অপরাজিত মেয়েরা

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ৩ জুন, ২০২৩ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

গারো পাহাড়ের পাদদেশ কিংবা কলসিন্ধুরের অন্ধকার পথঘাট মাড়িয়ে পায়েপায়ে রক্ত ঝরিয়ে এতটা পথ এসেই থেমে যাবে ওদের পথচলা? বাফুফেতে কি সেই আয়োজনই চলেছে! দেশকে অসামান্য সাফল্য এনে দেওয়া অদম্য মেয়েগুলো আকন্ঠ হতাশায় ডুবে আছে। তাদের অবস্থা দেখে বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল, আমাদের যত অর্জন তার কোনটাই আমরা ধরে রাখতে পারিনি। অথবা আমাদের কোন অর্জনেরই ধারাবাহিকতা নেই! এটা যেন আমাদের মজ্জাগত সমস্যা। অর্থহীন রাজসিক সম্মান জানানোর কি প্রয়োজন ছিল? কি প্রয়োজন ছিল এতো এতো সংবর্ধনার? যদি উড়ুক্কু পাখিগুলোর ডানাই মেলতে না দেওয়া হয়!

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন গত সেপ্টেম্বরে সাফ বিজয়ী হওয়া টিমটাকে কোন খেলাই দিতে পারেনি! একটু খোঁজ নিলেই জানা যায় তাদের স্বপ্ন ভাঙার, হতাশার আর বঞ্চনার গল্পগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হওয়ার পরও মেয়েদের ফুটবলকে পেছনেই ফেলে রেখেছে বাফুফে। দীর্ঘদিনের কান্ডারি গোলাম রাব্বানী ছোটন যিনি দায়িত্বশীল ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন এতোদিন, তিনি দায়িত্ব ছেড়েছেন! সাফের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় অভিমানে অবসর নিয়েছেন মাত্র ২২ বছর বয়সে! অথচ এখনই তাঁর দাপিয়ে খেলার কথা। পুরো টিমটি আছে এক ধরনের অস্থিরতায়। ভারত এর মধ্যে সাতটি ম্যাচ খেলেছে। ভুটান যারা আমাদের মেয়েদের কাছে ৮ গোলে হেরেছে তারা চারটি ম্যাচ খেলে দুটো জিতেছে। অলিম্পিক বাছাইয়ে পাকিস্তান ৬ গোল খেয়েছে ওরা ও চারটি ম্যাচ খেলেছে একটি জিতে আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। অথচ চ্যাম্পিয়ন দল কোন খেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগই পেলোনা! কয়েকদিন আগে জানা যায় সাফ জয়ী দল থেকে বাদ পড়ে খেলা ছেড়েছেন আনাই মোগনি ও সাজেদা খাতুন। সব মিলিয়ে ফুরফুরে উদ্ভাসিত মেয়েদের দলটির তাল লয় ছন্দ সব হারিয়েছে বাফুফের দায়িত্বহীনতায়। দিনে দিনে মেয়েদের হতাশা ও অপ্রাপ্তিগুলো ক্রমেই বড় হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জেতার পর তাদের আর খেলতে দেওয়া হয়নি বিভিন্ন অজুহাতে। মায়ানমারে অলিম্পিক বাছাইপর্বে খেলার সুযোগ ছিল সেটা বন্ধ করেছে বাফুফের অর্থাভাবের কারণ দেখিয়ে! এর আগে সিংগাপুরে দুটি ম্যাচ খেলার ঘোষণা দিয়েও কথা রাখেনি ফেডারেশন। খেলতে না পারার সাথে যোগ হয়েছে বেতন না বাড়ানো ও বকেয়া বেতন! অথচ এই বেতনটাও খুব বেশি নয়। একমাত্র সাবিনা খাতুনের বেতন ২০ হাজার টাকা। বাকিদের বেতন ১০১২ হাজারের বেশি নয়। কিংবা তারচেয়েও কম। চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বিএসপি এর বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের পাশাপাশি বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদদের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও ছিলেন। সেই আনন্দ ছাপিয়ে সামপ্রতিক অবস্থা তাঁকেও উদ্বিগ্ন করে রেখেছে।

সেই সাফ সাফল্যের পর মিডিয়ায় একটা ছবির কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। বিজয়ী মেয়েদের সংবাদ সম্মেলনে সাবিনাদের পেছনে ঠেলে কর্তাব্যক্তিরাই সামনে বসেছিলেন মহানায়কদের মতো! ভাবখানা এমনই ছিল যেন তাঁরাই খেলাধূলা করে রাজ্য জয় করে বিজয় মুকুট নিয়ে এসেছেন! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাবলিক তাঁদের তুলোধুনো করতে ছাড়েনি। সেই যে পেছনে ঠেলে দেওয়ার গল্পের শুরু তা আজও চলছে। তীরে এসে তরী ডুবানোর কাহিনি তো কম নয়! এই মেয়েরাই হয়তো একদিন বিশ্বসেরার রেকর্ড গড়তে পারতো। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতে চাই এই জয়ের গল্প এখানেই শেষ নয়। লম্বা একটা সময় থেকে বাংলাদেশ নারী জাতীয় ফুটবলাররা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ও খেলতে না পেরে তাঁদের ফিটনেস নিয়েও শংকায় পড়েছেন। প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতার পর বসে থাকা হতাশার। সেই হতাশা থেকে কেউ কেউ স্বেচ্ছা অবসরের ঘোষণাও দিয়েছেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার দায়ভার তো বাফুফের ঘাড়েই বর্তায়। অথচ বাফুফের সভাপতি বলছেন, ‘মেয়েরা যাচ্ছেআসবে এটাই তো নিয়ম মেরাডোনা নেই মেসি এসেছেন, মেসি ক্লাব ছেড়েছেন রোনালদো এসেছেন এই তো আসাযাওয়া প্রক্রিয়া।’ প্রশ্ন তো আমাদেরও! সেই প্রক্রিয়ায় আপনি কেন নেই! সম্মানিত বাফুফের সভাপতি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের সমাজ মেয়েদের কিভাবে অবরুদ্ধ করে রাখে! কি পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয় উঠে আসতে! একটু জায়গা তৈরি করে নিতে! তাছাড়া নারী ফুটবলার হওয়ার সাধনা ও প্র্যাকটিস করা কতটা কঠিন ছিল তাতো তাদের জীবনের গল্পেই আমরা জেনেছি। সমাজ তো বটেই পরিবারের সমর্থন পেতেও তাদের অনেক সময় লেগেছে। কতটা অসার এমন যুক্তি! এমন সমাজ কাঠামোতে থেকে সভাপতি সাহেব মেয়েদের চলে যাওয়ার সাথে কিভাবে মেরাডোনামেসিদের উদাহরণ দিতে পারেন সেটা আরও বিস্ময়কর! সভাপতি সাহেব এমন একটা উদাহরণ দিতে পারলে কৃতার্থ হতাম যে ২২ বছর বয়সে কেউ খেলা ছেড়েছেন এমন ফর্মে থাকা অবস্থায়! বাফুফে মেয়েদের খেলতে দিতে পারে না, বেতন দিতে পারে না,খাবার দিতে পারে না। অথচ পদ আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। সত্যি কথা তো এই, তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, জালিয়াতির অভিযোগ এনে এবিষয়ে তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টের রিট আবেদনও করা হয়েছে।

লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারটা যদি একটু আনি, মেয়েদের দলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিলো পুরুষ জাতীয় দলকে তাদের কাছে প্রত্যাশার ফল কি হয়েছে সেটা তো পরিষ্কার। অথচ অবহেলিত মেয়েদের ফুটবল কি অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে।

নারী খেলোয়াড়েরা বাফুফের বেতনভুক্ত হলেও ক্লাব পর্যায়ে খুবই কম পারিশ্রমিক পান। সাবিনাকৃষ্ণারা ৩৪ লাখ টাকা পেলে তপুজামালেরা পান অর্ধ কোটির চেয়েও বেশি। কলসিন্ধুরের সহকারী স্কুল শিক্ষক মফিজউদ্দীন স্যার প্রধান শিক্ষক মিনতি রাণী শীল এই মেয়েদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন নিঃস্বার্থভাবে। তাঁরা মেয়েদের পরিবারের সাথে লড়ছেন, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়ছেন, লড়ছেন বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথেও। একএকবার প্র্যাকটিসের সময় গলদঘর্ম হয়েছেন পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গীর কাছে।

সত্যি সত্যিই যদি বাফুফের অর্থাভাব হয়ে থাকে নারীবান্ধব বলে পরিচিত সরকার কেন এগিয়ে আসছেন না? কেন এতবড় অর্জনকে এভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে? এত বড় বড় নতুন ধনীর দেশ আমাদের! কেন একজন পৃষ্ঠপোষকও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! অনেক প্রশ্ন, অনেক হতাশা আমাদের। প্রত্যাশা রইল মেয়েদের ফুটবলের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সুযোগ পেলে এই মেয়েরাই একদিন বিশ্বকাপ জিতে দেখাবে নিশ্চিত। দ্য আনবিটেন আওয়ার গার্লস!

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাস্তুতন্ত্র পুনর্গঠন সম্ভব
পরবর্তী নিবন্ধসৌভাগ্যবান ব্যক্তিরাই জনসেবার জন্য আল্লাহর মনোনীত হতে পারেন