স্মরণ : স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রবক্তা শহীদ স্বপন চৌধুরী

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | মঙ্গলবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক, বিএলএফ জোনাল কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ স্বপন চৌধুরীর ৫০ তম আত্মাহুতি দিবস ছিলো গত ৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান হানাদারদের হাতে রাঙ্গামাটিতে মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী নিহত হন। শহীদ স্বপন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার উত্তর ঢেমশার কৃতি সন্তান। পিতা হরি রঞ্জন চৌধুরী ও মাতা রানু প্রভা চৌধুরী। সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে তার জন্ম। ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় যথাক্রমে পঞ্চম ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মেধার ভিত্তিতে প্রথমে ভর্তি হন ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রয়োজনে এবং এই সংগঠনকে স্বাধীনতা অর্জনের উপযোগী হিসাবে গড়ে তুলতে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের অনার্সে ভর্তি হন। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি ১৯৬৯ সালে গণ অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মু্‌ক্িতযুদ্ধে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় তিনি সর্বপ্রথম স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। স্বাধীন বাংলাদশের প্রথম পতাকার ডিজাইন করা ও উত্তোলনেও তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
শহীদ স্বপন চৌধুরীর বাড়ি আর আমাদের বাড়ি অনেকটা লাগোয়া। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি ছিলাম চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। একদিন সকালে স্বপন চৌধুরী ও উনার বড় ভাই তদানিন্তন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রূপেন চৌধুরী (অধ্যক্ষ) আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ট্যাঙি যোগে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। আমার মাকে দেখে স্বপন চৌধুরী কুশল বিনিময় করেন। মা উনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্বপন আবার কবে ফিরবে?’ স্বপন চৌধুরীর দৃপ্ত কণ্ঠের উত্তর, ‘দেশ স্বাধীন হলে তবেই ফিরব’। তিনি চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিকামী ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। একাত্তরের ২৮ মার্চ তৎকালীন রাইফেল ক্লাবের অস্ত্রাগার ভেঙ্গে তাদের মধ্যে অস্ত্র বণ্টন করেন। পরবর্তীতে তিনি রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় হরিনা ক্যাম্পে উচ্চতর ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করেন। তিনি বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে ছাত্র ও যুবক সম্প্রদায়কে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে আগরতলায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদ, মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী, মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান সহ ভারতীয় মিত্র বাহিনীর এক যৌথ বৈঠকে শহীদ স্বপন চৌধুরী তার বক্তৃতায় গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার রূপরেখা তুলে ধরেন। পরবর্তীতে বিএলএফ আঞ্চলিক কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে তিনি অক্টোবরে অধিকৃত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি তার দল সহ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কাউখালীতে টানা দুইদিন পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধের এক পর্যায়ে ৩০ নভেম্বর আরো ৩ জন নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। পাক বাহিনী তাকে তাদের রাঙ্গামাটি সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের অল্প কিছুদিন আগে পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের এই মহান যোদ্ধাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং লাশ গুম করে ফেলে।
দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব দিয়ে যে সংগ্রাম শহীদ স্বপন চৌধুরী শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে তা অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের চার মূলনীতির অন্যতম হিসাবে সমাজতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেন সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানে। এভাবেই শহীদ স্বপন চৌধুরীর স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করেন। স্বাধীনতা লাভের অব্যবাহিত পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তার সরকারের তদানিন্তন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার শহীদ স্বপন চৌধুরীর বাড়িতে এসে পরিবারের সাথে দেখা করেন এবং এই বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই মুহুর্তের সাক্ষী হবার। শহীদ স্বপন চৌধুরীর সৃ্মতি রক্ষার্থে আমাদের গ্রামে স্থাপিত হয় শহীদ স্বপন, দীলিপ ও মনিরুল ইসলাম স্মৃতি পাঠাগার (শহীদ দিলীপ কান্তি চৌধুরী ও মনিরুল ইসলামও আমাদের গ্রামের অন্য দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ)। বঙ্গবন্ধু সরকার চট্টগ্রাম শহরের রাইফেল ক্লাবকে ‘শহীদ স্বপন পার্ক’ ঘোষণা করে। পরিতাপের বিষয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু নৃশৃংসভাবে হত্যাকাণ্ডের পর এসবের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে শহীদ স্বপন চৌধুরী সহ মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি মুছে ফেলতে তৎপরতা চালায়। তবে ইতিহাস আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তাই আজকের দিনে শহীদ স্বপন চৌধুরীর আদর্শ নতুন প্রজম্মের কাছে তুলে ধরা আবশ্যক। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গের জীবনালেখ্য নিয়ে অনুষ্ঠান উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। শহীদ স্বপন চৌধুরীর জন্মস্থান সাতকানিয়া তথা চট্টগ্রামে তার স্মরণানুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। তার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম এই মহান দেশপ্রেমিককে জানতে পারবে, তার আদর্শে উজ্জ্বীবিত হবে। তার পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে অবলুপ্ত শহীদ স্বপন পার্ক পুননির্মাণ, চট্টগ্রাম শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা শহীদ স্বপন চৌধুরীর নামে নামকরণ এখন সময়ের দাবী। এসব উদ্যোগ গ্রহণ আজ আবশ্যক আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করার জন্য এবং দেশপ্রেমের স্ফুরণে। এতে দেশে চলমান উন্নয়ন দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যতায় কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
এদেশের জন্য শহীদ স্বপন চৌধুরী জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার মতো বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল আজ আমরা সবাই ভোগ করছি। শহীদ স্বপন চৌধুরী এ দেশের ভবিষ্যত গড়ে দিয়ে গেছেন তার জীবনের বিনিময়ে। তাই তিনি তার মুক্তিযুদ্ধকালীন সহযোদ্ধা ডা. ইউসুফ চৌধুরীকে বলেছিলেন, “when you go home, tell them of us and say; for your tomorrow we gave our today” (ভাবার্থঃ তুমি বাড়ি গিয়ে তাদের বলো, তাদের ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করলাম।)” এইটা ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বৃটিশ সেনাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত নাগাল্যান্ডের কোহিমা ওয়ার সিমিট্রির সমাধিলিপি। ইংলিশ কবি ও নাট্যকার এডমন্ডসের লেখা এই সমাধিলিপি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক স্মৃতিস্তম্ভেও খচিত রয়েছে। এভাবে শহীদ স্বপন চৌধুরী ভবিষ্যত দ্রষ্টার মতোই যুদ্ধক্ষেত্রে উচ্চারণ করেছেন তার আত্মত্যাগ ও দেশের ভবিষ্যতের কথা।
শহীদ স্বপন চৌধুরী অমর রহে।
তথ্য সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, ১ম খণ্ড, আগস্ট ২০১৩
লেখক : চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার ঢেমশা গ্রামের অধিবাসী ও সাতকানিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের ছাত্রলীগের সাবেক সাহিত্য সম্পাদক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজানে আলম ভাই : মননে ও পঠনে যিনি ছিলেন স্বতন্ত্র
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল