জানে আলম ভাই : মননে ও পঠনে যিনি ছিলেন স্বতন্ত্র

নাজিমুদ্দীন শ্যামল | মঙ্গলবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

এডভোকেট মো. জানে আলম আমার ছেলেবেলার তারকা। বড় নেতা বলতে যা বোঝায় ছেলেবেলায় জানে আলম ভাইকে দেখে তা বুঝেছি। বুঝতাম তিনি আওয়ামীপন্থী হলেও তথাকথিত আওয়ামীলীগার নন। তিনি সমাজতন্ত্রী, তিনি বাকশালপন্থী। অর্থাৎ বুর্জোয়া ঘরানার রাজনীতির বলয়ে থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে স্বতন্ত্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন সাংগঠনিকভাবে এবং একইসাথে মননে ও পঠনে, চর্চায় ও চর্যায়। তাঁর গুছানো কথা বলা আর অসাধারণ বক্তৃতা আমি আমার বাল্যকাল থেকে শুনে শুনে বড় হয়েছি।
জানে আলম ভাইয়ের নেতৃত্বে নুরুল হুদা, আলী আজমসহ তৎকালের অনেক তরুণ তুর্কী স্বপ্নবাজ মানুষ ১৯৮০ সালের দিকে ‘শেখ মুজিব গণ পাঠাগার’ নামে কাটগড়ের এক পাশে মুসলিমাবাদে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছিলো। সেটি আইয়ুব আলী বাটলারের ভাড়ার ঘরে দুইটি কক্ষ নিয়ে শুরু হয়েছিলো। তখন নামে বেনামে সামরিক শাসন চলছিলো। প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা যেমন বন্ধ তেমন সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথও রুদ্ধ। সেই সময় আমি জানে আলম ভাইদের সাথে ক্ষুদে কর্মি হিসাবে শেখ মুজিব গণপাঠাগারের সাথে সংযুক্ত হই। সেই পাঠাগারের সূত্র ধরেই আমার পঠন-পাঠনের ধারা শুরু হয়েছিলো। অবশ্য এক্ষেত্রে আমার আব্বা ইঞ্জিনিয়ার এস.এম.এ বারীর প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও অনুপ্রেরণা ছিলো। যা হোক, পরবর্তীতে এক সময় সেই লাইব্রেরীর একটি চাবিও আমি সংরক্ষণ করি এবং খোলা আর বন্ধ করার দায়িত্বও পালন করি। একটা পর্যায়ে লাইব্রেরীটি বন্ধ হয়ে যায়। খুব দামি বইয়ের র‌্যাক ছিলো, দামি দামি বই ছিলো। সেগুলো কোথায় গেলো সেই হদিস আর পাইনি।
আমার আব্বা ইঞ্জিনিয়ার এস.এম.এ বারীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। আব্বার সাথে আমিও ছিলাম। পরবর্তীতে ৬দিন পর আমাদের ছেড়ে দেয়। আমার আব্বা সরাসরি যুদ্ধ করেননি। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম ভাই বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখতেন এবং আমার আব্বাকে খুবই সম্মান করতেন। ফলে আমার আব্বা ও আমাদের সকলের সাথে তাঁর এবং তাঁর ভাইদের একটি আত্মিক ও পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো যা আমৃত্যু রয়ে গেছে।
জানে আলম ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় আশির দশকের শেষের দিকে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় জানে আলম ভাই বাকশালের সাধারণ সম্পাদক। নামকরা জননেতা। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি। আমি চট্টগ্রাম জেলা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। সেই সময় প্রতিদিনের আন্দোলন সংগ্রামে জানে আলম ভাইয়ের ভূমিকা ও অনুপ্রেরণা আমাকে অসীম সাহসী করে তুলেছিলো। আমার মনে আছে পতেঙ্গায় ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন প্রগতিশীল চেতনার মানুষ তৈরী হলে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর সাথে অজস্‌্র কথোপকথন, আলোচনা, বিতর্ক সেই ছেলেবেলা থেকেই হয়ে আসছে। আশ্চর্য, তিনি খানিকটা আওয়ামীপন্থী আর আমি মার্ঙবাদী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে কখনো কোন বিষয়ে দ্বিমত হয়নি। অথচ তাঁর সহোদর যারা আওয়ামীলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সাথে অনেক ক্ষেত্রে মত ও চিন্তার অমিল হয়েছে। তথাপিও আমরা সকলে প্রগতিশীল ও সাম্যের এক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সময় ও জীবনকে নিবেদন করেছিলাম।
