রাতের অন্ধকার চিরে দূর দূর থেকে ল্যাম্পের আলোগুলো যখন শেষরাতে এগিয়ে আসত, গ্রামের স্কুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করত। গ্রামের মাঝখানে স্কুল। সব রাস্তায় সেই ছোট ছোট আলোর মিছিল। স্কুলের দিকে আসতে শুরু করেছে ছাত্রছাত্রীরা। খুব ভোরে শুরু হবে প্রভাতফেরি। আমি তখন অনেক ছোট, স্কুল কোয়ার্টারে থাকি, বাবা সেই গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগে বেশ ক‘বছর ধরে প্রভাতফেরির আয়োজন হচ্ছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলন, এত কিছু ঠিকঠাক বুঝতাম না তখন। শুধু জানতাম, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। একুশের আগের রাত মানে আমার কাছে রাত জেগে পলাশ ফুলের মালা গাঁথা; সাদা কাগজে লাল কালির বর্ণমালা।
সূর্য ওঠা ভোরে স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। শেষ রাতের কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। পূর্ব দিগন্ত যখন আলোয় ভরে উঠছে, নগ্ন পায়ের মিছিল তখন আরো দীর্ঘ। এ পাড়া, ও পাড়া থেকে সাদা, কালো, লাল, নীল, সবুজ সব রঙ এসে মিশে সে মিছিলে। গন্তব্য স্কুলের শহিদ মিনার।
এখন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাছে দাঁড়িয়ে দেখি সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে সাদা কালোর সারি। ব্যানারে ব্যানারে ছেয়ে গেছে মিছিল। এক হাতে জুতো, অন্য হাতে ফুল নিয়ে মিনারে উঠে কেউ সেল্ফিতে ব্যস্ত, কেউ ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছে। এ যেন আর বোধের বিষয় নয়, উদযাপনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়োজনের ব্যাপকতা বেড়েছে, চেতনা সংকুচিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলে সিটি কর্পোরেশনের কালো কালিতে ঢাকা পরে ইংরেজি সাইনবোর্ড। ফ্যাশন হাউসগুলো বর্ণমালা শাড়ি পাঞ্জাবিতে রঙিন থেকে হয়ে যায় সাদা কালো। ফুলের দোকানে কোটি টাকার ব্যবসা। আর বাকি এগারো মাস ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’ বলে আফসোসের দিন। তবু ছোটবেলার আমার সেই প্রভাতফেরির আবেগ আমাকে মনে করিয়ে দেয়– ‘একুশ মানে আসছে, স্বপ্ন আসছে, ভবিষ্যত আসছে’। ভালোবাসার সেই প্রভাতফেরিতে আড়ম্বর ছিল না। সাদা কাগজে লাল কালিতে লেখা ‘আ–মরি বাংলা ভাষা’কে স্পর্শ করে মনে হত এই আমার বাংলা ভাষা। বুঝতাম ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’। সবুজ পাতা আর পথের পাশের ফুলে গাঁথা মালায় জড়িয়ে থাকতো ভালোবাসা। স্মৃতির মিনার জবা, পলাশ, শিমুল, ভাটফুলে সেজে হয়ে উঠত শ্রদ্ধার নিদর্শন।
আজকের নাগরিক একুশ উদযাপনে আড়ম্বর বেড়েছে। দোকানে তৈরি করা বিশাল ফুলের মালায় রাত জাগা সেই আবেগ নেই, আছে দায়িত্ববোধ। সেই দায়িত্ব থেকেই যেন আগামী প্রজন্ম বলতে পারে : প্রভাতফেরি প্রভাতফেরি / আমায় নেবে সঙ্গে / বাংলা আমার বচন / আমি জন্মেছি এই বঙ্গে‘। রক্ত ঝরা বায়ান্ন আর একাত্তর। রক্তে গড়া বাংলা ও বাংলাদেশ; হৃদয়ের উষ্ণ আলোয় আলোকিত। ১৯৫২ র মাথা নত না করা ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের পৌঁছে দেয় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো ১৯৭১ এ। তাই ‘একুশ মানে দিগন্ত জোড়া আগামী দিনের স্বপ্ন… একুশ মানে আমার সোনার বাংলা…একুশ মানে আসছে স্বাধীনতা আসছে, বাংলাদেশ আসছে‘। লেখক: আবৃত্তিশিল্পী ও কলেজ শিক্ষক।