অযত্নে, অবহেলায় রূপ ও যৌবন হারাতে বসেছে আসকারদিঘি

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি মোগলেরা আরাকানদের পরাজিত করে চাটিগাঁ দুর্গ দখল করেন। মোগলদের অনেক ফৌজদার ছিল। মোগলদের দ্বিতীয় ফৌজদার হলেন আস্কর খাঁ। আস্কর খাঁর আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ বেগ। আর পূর্ণ নাম ছিল নবাব আস্কর খাঁ বজমে সানি। ১৬৬৯১৬৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর তিনি চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। মোগল শাসনামলে এই দুর্গে ১০ হাজার সৈন্য বা ফৌজ থাকত। ফৌজদের জন্য পানি সরবরাহের সুবিধার্থে নবাব আস্কর খাঁ এই দিঘি খনন করান। এই ‘দিঘি’ নিয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।

প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের ইতিহাস আসকার দিঘির। রহমতগঞ্জ মৌজার জামাল খান এলাকায় আসকার দিঘির অবস্থান। এই দিঘির নামেই এলাকাটি পরিচিত। প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা গেছে, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ছিল জিনপরিঅধ্যুষিত দেশ।

পীর বদর শাহ এসে অলৌকিক চাটির (মাটির প্রদীপ) আলোর তেজের সাহায্যে জিনপরি তাড়ান। সেই থেকে এই জনপদের নাম হয় চাটিগাঁ।

আসকার দি’র পুক পারদ্দি আঁর ছোড ঘর/মরিচ হলুদ মমসলা বাডি হোটেলত।’ খ্যাতিমান গীতিকার ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখা এই গান গেয়েছিলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ। আসকার দিঘি নিয়ে শুধু গান নয়, আছে অনেক কিংবদন্তি।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘আসকারদিঘি’ও ভরাটের নীল নকশা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে একে দূষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ এ দিঘি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক সময় আসকারদিঘির পানি ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাণস্বরূপ। আরও বিভিন্নভাবে এই দিঘি সেবা দিয়েছে স্থানীয় জনগণকে। আসকার দিঘির তাজা মাছ বাজারের প্রধান আকর্ষণ ছিল। এখানে বড়শী প্রতিযোগিতা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচ প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হতো। হিন্দু সমপ্রদায়ের দুর্গা পূজায় প্রতীমা বিসর্জনের দৃশ্য দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড় হতো।

সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে, অযত্নে, অবহেলায় আসকারদিঘি তার রূপ, যৌবন সব কিছু হারাতে বসেছে। নানাভাবে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করা হচ্ছে এর অবয়ব। দিঘিটি প্রায় সাড়ে তিনশ/চারশ বছর আগে খনন করা হয় মর্মে অধিবাসীদের থেকে জানা যায়। আইয়ুব আমলে ১৯৬০এর দিকে এটার চতুর্পাশে শিশু পার্ক করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আসকারদিঘির পাড়ে বাড়িঘর, দোকান নির্মাণ নিষিদ্ধ ছিল। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাতে অনুমোদনও দিতেন না। পরবর্তীতে এ পরিকল্পনা নানা কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। আসকারদিঘির পাড়গুলো ছিল উন্মুক্ত। বিকেলে পরিচ্ছন্ন বাতাস খেতে ও মাছের খেলা দেখতে বহু মানুষের ভিড় জমতো। এগুলো বেশিদিন আগের কথা নয়। দেশ স্বাধীনের অনেক পরেও এ দৃশ্য দেখেছেন অনেকে।

ইতিহাস আরও বিস্তৃত করলে দেখা যায়, আসকার বা আস্কর খাঁন নামের কোনো মহৎ প্রাণ মানুষ দিঘিটি খনন করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তার নাম ছিল আব্দুল্লাহ বেগ। সম্রাট শাহজাহান তাকে আস্কর খাঁন উপাধি দেন। তিনি চট্টগ্রামের ফৌজদার ছিলেন। তাকে স্থানীয় জনগণ নবাব নামে পরিচয় দিতেন। তিনি সম্রাট শাহজাহানের সময়ে মোগল সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেন এবং শাহজাদা দারাশিকোর বখশী ছিলেন মর্মে জানা যায়। উত্তরাধিকারের যুদ্ধে দারাশিকোর ভাগ্য বির্পযয় হলে আস্কর খান আওরঙ্গজেবের পক্ষে যোগ দেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে মীর জুমলার অধীনে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। মোগল আমলে বুজুর্গ উমেদ খানের পরে ফৌজদার নিযুক্ত হন আস্কর খান। তিনি ১৬৬৮১৬৭১ খৃঃ পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর ফৌজদার ছিলেন। আস্কর খানের প্রথম কীর্তি আসকার দিঘি এবং দ্বিতীয় কীর্তি আসকারাবাদ মহল্লা। উক্ত দিঘির বয়স ৩৩৫৩৩৬ বছর হবে। এই ঐতিহাসিক দিঘিটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত কারণে সংস্কার জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশবাদী ও ইতিহাসপ্রেমীদের এ ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ইট পাথরের গাঁথুনির মাঝে সকলের বিবেকবোধ যেন চাপা পড়েছে। অবশেষে হয়তো এ ঐতিহ্যবাহী দিঘিটির বুকে অচিরেই গড়ে উঠবে সুরম্য দালানকোঠা। হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী ঐতিহাসিক দিঘিটি।

উন্নত বিশ্বে যেখানে ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্বকে সংরক্ষণ, সংস্কার করে বিশ্ববাসীর সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হচ্ছে ঠিক সে মুহূর্তে আমরা যেন ধ্বংস সুখের উল্লাসে মেতে উঠেছি। যে জাতি নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট নয় তাদের নিজ স্বত্তা ও অস্তিত্ব ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হতে বাধ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ঐতিহ্যের স্মারকসমূহ ধ্বংস হতে দেবো না, এ প্রত্যয় নিয়ে আসুন সংঘবদ্ধ হই। মর্যাদাবান জাতি হিসেবে একটি সুন্দর উত্তরাধিকার রেখে যেতে চাই। যা এখনও সম্ভব। সুপেয় পানির তীব্র সংকট অনুধাবন করা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক জলাধার, নদীনালা, খালবিল, কূপ, পুকুর, দিঘি ভরাট করা হচ্ছে পাইকারীভাবে। আইন ও নীতিমালা আছে কিন্তু এসবের যথাযথ প্রয়োগ দেখতে পাইনি। কার্যকর জাতীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমেই দেশের পরিবেশ, প্রাণীসম্পদ ও জনগণের অধিকারের সার্বিক নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপার সম্ভাবনা, তবু পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে চট্টগ্রাম
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু টানেল : খুলে যাচ্ছে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগের স্বর্ণদুয়ার