অভিবাদনেষু

সেলিনা শেলী | শুক্রবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ

অভিবাদনেষু, প্রিয়কবি

কবিতায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ পেলেন আসাদ মান্নান। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যে বিপুল ঋদ্ধ ধারায় কাব্যচর্চা শুরু হয়েছিলো, চট্টগ্রাম সেখানে ছিলো অগ্রণী, আর কবি আসাদ মান্নান সেই কাতারের কাণ্ডারি। আপাদমস্তক কবি বলতে যা বোঝায় তিনি তাই।

আমার বয়স যখন ১৬, সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছিএরই ভেতর আজাদীর সাথীসদস্য হয়ে আর লিটল ম্যাগাজিনে লিখছি, তখন চট্টগ্রামের এক ঝাঁক তরুণ কবির সাথে ধীরেধীরে আমার পরিচয় ঘটছিলো। আসাদ মান্নান তাঁদের অন্যতম। আমি সেই আশির দশকের কনিষ্ঠ কাব্যকর্মী। আসাদভাই চট্টগ্রাম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন। এরই মধ্যে ৭৫ সালে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয়। রাগেক্ষোভে কবি আসাদ মান্নান মুষড়ে পড়েন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ড্রপ করেন। লিখে ফেলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কবিতা ‘সহসা আগুন জ্বলে যমুনার জলে’ (১৯৭৫)। যা সেই ভয়ংকর সময়ে কল্পনাও করা যায় না। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরেকটি কবিতা লিখে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেরা কবিতার পুরস্কার পান। শিরোনাম ‘দ্বিতীয় কবিতা প্রথম এলিজি’। সেসময় কবি মিনার মনসুর ও দিলওয়ার সম্পাদিত বিখ্যাত ‘এপিটাফ’ লিটলম্যাগে ১৯৭৮ সালে তাঁর এই কবিতাটি ছাপা হয়। কবি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষে। কবিতা লিখি। সময়টা এমন যে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব সহজ ছিল না। তবু তখন আমরা কবি এজাজ ইউসুফী, মহীবুল আজিজ, আবু মুসা চৌধুরী, শাহিদ আনোয়ার, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, হাফিজ রশিদ খান, আহমেদ রায়হান, লুলুল বাহার, তুতুল বাহার, সুমন ইসলাম, ইমদাদুল হক, ইউসুফ মুহম্মদ, .. বখতিয়ার, জিললুর রহমান এরকম বেশ ক’জন কবি মিলে চট্টগ্রামে কাব্যচর্চা করছিলাম। লালদিঘীর তালসুপারি তলায় বসতো আমাদের ‘ক’ নামে একটি সংগঠনের আড্ডা। প্রায় সব অনুষ্ঠান আমি উপস্থাপনা করে বলতামক মানে কবিতা, ক মানে কলম, ক মানে কাগজ, ক মানে কবি…! আসাদ ভাই এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা বাঁকা করে আয়েশি ভঙ্গিতে পাঠ করে যেতেন– ‘পা দুখানা দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে…!’ আমি সংক্ষিপ্ত করার চিরকুট দিতাম, আসাদ ভাই সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে পয়ার ছন্দের মতোন কবিতাপাঠ চালিয়েই যেতেন! আপাদমস্তক ভদ্রলোক তিনি। সাতেপাঁচে নেই। অবিরল কবিতাযাপন করেছেন।

আমাদের আরেকটি আড্ডা ছিলো নাসিরাবাদ সরকারি মহিলা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল কবি চেমন আরার বাসভবনের সুন্দর সবুজ টিলাচত্বরে। দিনের পর দিন সেখানে আমরা কাব্যপাঠ আড্ডা চালিয়ে গেছি। কবি আসাদ মান্নান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা সমিতি নামে আরেকটি সংগঠন করছেন। এর মধ্যে তাঁর সূর্যাস্তের উল্টোদিকে আর সুন্দর দক্ষিণে থাকে (১৯৮১) নামে দুটো কাব্যগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে।

১৯৮৩ সালে কবি আসাদ মান্নান তার লাল টুকটুকে মলাটের ‘সৈয়দ বংশের ফুল’ কাব্যগ্রন্থটি আমাকে উপহার দেন। শিরোনামহীন ১,,,৪ সংখ্যাবাচক পরম্পরায় ৪৪টি কবিতাসমেত নিটোল একটি সনেটগ্রন্থ এই ‘সৈয়দ বংশের ফুল’। ১,,৩ এর পরম্পরায় মনে হয় একটিই কবিতা এগিয়ে যাচ্ছে নদীর প্রবহমানতার মতন পয়ার ছন্দসঙ্গে; যাচ্ছে আশেপাশের দৃশ্যকল্প, সুর, ব্যঞ্জনাকে সাথে করে। এরপরে আরও বেশ ক’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও আমি মনে করি এই কাব্যগ্রন্থ আসাদ মান্নানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তখন অফসেট প্রেস, ফোন বা যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটা সহজ না হলেও আমরা সদ্যলেখা কবিতাসমেত বসে যেতাম নভেলটি রেঁস্তোরা, বোস ব্রাদার্স, সবুজ হোটেল, কখনো অচিরা পাঠচক্র হয়ে সুনীল নাথের জলযোগ অব্দি। কবিতাই একমাত্র উপাস্য ছিলো, সাথে উপাদেয় আড্ডা।

বিস্তৃত লেখার সুযোগ এখানে নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে আসাদভাই যেকলেজে জীবনের শুরুতে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছেন, সেখানেই, তিনি ঢাকা চলে যাবার পর কাকতালীয়ভাবে আমি জয়েন করি। আমাদের সেই আসাদ ভাই, যাঁর গোড়াপত্তন এই চট্টগ্রামে, যিনি এখানকারই সন্তান, তাঁর সাথে কবিতা লিখতে লিখতে কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী শেষ অব্দি হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের এক অনিবার্য স্বর, কথাসাহিত্যের দিক্‌পাল, যিনিও এবারে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন!

কবি বিমল গুহও পুরস্কৃত হয়েছেন এবারে, তিনিও এই চট্টগ্রামের সন্তান। আমি কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থগুলোর সামগ্রিক দীর্ঘ আলোচনা লিখেছিলাম ২০০৬ সালের ১৮ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে, একই সময়ে কবি আসাদ মান্নানের সেযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের আলোচনাও। সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কতক কবি সাহিত্যিক আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগেই দীর্ঘ বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধে তাঁরা আলোচিত, চিহ্নিত হয়েছিলেন। পাঠক তাঁদের গ্রহণ করেছিল। পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আজ কেবল তার প্রকাশ্য ফলাফল জুটল। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে কবি আসাদ মান্নান তাঁর পাথর সে কী করে কাঁদে গ্রন্থে– ‘কবি যখন প্রীতিলতা’ নামে একটি কবিতা আমাকে উৎসর্গ করেছেন, সম্মান আমি মাথা পেতে নিলাম, এটি আমার পুরস্কারও বটে। অন্যপক্ষে কবি কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার হে অন্তর্গত’র প্রকাশক।

আজ এই লেখাটি কেবলই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের, যেখানে কথারা স্মৃতির মোড়ক খুলে তোরঙ্গের ডালা ভেঙে উপচে পড়তে চাইলেও রাশ টেনে ধরতে হচ্ছে। আমার অপার প্রণতি গ্রহণ করুন সহযাত্রী বন্ধু কবি আসাদ মান্নান, কবি কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউক্রেনকে ন্যাটোর বাইরে রাখার রুশ দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘না’
পরবর্তী নিবন্ধজনপ্রিয়তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি না