অপরাধ কমছে না পুলিশে

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

নগরীর পাহাড়তলী থানার পশ্চিম নাসিরাবাদ হালিশহর রোডের সামনে থেকে ২০১১ সালের ২ মার্চ ১৫০ ইয়াবাসহ জাসেদুল হক নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২ মাস ১ দিন কারাভোগের পর চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ২০১১ সালের ৩ মে জামিন নেন তিনি। এরই মধ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালত মাদকের মামলায় জাসেদুল হককে ৫ বছরের কারাদন্ড, ১ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে পলাতক ছিলেন এই জাসেদুল হক। শুধু তাই নয়, সে নিজের ভুল ঠিকানা দিয়েছিলেন পুলিশকে। সাজা হওয়ার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কঙবাজার জেলার রামু থানার রাজাকুল সিকদার পাড়ার ওবায়দুল হকের ছেলে জাসেদুল হককে ওই এলাকার ইত্যাদি স্টোর নামে একটি দোকান থেকে গ্রেপ্তার করে রামু থানা পুলিশ। পরে প্রমাণিত হয় শুধুমাত্র পুলিশের ভুলের কারণে তিনি কারাভোগ করেছিলেন। ২৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি জামিনে বের হন। জানা যায়, ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন এই জাসেদুল হক মালয়েশিয়া ছিলেন। বিনা দোষে জেল খাটা জাসেদুল হক বলেন, আমি যে আসামি নই এটি আমি অনেকভাবে পুলিশকে বলেছি; কিন্তু আমার কথা কেউ শুনেনি। আমার জীবন থেকে বিনা দোষে হারিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন।
এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, এ ধরনের নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত পুলিশ। অথচ দিনে দিনে বাড়ছে পুলিশের সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু এরপরও তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমছে না। কতিপয় পুলিশ সদস্যের মাদক সেবন ও ব্যবসা, নিরীহ লোকজনকে ফাঁসানো, ঘুষ বাণিজ্য, ছিনতাই, ডাকাতি এবং নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ পুরো বাহিনীর অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় শাস্তির পরও থেমে নেই অপরাধ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের নতুন কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এবং নতুন পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ যদিও বলেছেন, অপরাধের দায়ভার ব্যক্তির। তার দায় পুরো বাহিনীর ওপর বর্তায় না।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় যোগদান করেই বলেন, পুলিশ ভীতি ও অপরাধী ভীতি দূর করে আমি আমার কাজ এগিয়ে নিতে চাই। জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করবে পুলিশ। পুলিশ যাদের জন্য কাজ করছে সেই জনগণ যেন পুলিশকে আস্থার প্রতীক হিসেবে নিতে পারে আমরা সেই কাজটিই করবো। একইভাবে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেছেন, কোনো পুলিশ সদস্য যদি অপরাধ করে থাকে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোপূর্বে আমাদের পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য অপরাধ-অনিয়মে জড়িয়েছে; তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদস্যের কেউ অপরাধে জড়ালে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। এ কাজের দায়ভার তার বিভাগ কখনও নেবে না।
কিন্তু এতে পুলিশ বাহিনীর প্রতি যে আস্থা সংকট তৈরি হচ্ছে সে বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্প্রতি পুলিশের বেপরোয়া মনোভাবের কারণ অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, জবাবদিহিতা না থাকাটাই মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত ‘পুলিশের চাকরি যায় না’ বিষয়টি জানা থাকায় সাময়িক বরখাস্ত কিংবা স্ট্যান্ড রিলিজ হওয়াটাও তাদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। তাই একটি ঘটনার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নতুন ঘটনার জন্ম হচ্ছে। আর তাই প্রকৃত অর্থেই পুলিশ বাহিনী জনগণের সেবক হয়ে উঠতে পারেনি। জনগণও পুলিশকে তাদের বন্ধু ভাবতে পারে না আজও।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের একাধিক সূত্র মতে, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পরও কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সদর দপ্তরে প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে ঘুষ বাণিজ্য, মামলা দিয়ে হয়রানি, নারী নির্যাতন, পরকীয়া, নারী কেলেঙ্কারি, চাঁদা দাবি ছাড়াও জীবননাশের হুমকির অভিযোগ রয়েছে। ই-মেইল, মোবাইল ফোন বা সরাসরি এসব অভিযোগ আসছে। প্রাপ্ত অভিযোগ যাচাই বাছাই করে প্রতি মাসে গড়ে ১২০০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্তের জন্য গঠিত সিকিউরিটি সেল এখন নতুন নামে কাজ করছে।
চট্টগ্রামে পুলিশের সাম্প্রতিক অপরাধ প্রবণতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় মাদক ও অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, এমন অভিযোগে বায়েজিদ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান, ৭ জন এসআই, ৬ জন এএসআই ও তাদের এক সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২ এ মো. রুবেল নামের এক যুবক মামলাটি করেন।
বাদীর আইনজীবী আজিজুল হক আদিল মামলা দায়েরের বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করে বলেন, আদালত আমার মক্কেলের মামলাটি গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার নিম্নে নন এমন কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতেও আদেশ দেয়া হয়।
হাসপাতালের এক কর্মকর্তাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো ও ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে চার পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হালিমের আদালতে আবেদনটি করেন নগরীর আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের সহকারী ওয়ার্ড মাস্টার কামরুল ইসলাম। বাদীর আইনজীবী আসাদুজ্জামান খান বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাদীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পান। মিথ্যা মামলা করায় তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালত আগামী ১২ ডিসেম্বর আদেশের জন্য রেখেছেন।
কঙবাজার শহর থেকে টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের মামলায় গোয়েন্দা পুলিশের সাত বরখাস্ত সদস্যকে ৭ ও ৫ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। গত ২০ সেপ্টেম্বর দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কঙবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাঈল এই রায় ঘোষণা করেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) ফরিদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মিথ্যা মামলার পর মিথ্যা প্রতিবেদন ও সাক্ষী দেওয়ার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ চট্টগ্রামের বিচারকের দায়ের করা মামলায় আত্মসমর্পণের পর জামিন পেয়েছেন পুলিশের দুই এসআই। সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেব’র আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী নারায়ন চন্দ্র পাল জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্ত্রী খুনের ঘটনায় সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর পুলিশেরই কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একাট্টা হয়ে ষড়যন্ত্রের পট তৈরি করেন। আর এরই অংশ হিসেবে স্ত্রী খুনের মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিহিংসামূলক কর্মকান্ড শুরু করেন তারা। এ ধারাবাহিকতায় পিবিআই কার্যালয়ে টানা আটদিন ধরে নির্যাতন করা হয়েছে বাবুলকে। এ সময় স্ত্রী হত্যার ঘটনায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য তার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে চালানো হয় নির্যাতন। এমন সব অভিযোগ এনে ৮ সেপ্টেম্বর মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন্নেছার আদালতে মামলার আবেদন করেন বাবুল আক্তার। বাবুলের আবেদনে আসামি করা হয়েছে ছয়জনকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিমাশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রের কারিগরদের ব্যস্ততা
পরবর্তী নিবন্ধময়লার স্তূপে শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