অকূলপাথার

জাহেদুল আলম | শুক্রবার , ৫ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রথম ডুব মেরে রুই ও জাল মাটি মুক্ত করে আবার পা দিয়ে জড়িয়ে রেখে ফুঁস করে মাথা পানির উপরে তুলে চোখ মেলতেই দেখি, পুকুরের দক্ষিণপাড়ের তরকারি ভিটায় বল্লাগাছ-তলে দাঁড়িয়ে আছে পারভীন! পারভীন এখানে কী করে এলো? স্বপ্ন দেখছি না তো! পানি থেকে ডুব দিয়ে উঠলাম, নাকি পাতালপুরি থেকে মাটি-পানি ফুঁড়ে উঠলাম, নাকি কোনো রূপকথার রাজ্যে এসে পড়লাম; কিছুই বুঝতে পারছি না।

একইসাথে একটা রুইমাছ পড়েছে, একটা শোলমাছও পড়েছে। ছটকী জাল। তারপরও এই দুই মাছ একসাথে জালে ফেলা দুঃসাধ্য। আব্বা সেই অসাধ্যই সাধন করেছেন। আব্বা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা দিচ্ছি- দেশভাগ পরবর্তী প্রথমভাগে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। যক্ষা রোগ ধরা পড়াতে তাঁকে আমার দাদা শহর থেকে সরিয়ে সীতাকুণ্ড থানার বেয়াই বাড়িতে রেখে আসেন। তখন যক্ষা রোগি পাওয়া গেলে তাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিয়ে যেতো। কোয়ারেন্টাইনে রাখতো (বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলেও কোয়ারেন্টাইন ছিল)। কিন্তু, গুজব ছিল সেখানে (কোয়ারেন্টাইনে) নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার নামে রোগিকে অযত্নে ফেলে রাখতো। একটা পর্যায়ে রোগি মারা যেতো। লাশ পাওয়া যেতো না। তখন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিত, রোগি পালিয়ে গেছে। এসব গুজব বা শোনা কথা।

সেই প্রচারণায় আস্থাশীল হয়ে আমার কোর্টের মুহুরি দাদা আমার আব্বাকে গোপন করে ফেললেন। আব্বার আর মেট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষা দেয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর মেধা ও প্রতিভা গোপন থাকলো না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে শওয়াসেলের জুট ডিভিশনে ডিস্ট্রিবিউশন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। বাহাত্তর সালে সেই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে গ্রামে এসে ওষুধের দোকান দিলেন। যে বাজারে একজন প্রমোটেড সরকারি ডাক্তার ছাড়া কোনো এমবিবিএস ডাক্তার নেই, সেখানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেইন গেইটে প্রচলিত ওষুধের দোকানের আদলে একটি দোকান দিয়ে বসলেন। পাইকারি ও খুচরা ওষুধের দোকান। জমিয়েও ফেললেন। ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট ও দাড়িয়াবান্ধায় তিনি দুর্দান্ত খেলোয়াড়। বাড়তি নেশা বড় পুকুর ও দিঘিতে বড়শিতে মাছ ধরা। আর নিজ পুকুরে কখনও বড়শিতে, কখনও জাল মেরে বড় মাছ তুলে সবাইকে বিতরণ করে ও খাইয়ে বিমলানন্দ উপভোগ করতেন। আজ নেমেছেন আমাদের বাড়ির দক্ষিণপাশে নোয়াপুকুরে।
বাপ-বেটা মিলে প্রথমেই জালের ঘাই গেঁড়ে দিয়েছি। আব্বা রুই মাছটাকে কয়েক সেকেন্ডেই বাগে নিয়ে এসেছেন। আমাকে ডেকে রুইটাকে দুইপায়ে আটকে রাখার দায়িত্ব (কৌশল রপ্ত ছিল) দিয়ে নিজে এবার শোলমাছটাকে ধরতে মনোনিবেশ করলেন। অনেকক্ষণ জাল গাবানোর (পুকুরের মাটিতে পা দিয়ে জাল ক্রমাগত দেবে ফেলা) পর শোলমাছ অতিষ্ঠ হয়ে মাটির তলা থেকে উপরে উঠে আসে। তখন জালের নিচে ও পায়ের নিচে আটকা পড়ে। কাজটা বাপ-বেটা মিলে করি। কিন্তু, এখন আমার দায়িত্ব রুইমাছটাকে আটকে রাখা। এখান থেকে নড়াচড়া করা মানে রুইমাছটা হারিয়ে ফেলা। ফলে আব্বা একাই শোলমাছ অনুসন্ধান করছেন। একটা সময় শোলমাছ ধরা দিল, আব্বার পায়ে। জালের এক দিকে আমি পা দিয়ে রুই আটকে রেখেছি, অপরদিকে আব্বা আটকে রেখেছেন শোল। এখন আমার কি কর্তব্য বলে দিতে হবে না। ডুব মেরে হাত দিয়ে জাল ও রুইমাছ মাটি থেকে বের করে রুইটাকে জাল দিকে পেঁচিয়ে ফেলা।

কিন্তু, পারভীন এখানে কি করে এলো? স্বপ্ন দেখছি না তো! অথৈ জলে পড়লাম যেন। পারভীন দাঁড়িয়ে আছে বল্লাগাছ-তলে। তার মাথার উপর ও আশেপাশে হলুদ আর লাল বল্লাফুল ফুটে আছে। পেছনে আমার আব্বার শখের জাফরান গাছ (বিচিত্র রকমের কৃষি আব্বার আরেক নেশা), ফুল ফুটে আছে। পারভীনের পরনে হালকা গোলাপী জামা। ফর্সা-রঙা গোলগাল চেহারার পারভীনকে দেখতে লাগছে যেন পারভীন ববি ও রতি অগ্নিহোত্রীর মত। তাকিয়ে আছি তো তাকিয়ে আছি, কয় সেকেন্ড অতিবাহিত হয়েছে বুঝতে পারছি না।

সংবিত ফিরলো আব্বার ডাকে। আব্বা শোল সামলাতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে এদিকে যে সঞ্জয় লীলা বনশালীর নির্দেশনায় একটি রোমান্টিক দৃশ্য চিত্রায়িত হয়ে গেল, তিনি তা চাক্ষুষ করেননি। আব্বার ডাকে পায়ের নিচে মাটি ফিরে পেলাম। কিন্তু পায়ের নিচে রুই নেই! হায়! আমার পায়ের নিচে থেকে যেন মাটি নয় শুধু, পৃথিবীই সরে গেল।

পানির নিচেই আব্বার ভয়ে আর পারভীন-শিহরনে কাঁপছি, ঘামছিও। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে মাছ কই? হঠাৎ একটি নারীকণ্ঠ কানে এলো- ‘কাকা হোছনকে ডাকেন। না হলে জমির মাছটা ধরতে পারবে না’। কণ্ঠটা রাশেদার। রাশেদা আমাদের দক্ষিণ বাড়ির মেয়ে। আমার সহপাঠী। পারভীন এসেছে রাশেদার সাথে। পারভীন-ঘোরে এতক্ষণ রাশেদাকে আমার চোখেই পড়েনি। মানলাম, পারভীন আর রাশেদা বান্ধবী। কিন্তু আধা মাইল দূর থেকে পারভীন রাশেদাদের বাড়িতে আসবে কেন? কোনোদিন তো আসেনি! আর এসেছে যখন, তখন এখান পর্যন্ত মানে আমাদের নোয়া পুকুরপাড় পর্যন্ত আসলো কি করে? তা-ও আবার আমার মাছ ধরার সময়! হিসাব মিলছে না। আবার অনেক হিসাব মিলেও যাচ্ছে। কিন্তু, রুই অন্তর্ধান অনুসন্ধানের কি হবে? হোছন আসুক। প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় এখন পারভীনের সামনে পানি থেকে উঠি কিভাবে? সিদ্ধান্তগ্রহণে কোনো থৈ পাচ্ছি না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইতিহাসের অনবদ্য স্মৃতিচারণ: জীবনের জয়রথ
পরবর্তী নিবন্ধদুর্দশাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো আ.লীগ কর্মীদের মূল কাজ : সালাম