১৯৮৮ সালে আমরা পতেঙ্গায় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমি, মহসিন, প্রয়াত নাসির উদ্দিন শামীম, মাজহারুল আলম তিতুমির, সওগাতুল আনোয়ার খান, শাজাহান সিরাজ সাজু, মোতাহার হোসেন সোহেল, ইস্কান্দার আলী, বিবেকানন্দ, সাধন, উত্তম, আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করি। তখন আমরা জানে আলম ভাইয়ের পরামর্শ গ্রহণ করি। তিনিই আমাদেরকে পরামর্শ দেন অধ্যাপক হরিশংকর জলদাসকে সভাপতি করার জন্য। সকল দলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তোলার জন্য। সেইভাবে অধ্যাপক হরিশংকর জলদাসকে সভাপতি, মো. মহসিনকে সম্পাদক ও আমাকে নির্বাহী সম্পাদক করে ১৯৮৯ সালে সুচয়ন সাংস্কৃতিক সংসদ যাত্রা শুরু করে। সুচয়ন সাংস্কৃতিক সংসদ নামটি দেন ইস্টার্ন রিফাইনারি মডেল হাই স্কুলের বাংলার সিনিয়র শিক্ষিকা মিসেস চিত্রা বিশ্বাস।
জানে আলম ভাইয়ের সাথে আমার থেকেও আমার প্রয়াত ছোট ভাই নাসির উদ্দিন শামীমের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ভালো ছিলো। তিনি আমাদের ঘরে আসলে আগে শামীমকে খোঁজ করতেন। তিনি যখন নির্বাচন করেছিলেন শামীম তাঁর সকল নির্বাচনী কাজ করেছিলো। আমাদের ঘর থেকেই তাঁর পোস্টার ও প্রচারণার অনেক কাজ সম্পন্ন করা হয়েছি। কাটগড়ে বা পতেঙ্গায় আশি ও নব্বই দশকের সেই এক আশ্চর্য সময় ছিলো। আমরা তখন তরুণ আর আমাদের সম্মুখ কাতারে জানে আলম ভাই, হরিশংকর জলদাসের মতো অনেক আদর্শবান মানুষ। সকলের মধ্যে কীযে মমতা আর পারস্পরিক সহযোগিতা ছিলো তা এখন শুধুই স্মৃতি। জানে আলম ভাই ও শামীম মিলে সুচয়ন থেকে ১৯৯০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিয়েছিলো। আমরা সকলে মিলে আজিজ উদ্যান পুনরুদ্ধার করেছিলাম। যদিও বর্তমানে তা আবারও বেদখল হয়ে গেছে। কিছু রাজনৈতিক দল অফিস করেছে। সে যাই হোক একটা সময়তো ছিলো যখন সেখানে প্রগতিশীল চেতনার বীজ বপন করা হয়েছিলো।
আমার এখনো মনে পড়ে, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় ও তার পরে আমাদের পতেঙ্গার মানুষের পারস্পরিক যে ভালবাসা ও মায়া-মমতা তা বোধকরি পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষ যেন বা একাকার হয়ে গিয়েছিলো। অনেক রাজনৈতিক দল রাজনীতির কারণে নানা সাহায্য সহযোগিতা করেছিলো। আমরা পতেঙ্গার বাসিন্দারা কিন্তু দলমত নির্বিশেষে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করেছি। সেই স্মৃতিগুলো কখনো ভোলার নয় । আর এসব ক্ষেত্রে এলাকায় যারা রাজনীতি করতেন ও বিশেষত জানে আলম ভাইদের মতো বড় নেতাদের এক অসাধারণ ভূমিকা ছিলো। ঘূণিঝড়ের পর আমাদের সকল ত্রাণ তৎপরতায় তাঁর আশ্চর্য নেতৃত্বের স্মৃতি এখনো আমার কাছে উজ্জ্বল। তিনি সকলকে নেতা বানানোর জন্য অসাধারণ সব তৎপরতা ও উৎসাহ সৃষ্টি করতেন। এমন মানুষ এখন আর কোথায় পাওয়া যাবে?
