অবশেষে দুই বছর পর বিনামূল্যের ওষুধ পাচ্ছে ক্যান্সার রোগীরা

রতন বড়ুয়া | শুক্রবার , ১৬ জুন, ২০২৩ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

গুণগত মান’ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় দুই অর্থবছর ক্যান্সারের ওষুধ কিনতে পারেনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে দুই বছর ধরে বিনামূল্যের ওষুধ বঞ্চিত হাসপাতালের ক্যান্সার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডের রোগীরা। এ নিয়ে গত ১ এপ্রিল ‘চমেক হাসপাতাল : বিনামূল্যের ওষুধ বঞ্চিত ক্যান্সারের রোগীরা/দুই বছর ধরে এই অবস্থা, বরাদ্দ থাকলেও ক্রয় জটিলতায় কিনতে পারছেনা কর্তৃপক্ষ’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আজাদী। প্রতিবেদন প্রকাশের পর সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে এই ওষুধ ক্রয়ে উদ্যোগ নেয় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দ্রুত সময়ের মধ্যেই টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। দেয়া হয় কার্যাদেশও। সার্বিক ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর দেড় মাসের মাথায় (প্রতিবেদন প্রকাশের) প্রায় ৭৩ লাখ টাকার ওষুধ এখন হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যান্সার ওয়ার্ডে ওষুধ সরবরাহ করার কথা জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে দুই বছর পর অবশেষে বিনামূল্যের ওষুধ পাচ্ছে ক্যান্সারের রোগীরা। ক্যান্সারের ওষুধ ক্রয় প্রক্রিয়া এরইমাঝে সম্পন্ন হয়েছে নিশ্চিত করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের চাওয়া মতো মানসম্মত ওষুধই কেনা হয়েছে। আমরা দ্রুততার সাথে এই ওষুধ ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করেছি। সবমিলিয়ে প্রায় ৭৩ লাখ টাকার ওষুধ কেনা হয়েছে। কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এরই মাঝে ওষুধ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। এখন সার্ভে কমিটি কর্তৃক সার্ভে সম্পন্ন হলেই ওয়ার্ডে ওষুধ সরবরাহ শুরু হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়ার্ডে ক্যান্সারের ওষুধ পৌঁছে যাবে বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক।

প্রসঙ্গত, চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার (রেডিওথেরাপি) ওয়ার্ডটি চট্টগ্রামসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ক্যান্সারের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসাস্থল। ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পর থেকে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে রেডিওথেরাপি সেবা (মেশিন) রয়েছে কেবল এই হাসপাতালেই। গোটা অঞ্চলে সরকারিবেসরকারি পর্যায়ে দ্বিতীয় কোন প্রতিষ্ঠানেই এ মেশিন নেই। মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এক মাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনও রয়েছে হাসপাতালের এ বিভাগে (যদিও বছর ধরে মেশিনটির সেবা বন্ধ রয়েছে)। বেড়েছে ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যাও। আগে ২৪টি শয্যা থাকলেও বছর দুই আগে তা বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়। সম্প্রতি শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৪টি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে বেশ কয়বছর ধরে ক্যান্সারের চিকিৎসা সুবিধা বেড়েছে এখানে। তবে ওয়ার্ডে সেবা নিতে আসা গরীবঅসহায় রোগীরা অনেক দিন ধরে কষ্টে আছেন। প্রায় দুবছর ধরে সরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যের ওষুধ মিলছে না ক্যান্সার ওয়ার্ডে। মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গরীব ক্যান্সার রোগীদের বিনামূল্যের এসব ওষুধ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা জানান।

ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে জানা যায়ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধগুলো খুবই ব্যয়বহুল। গরীবের নাগালের বাইরে বলা চলে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে বেশি দামি ওষুধ দেয়া সম্ভব না হলেও বেশ কয়টি (প্রায় দশ) আইটেম ওষুধ (ইনজেকশান) গরীব রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ওয়ার্ড থেকে সরবরাহ করা ইনজেকশানের মধ্যেডঙোরোবিসিন, ইটোপোসাইড, সিসপ্লাটিন, ফাইভ এফ ও, ভিনক্রিস্টিন, ডাকার ভাজিন, মিথোট্রেঙেট এবং ডসিট্যাঙিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব ইনজেকশানের স্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুবছর ধরে ওয়ার্ডের রোগীদের সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ওয়ার্ডের একাধিক চিকিৎসক জানান, স্টক না থাকায় রোগীদের বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যয়বহুল অন্য ওষুধের পাশাপাশি গরীব রোগীদের এসব ওষুধও বাইরের দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে।

ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা বলছেনহাসপাতাল থেকে দেয়া এসব ওষুধ মাঝারি দামের বলা চলে। কিন্তু ক্যান্সার রোগীদের কমন ইনজেকশানগুলোর (যা বেশি দিতে হয়) দাম আরো বেশি। এর মধ্যে প্যাকলিটাঙিল এর খরচ ৯ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা, ডসিটেঙিল এর খরচ ৮ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা, জেমসিটামিন এর খরচ ৮ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা ও কার্বোপ্লাটিন এর খরচ সাড়ে তিন হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার কম নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওষুধ ক্রয় বাবদ কেবল ক্যান্সার ওয়ার্ডের (৬নং ওয়ার্ড) জন্যই বছরে প্রায় কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে একাধিক দফায় ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে এসব ওষুধ কেনা হয়ে থাকে। তবে ২০২১ সালের জুনের পর এ বিভাগের জন্য আর নতুন ওষুধ কেনা সম্ভব হয়নি। মূলত ক্রয় প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জটিলতার কারণেই এ সংকটের সৃষ্টি হয় বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।

যে কারণে জটিলতা : গত ১ এপ্রিল আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বনিম্ম দরদাতার কাছ থেকে এসব ওষুধ ক্রয়ের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দুবছর ধরে টেন্ডারে সর্বনিম্ম দরদাতা হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানটি ওষুধ সরবরাহে দায়িত্ব পাচ্ছিল, ক্যান্সার ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা সে প্রতিষ্ঠানের ওষুধ অ্যালাউ করতে রাজি নন। গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওই প্রতিষ্ঠানের ওষুধ তারা রোগীদের প্রেসক্রাইব বা সরবরাহ করতে নারাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হাসপাতালের নেই। সবমিলিয়ে ক্রয় জটিলতায় বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহও বন্ধ থাকে ক্যান্সারের রোগীদের।

রোগীদের কষ্টের কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান ওই সময় আজাদীকে বলেন, টেন্ডারে সরবরাহের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির ওষুধের মান নিয়ে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আপত্তি রয়েছে। তারা রোগীদের ভালো মানের ওষুধ দিতে চান। এজন্য ভালো মানের ওষুধ ক্রয় করে সরবরাহ দিতে আমাদের বলেছেন। কিন্তু আমরা তো চাইলেই নিজেদের মতো কিনে ফেলতে পারিনা। মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া নিয়মের মধ্যেই আমাদের ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। টেন্ডারে ভালো মানের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ম দরদাতা হচ্ছে না। নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগও আমাদের নেই। সবমিলিয়ে একটি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকদের সাথে বিস্তারিত কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মো. ইউসুফ ছাড়াও ওই সময় সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল আউয়াল, সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী, রাকিবুল ইসলাম, রেজিস্ট্রার ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ শুভ, ডা. ফাহমিদা ইসলামসহ আরো বেশ কয়জন চিকিৎসক সাথে ছিলেন।

ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকদের দাবিক্যান্সারের চিকিৎসাটা এমনিতেই সেনসিটিভ (স্পর্শকাতর)। এর মাঝে রোগীদের নিম্মমানের ওষুধ দিয়ে আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনা। আমরা বলেছি, রোগীদের দিতে হলে ভালো মানের ওষুধ দেয়া উচিত। যেনতেন ওষুধ দিয়ে আমরা রোগীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারিনা। টেন্ডারের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানের ওষুধ সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে, ওই প্রতিষ্ঠানের ওষুধের ব্যবহার এখন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ভালোমানের কোন হাসপাতালে বা কোন চিকিৎসক এসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন না। আমরাও চাই ক্যান্সারের রোগীরা ওষুধ পেলে ভালো মানের ওষুধই পাক। ওষুধটা যাতে কাজ করে। সর্বশেষ এ জটিলতা নিরসনে মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে অন্য খাত থেকে ক্যান্সারের ওষুধ ক্রয়ের পথে হাঁটে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দ্রুত সময়ে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তবে যাচাইবাছাই শেষে একটি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পায়। গত ৬ জুন প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে কার্যাদেশ দেয়া হয় বলে জানান হাসপাতালের সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. হুমায়ুন কবির।

এবার কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটির ওষুধের গুণগত মান ভালো বলে অভিমত ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের। মানসম্মত ওষুধ কেনায় অনেকটা স্বস্তি প্রকাশ করে ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মো. ইউসুফসহ অন্যান্য চিকিৎসকরা বলছেনরোগীদের জন্য আমরা ভালো মানের ওষুধ দিতে বলেছিলাম। কারণ, নিম্ম মানের ওষুধে রোগ তো ভাল হয়ইনা, বরঞ্চ আরো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এতে রোগীচিকিৎসক উভয়ের মাঝেই অসন্তুষ্টি কাজ করে। তবে এবার ভালো মানের ওষুধ কেনায় রোগীরা এখন ওয়ার্ড থেকেও ভালো মানের ওষুধ পাবে। এটি রোগীডাক্তার সকলের জন্যই স্বস্তিদায়ক।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় ওষুধপত্রের দাম খুব বেশি উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, নিম্মবিত্ত মানুষের পক্ষে এ রোগের চিকিৎসা খুব বেশিদিন চালানো কঠিন। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন। চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় অধিকাংশ গরীব ক্যান্সার রোগীকেই মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়। ব্যয়বহুল এ রোগের চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি মন্তব্য করে ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মো. ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলছেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় এই বিশাল খরচ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মনিয়োগ করুন
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থনীতিতে বাংলাদেশ এখন মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে