অবরুদ্ধ সাইকেল

নাসের রহমান | বুধবার , ১১ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

প্রান্তকে আগে কখনো এভাবে ঘরে আটকে থাকতে হয়নি। এমনিতে ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। এতদিন দিনের বেলা সারা দিন বাইরে বাইরে কেটেছে। সকালে সে ঘর থেকে বের হয়ে পড়তো ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। মর্নিং শিফটে স্কুল সকাল সাতটায় শুরু হয় । ছুটি হতে হতে দুপুর বারটা। তাড়াতাড়ি বাসায় এসে গোসল করে ভাত খেয়ে আবার বের হয়ে যেতো। দুইটা থেকে কোচিং শুরু বিকেল পাঁচটায় ছুটি হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় দিন সাড়ে পাঁচটা বেজে যেতো। সন্ধ্যার আগে কখনো বাসায় ফিরে আসতে পারতো না। সন্ধ্যার পর বাসায় এসে হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা খাওয়ার পরপর বাসার টিচার চলে আসতো। দিন আর রাত এভাবে ছক বাধা রুটিনের ভেতর চলে যেতো। সায়েন্সের বিষয়ের টিচার আসতো সপ্তাহে চারদিন, আর ইংরেজী ও জেনারেল ম্যাথের টিচার আসতো সপ্তাহের বাকী তিনদিন। এতে সে খুব অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর বাইরেও যে অনেক কিছু আছে তা দেখার সময় কোথায় তার। স্কুল কোচিং হাউস টিউটর এসবে তার সময় কেটে যায়। সে অবশ্য ছোটবেলা হতে আবৃত্তি শিখে আসছে। এ আবৃত্তিটা সে ভালই করতে পারে। স্কুলে জাতীয় দিবসগুলোতে আবৃত্তি করে শোনায়। বিশেষ করে ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ এবং ১৬ই ডিসেম্বর। প্রায় সময় পুরস্কারও পায়। বই পুরস্কার। বইটা সে খুব যত্ন করে রাখে। মাঝে মধ্যে নিজে নিজে পাতা উল্টিয়ে দেখে। যেখানে প্রথম পুরস্কার হিসাবে তার নাম লেখা আছে সেখানে বার বার দেখে। সে নিজে অবশ্য বই পড়ে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য সে। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় বাসার কাছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আসে। মিউজিক বাজিয়ে লাইব্রেরির বাসটি যখন আসতে থাকে সে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুুতি নেয়। আগের সপ্তাহের বইটি জমা দিয়ে আরেকটি নতুন বই নেয়। শুক্রবারে তার স্কুল কোচিং সবই বন্ধ থাকে।
এখন হঠাৎ করে সবকিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রথমে স্কুল বন্ধ হয়েছে। এর পরপর কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে। টিচারও বাসায় আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিও এখন আর আসে না। কিছুদিন পর ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রাস্তায় কোন যানবাহনও দেখা যায় না। এতদিন যে গাড়ির শব্দ হতো, হরণ বাজাতো তা এখন আর শোনা যায় না। রাস্তাগুলো একেবারে ফাঁকা, ফুটপাতেও তেমন কেউ নেই। হেঁটে চলার লোকজনও ঘরের বাইরে আসছে না। খেলার মাঠগুলো আরো আগে ফাঁকা হয়ে গেছে। এত বড় মাঠ এরকম শূন্যে পড়ে থাকাতে আগে কখনো দেখেনি। এ মাঠে শত শত ছেলে একই সময় খেলতে থাকে। ছোট বড় অনেকগুলো দল এ মাঠে খেলা করে। ক্রিকেট আর ফুটবল খেলায় বেশির ভাগ ছেলেরা মেতে উঠে। এক পাশে টেনিস গ্রাউন্ডে অনেকে খেলে। নিজেও আগে এ মাঠে খেলেছে। পরিচিত কয়েক জনের সাথে ক্রিকেট খেলেছে। এত বড় মাঠে একটু জায়গা করে নেওয়া এত সহজ নয়। এ মাঠটিকে অনেকে প্যারেড ময়দানও বলে। এর চারপাশে অনেকে বিকেলে হাঁটে । তারাও ছেলেদের খেলা দেখে। এ মাঠে এখন কেউ আর খেলা করে না। ফুটপাত ধরেও কেউ আর হাঁটে না। হোস্টেলের দু’টি গেইট বন্ধ থাকে। কেউ চাইলেও আর ঢুকতে পারে না। তার একটা ফুটবল আছে। সে এটা হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে, একবার মাঠে ঢুকতে পারলে খালি মাঠে বলটা নিয়ে খেলতে পারতো। কিন্তু কি করে ঢুকবে? এ কয়দিন থেকে পুলিশের টহল বেড়েছে। রাস্তায় কাউকে দেখলে জানতে চাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে। কখনো কখনো ফিরিয়ে দিচ্ছে। এসব সে বাসার বেলকনিতে বসে বসে দেখে। মাঠটি দেখা না গেলে ভাল হতো। এত ফাঁকা মাঠ এত নির্জন পথ সে আগে কখনো দেখেনি। মাঠের পাশে বড় বড় গাছগুলোর দিকে তাকায়। গাছে ডাল পালায় পাখিরা বসে থাকে। প্রাইমারীতে পড়ার সময় এ পাখিদের সাথে তার মিতালী ছিল। অনেক পাখি সে চিনতো। তাদের ডাক খুব ভাল লাগতো, এখন সেসব পাখিরা আর নেই। যারা আছে তারা যেন নিঃশব্দে বসে আছে।
কেন কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছে না তা সবাই জানে। একটা নতুন ভাইরাস মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। ভাইরাসটির নাম করোনা। এটা নাকি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটা থেকে বাঁচতে হলে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বার বার সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে। অন্যের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। ঘর থেকে একেবারে বের হওয়া যাবে না। এরকম কথা সে বাব বার শুনেছে টেলিভিশনে । প্রথম কয়েকদিন চুপচাপ ঘরের ভেতর থেকেছে। খবরগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। দেশে দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ভয়ও পেয়েছে কিছুটা। কিন্তু এসব খবর শুনেতো আর দিন কাটে না। ঘরের ভেতর বলটা নিয়ে খেলা করেছে। হালকা করে পা লাগিয়ে এদিক ওদিক গড়িয়ে গিয়েছে। টিভির বিভিন্ন সিরিয়ালে মন দেওয়ার চেষ্টা করছে। এক ঘণ্টা দেখেছে। তারপর আর মন বসাতে পারেনি। গল্পের বই পড়ার অভ্যাস আগে থেকে আছে। তাতেও সময় কিছু কেটেছে। কিন্তু এখন আর বইতেও এক গেয়েমি এসে গিয়েছে। আবৃত্তির খাতাটা নিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করেছে। নিজের আবৃত্তি নিজে শুনেছে। ঘরের অন্যদের শুনিয়েছে। তারপরও দিনের এত বড় সময়টা পার হতে চায়না। পরের দিন আবার কি করে কাটাবে সে ভাবনাও মাথায় এসে যায়। সহপাঠি কয়েকজনের কাছে ফোন করে দেখে তাদের অবস্থা একই রকম। স্কুল আর কোচিং সেন্টার বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে পাঠ্য বইয়ের পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের তো আবার বই পড়ার অভ্যাস নেই, আবৃত্তিও করে না। তাদের সময় কাটে কি করে। তারা অনেকে মোবাইলে ফেইস বুকে সময় কাটাচ্ছে।
প্রান্ত বাবার কাছে থেকে একটা মোবাইল চেয়ে নেয়। দুই তিন এ মোবাইলে ডুবে থাকে। কিন্তু মাথাটা ঠিক রাখতে পারছে না। মনটাও অস্থির হয়ে গেছে। কথায় কথায় যে কোন ছোট খাট বিষয়ে মেজাজ চড়া হয়ে উঠছে। সে আগে কখনো এক নাগাড়ে এভাবে মোবাইল ব্যবহার করেনি। কিন্তু মোবাইলে বিভিন্ন অপশন তার জানা আছে। দিনে দিনে সে কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ে। নিজেকে আর কোন মতে স্থির রাখতে পারে না। কোন কিছুই আর ভাল লাগে না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করতেও ইচ্ছা হয় না। মা কিছু বললে খারাপ লাগে, বাবা কিছু বললে রাগ এসে যায়। মাকে নিয়ে এক সময়ে ছাদে উঠতো। আট তলা ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে শহরের অনেক কিছু দেখা যায়। দূরের ও কাছের উচুঁ নীচু দালান কোঠা। আশেপাশে বাড়ি ঘর, বড় একটি পুকুর, বাক ফিরানো রাস্তা। আরো চোখে পড়ে কলেজ হোস্টেলের সবুজ গাছ গাছালি। তার চেয়ে বেশি চোখে পড়ে প্যারেড মাঠ। এ ছাদে এক সময়ে সাইকেল চালাতো সে। সিঙ সেভেনে পড়ার সময়ও এ বড় ছাদটিতে এ পাশ থেকে ও পাশে সাইকেলে বার বার চক্কর দিয়েছে। এখন ছাদটি আগের মত আর নেই। একপাশে ইবাদত খানা আরেক পাশে বৈঠক খানা। সাইকেল নিয়ে ঘোরার জায়গা কোথায়? ছোটরাও ছাদটাতে আগের মত খেলতে পারে না। পরে সে কলেজ হোস্টেলের সামনের রাস্তাটাতে অনেক দিন সাইকেল চালিয়েছে। এখানে অনেক ছেলে সাইকেল চালায়। একসময়ে সে রাস্তায়ও চালাতে পারে। সাইকেলটাকে সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সার্ভিসিংও করায়। ফ্ল্যাটের নীচের তালায় সিঁড়ির কাছে শিকল দিয়ে তালা মেরে রেখেছে। এখন তার মাথায় আসে সে যদি সাইকেল নিয়ে একবার ঘুরে আসতে পারতো তাহলে এ অস্থির ভাবটা কেটে যেতো। কতদিন সে ঘরের বাইরে যেতে পারেনি। মনটাতো এমনিতে গুমোট বেঁধে গিয়েছে।
মাথায় এরকম একটা ভাব আসার সাথে সাথে প্রান্ত আর বসে থাকেনি। ঘরের কাউকে না জানিয়ে তালা খুলে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যায়। তখন শেষ বিকেলের সময়। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। সে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে প্যারেড মাঠের পাশ দিয়ে গভর্মেন্ট হাই চিটাগাং কলেজ পার হয়ে গনি বেকারী হয়ে জামাল খান এসে যায়। এ জায়গাগুলো তার কত চেনা কত পরিচিত কিন্তু কোথাও থামে না। চেরাগী পাহাড় হয়ে আন্দরকিল্লার মোড় দিয়ে সিরাজউদ্দৌলা রোডে এসে পড়ে। কিছুটা ঢালু পেয়ে সাইকেলের গতি আরো বেড়ে যায়। মনটা যেন বাতাসের সাথে হু হু করে বয়ে যেতে যেতে একেবারে হালকা হয়ে যায়। কখন চন্দনপুরা পার হয়ে আবার ফ্ল্যাটের কাছে এসে যায় বুঝতে পারে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজব গাঁয়ের কথা
পরবর্তী নিবন্ধব্ল্যাক ককাটো!