জানে আলম ভাইয়ের সাথে অজস্র সভা সমাবেশে যাওয়ার ও বক্তৃতা দেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর অসাধারণ বক্তৃতাগুলো এখনো যেন আমার কানে বাজছে। তাঁর পঠন-পাঠন এবং ডিভোশন অনন্য ছিলো। তিনি অন্যান্য অনেক নেতার মতো মুখস্থ ও তোষামোদি বক্তৃতা কখনো দিতেন না। তিনি বলতেন তাঁর অন্তর্গত বিশ্বাস থেকে। তিনি বলতেন, তাঁর সততা ও প্রচেষ্টা থেকে। তিনি বলতেন , তাঁর নিজস্ব সত্যবোধ থেকে। ফলে তাঁর বক্তৃতা শুধুমাত্র গতানুগতিক ভাষণ ছিলো না, ছিলো মানুষকে আন্দোলিত ও রূপান্তর করার অসাধারাণ মন্ত্র। তিনি পন্থায় আওয়ামীলীগার হলেও সততা ও সত্যবাদীতার ক্ষেত্রে অন্যান্যদের থেকে অনন্য এক নেতা। তিনি ছিলেন সাম্যবাদী, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিকামী একজন ব্যক্তিত্ব।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বা তথাকথিত আওয়ামীলীগারদের দেখেছি মুক্তিযুদ্ধেও চেতনার প্রশ্নে আপোষ করতে। সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যকার চেতনামূলক বিষয়াদি অনেকের মাঝেই নেই। আবার মূল গণতন্ত্রেও চেতনার কথাও যদি বিবেচনা করি তবে সেক্ষেত্রেও অনেকের সীমাবদ্ধতা দেখতে পাই। অনেকে স্বাধীনতাবিরোধী জামাত শিবির চক্রের সাথেও সখ্য রেখে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যেতে দেখেছি। কিন্তু জানে আলম ভাই এসব থেকে মুক্ত ছিলেন। যদিও তিনি গণফোরামের সাথে শেষ পর্যন্ত সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। তিনি একজন আপাদমস্তক আমৃত্যু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর যুদ্ধ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য। সেই যুদ্ধটি তিনি আমৃত্যু সততার সাথে করেছেন বলেই আমি বোধ করি।
জানে আলম ভাই জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি শ্রমিক রাজনীতিও করেছেন। শ্রমিকদের জন্য তাঁর লড়াই সংগ্রাম আমি জানি। তিনি শ্রমিকদের মামলা যেমন লড়েছেন তেমনি হাজারো শ্রমিক সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেছেন। তিনি শ্রমিকদেরকে নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। আমি যখন সাংবাদিক ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত হলাম নব্বই এর দশকের শেষ দিকে তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন আমি হোয়াইট কালারের শ্রমিক রাজনীতিতে টিকতে পারবো কি না। আমি দীর্ঘ দুই যুগের বেশী শ্রমিকদের এই রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছি। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি বারে বারে। আমার এই দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে জানে আলম ভাই, তপন’দা, সফর আলী ভাই, এ.এস.এম নাজিম উদ্দিন ভাইসহ সকল বড় শ্রমিক নেতার সাহচর্য, সহযোগিতা ও ভালবাসা পেয়েছি প্রকৃতপক্ষে সাধারণ রাজনীতির তুলনীয় শ্রমিক রাজনীতি অনেক বেশি দুরূহ ও কঠিন। আমি নিজে সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আর জানে আলম ভাইয়েরা তো আরো ব্যাপক পরিসরে শ্রমিক আন্দোলন করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ও তিক্ততা আর সংগ্রাম অনেক অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। জানে আলম ভাইয়ের সাথে বিলস্‌, শ্রমিক ফোরাম, আইএলও ইত্যাদিসহ নানা ফোরামে কাজ করেছি। শ্রমিক রাজনীতিতে এমন নিবেদিতপ্রাণ শ্রমিক নেতা ভবিষ্যতে আমরা আর পাবো কিনা সে সন্দেহ আমার আছে। এমন ত্যাগী ও সংগ্রামী শ্রমিক নেতা আমি দু’চারজন ছাড়া আর দেখিনি।
জানে আলম ভাইয়ের মৃত্যু আমার জন্য ভয়াবহ শোকার্ত এক ঘটনা। তাঁর করোনা হওয়ার আগের সপ্তাহেও আমরা বিলসের একটি অনুষ্ঠানে একসাথে ছিলাম, বক্তব্যও রেখেছি। তিনি যেদিন মৃত্যুবরণ করেন, সেদিনও আরেকটি অনুষ্ঠানে একসাথে যাওয়ার কথা ছিল। পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেছিলেন, আমাদের জানে আলম ভাই পরপারে চলে গেলেন। পতেঙ্গায় গেলে কিংবা শ্রমিক সমাবেশে অথবা রাজনীতির মঞ্চে তাঁর সাথে আর দেখা হবেনা। এটা ভাবতেই মনটা হু হু করে কেঁদে উঠে। বিদায় জানে আলম ভাই, বিদায় কমরেড…
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসফলতার জন্য চাই অদম্য সাহস
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণ : স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রবক্তা শহীদ স্বপন চৌধুরী