির ব্রেন নিপুণ দক্ষতায় সংরক্ষণ করেছিলেন। তিনি ব্রেন ওজন করে ব্রেনের বিভিন্ন অংশ পাতলা টুকরো করে কেটে সংরক্ষণ করেন। কয়েকটি টুকরো নিজের কাছে রেখে, অবশিষ্ট টুকরোগুলো সতীর্থদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তবে ব্রেনের প্রতিটি স্তরের ‘গোপন’ বিষয়-আশয় উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরায় বন্দি করে রাখেন।
গোপনই বটে। প্রতিভা চাপা না থাকলেও বিজ্ঞানীর ব্রেনের গঠন প্রকৃতি তো এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। হার্ভে জানিয়েছিলেন ঝাঁকড়া চুলো অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শনকারী লোকটির ব্রেনে প্যারাইটেল অপারকুলামই ছিল না। পরে আরো জানা যায়, মগজের ফ্র্যন্টাল লোবে যেখানে প্যারাইটেল অপারকুলাম থাকার কথা সে জায়গাটা পুরো ফাঁকা। ল্যাটারাল সালসসের (যা ফ্রন্টাল লোব ও প্যারাইটাল লোবকে টেম্পোরাল লোব থেকে আলাদা করে) বেশ খানিকটা অংশ অনুপস্থিত। বরং সেখানে রয়েছে স্নায়ুকোষের ঘন জাল। বিজ্ঞানীদের মতে, এই কারণেই সম্ভবত সাধারণ মানুষের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ঐ অংশে স্নায়ু অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। শোনা যায় আইনস্টাইন নিজেও নাকি বলতেন তাঁর প্রত্যেক চিন্তা চোখের সামনে ভেসে উঠত। তাঁর পরিশীলিত মননে সংখ্যার পরিবর্তে জটিল অঙ্কের চিত্র ভেসে উঠত। হার্ভে ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণাপত্র ১৯৯৯ সালে ‘ল্যানসেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গবেষণাপত্রে উলেখ করা হয়েছিলো আইনস্টানের প্যারাইটেল লোব গড়পরতা মানুষের তুলনায় শতকরা পনের ভাগ বেশি চওড়া। বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত বিশ্বাস, এটি করোটির এমন একটি অংশ যা সংখ্যার খেলা থেকে শুরু করে ভাষাতত্ত্ব বা আশপাশের যে কোন কিছুর গতি-প্রকৃতি-ভারসাম্য সামলানোর কাজ করে। আইনস্টাইনের বিশেষ ক্ষমতার সূত্র এটাই।
হার্ভে সহ সকল বিজ্ঞানীর আইনস্টাইনের ব্রেন নিয়ে এই কর্মযজ্ঞ পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই। আইনস্টাইনের মাথার দাম আসলে কোথায় তা ভালো করে জানা। মস্তিষ্কের কোন কুঠুরিতে তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ও প্রতিভা লুকানো ছিল। হার্ভে যা বলেছিলেন বিজ্ঞানীরা সে বিষয়ে এখনো একমত। তাই নূতন আইপ্যাড ‘অ্যাপস’ নিয়ে বিজ্ঞানীরা উচ্ছ্বসিত।
‘শিকাগোর ন্যাশন্যাল মিউজিয়াম অব হেলথ এন্ড মেডিসিন’-এর বিজ্ঞানীরা সব ঝুটঝামেলা সামলাচ্ছেন। আইপ্যাডে মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্তরের সাড়ে তিনশ স্লাইডের প্রযুক্তি কারিগরিতে নিবেদিত রয়েছেন মিউজিয়ামেরই বিশেষজ্ঞ স্টিভ ল্যান্ডার্স। বেশ কিছু বাধার মুখেও পড়তে হয়েছে স্টিভকে। হার্ভে ব্রেনের বিভিন্ন অংশের ছবি যখন ধারণ করেছিলেন তখন বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না। যে কারণে ২০১২ সালে কোন ছবি ব্রেনের ঠিক কোন অংশের বিজ্ঞানীরা তা বলতে পারছেন না। সকল ছবি মিলিয়ে ব্রেনের মানচিত্র আঁকাও সম্ভব হচ্ছে না।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে বিতর্ক বেঁধেছে ব্রেনের মূল্য নিয়ে। এত সস্তা আইনস্টাইনের মগজের দাম? এই সবে কান দিতে রাজি নয় ‘ন্যাশন্যাল মিউজিয়াম অব হেলথ এন্ড মেডিসিন’। তাঁদের কথায়, ‘আমরা জানি তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে, আইনস্টাইনও এটা পছন্দ করতেন না। তবে কিনা ব্রেনের রহস্য উদ্ঘাটন করা বিজ্ঞান আর গবেষণার জন্য কতটা দরকারি, তা তিনি বুঝতেন।
‘আশা করি তাঁকে যথার্থ সম্মান দিয়েই আমরা সেটা করতে পারব’।
লেখক : বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞান লেখক, শিক্ষাবিদ