ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় গত মাস খানেক ধরে একটি সংবাদ নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছে। সংবাদটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিসেম্বরে ২০২১এ অনুষ্ঠিতব্য ডেমোক্রেসি কনফারেন্সে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো নিয়ে, সরকারি দল ও বিরোধী দল পরস্পরকে ঘায়েল করার জন্য অনেক বক্তব্য দিচ্ছে। আসলে ঘটনাটা কী? এই কনফারেন্সের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী?
গণতন্ত্র সম্মেলন গত এক দশক ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কোপেনহেগেনে গত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, গণতন্ত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণ হচ্ছে গত ২ যুগ ধরে পৃথিবীর বহু দেশে গণতন্ত্র সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আমেরিকায় ও বুশের আমল থেকে গণতন্ত্র সঠিক পথে চলছে না বলে মনে করা হয়। আবার গণতন্ত্র বলতে শুধু ভোটার-নির্বাচন নয়, আরো কিছু সমন্বয়ে আজকের গণতন্ত্র এটা অনেকেই ভুলতে বসেছে। তাই জাতিসংঘ পনেরোই সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে। আমাদের দেশে জাতিসংঘের অনেক দিবস পালিত হয়। যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস, প্রবীণ দিবস, গণতন্ত্র দিবস এর খবর কয়জনে রাখে? না বিরোধী দল না সরকারি দল? গণতন্ত্রের চর্চাকারী যে দেশগুলো আমাদের মডেল ছিল বিগত শতবর্ষে তার শীর্ষে ছিল আমেরিকা দুর্ভাগ্যক্রমে জুনিয়র সময় থেকে মার্কিন দেশে গণতন্ত্র পদে পদে ধাক্কা খেতে থাকে। ট্রাম্পের আমলে গণতন্ত্র, সুশাসন, বর্ণবাদ, মানবাধিকার সব সূচকে সমস্যা দেখা দেয়। বিপুল সংখ্যক মানুষকে ট্রাম্প সারাবিশ্ব ও সভ্য সমাজ অনুমোদন করে না এমন সব উত্তেজক ভাষণে উত্তেজিত করে তোলে। ফলে শুধু আমেরিকা নয় গোটা বিশ্বে গণতন্ত্রের অনন্য অনুষঙ্গ গুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে মানুষ যখন সত্যকথন বলতে গেলে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সম্মুখিন হতে থাকে তখন মার্কিন মুলুকের নামি দৈনিক ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনামের নিচে এক অদ্ভুত লোগো জুড়ে দেয়, যা ছিল- Democracy dics in darkness- অর্থাৎ ভুতুড়ে ঘরে গণতন্ত্রের মৃত্যু। মার্কিন think-tank ও পাশ্চাত্য বিশ্বের মানুষকে এই লোগো দারুণভাবে নতুন করে গণতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে ভাবিয়ে তোলে।
আধুনিক গণতন্ত্রের উদ্ভব বলা হয় ফরাসি বিপ্লবের পর। গ্রিসের গণতন্ত্র প্রাচীন সময়ের। আধুনিক গণতন্ত্রের উদ্ভব হয় রাজা-বাদশা ও অভিজাতদের বদলে রাষ্ট্র পরিচালনায় আমজনতার স্বার্থের প্রতিফলনের আশায়। ২৫০ বছর পর দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেতো বটেই খোদ আমেরিকাতেও আমজনতা গণতন্ত্রের সুফল ভোগ না করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি ভোগ করছে। অর্থাৎ গণতন্ত্রে আবারও বিশেষ শ্রেণির কব্জায়। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুই ১৭৪৮ সালে বলেছিলেন মানুষের কল্যাণ ও সুশাসনের জন্য কোনো রাজার বা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর (Oligrach) অত্যাচার থেকেও বেশী ক্ষতিকর হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের গণতন্ত্রের প্রতি উদাসীন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন যেন গণতন্ত্রের দুর্ভোগ মেনেই নিয়েছে। এক ধরনের হতাশা গোটা বিশ্বকে আবদ্ধ করে রেখেছে। এরই প্রেক্ষাপটে নতুন করে শুরু হয়েছে গণতন্ত্র কনফারেন্স বা ডেমোক্রেসি কনফারেন্স।
এখানে উল্লেখ্য যে মিলেনিয়াম গোল যেমন কতগুলো সূচক এর সমষ্টি কেবল মাথাপিছু আয়ই যথেষ্ট নয়। তেমনি গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন আর ভোটদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অভাব ভোটদান, সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রেস স্বাধীনতা, দুর্নীতি, বিরোধী মতামত এর প্রতি সহনশীলতা এসব বিষয় এর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দেশের র‌্যাঙ্কিং করা হয়।
আমেরিকায় ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য গণতান্ত্রিক সম্মেলনে ১১০টি দেশ আমন্ত্রিত। উপরের সূচকগুলোর ভিত্তিতে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত পাকিস্তান ও নেপালকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আফগানিস্তান বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা আমন্ত্রণ পায়নি। ফেব্রুয়ারি ২১ এ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন গণতন্ত্র আচমকা আসেনা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হয়, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হয়, নিরন্তর গণতন্ত্রের দৃশ্যমান ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে হয়। আমেরিকান গণতন্ত্রের জনক আব্রাহাম লিংকনের পর গণতন্ত্র সম্বন্ধে বাইডনের এই উক্তিটা কে মহামূল্যবান মনে করা হয়।
বিশ্বব্যাপী সম্মেলনের প্রাক সময়ে বিভিন্ন সরকার, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে ভার্চুয়াল আলাপ এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূচকগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্মেলনের তিনটি প্রধান বিষয় হচ্ছে:
১. স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্র রক্ষা,
২. অপশাসন, দুর্নীতি স্বীকার ও প্রতিকারের পদক্ষেপ.
৩. মানবাধিকার সংরক্ষণ।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর উপর গণতন্ত্র সম্মেলনে আলোচনা হবে।
সংগত কারণে চায়না, রাশিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল ইসরাইল ও ইরাক আমন্ত্রিত।
গত ১২ (বার) বছরে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্র চর্চার অধো:গতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ৩৫ টি দেশে গণতন্ত্রের সূচকের উন্নতি হলেও ৭১ টি দেশে ক্রমঅবনতি ঘটেছে। শীতল যুদ্ধের অবসানের পর মানুষ মনে করেছিল একনায়কত্ব ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে গণতন্ত্র খোদ চীন, রাশিয়া, আমেরিকা সহ বহু দেশে হুমকিতে আছে।
গণতন্ত্র ছাড়া, পরমত সহিষ্ণুতা ও Inclusive রাজনীতি ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না, না আমেরিকা-ইউরোপে না অন্য কোন দেশে। সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয় গণতন্ত্র ও তার অনুষঙ্গ বিহীন সমাজে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উগ্রবাদের উত্থান ঘটে। ইউরোপে, আমেরিকায় নব্য ডানপন্থী, নব্য ফ্যাসিবাদ, নব্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর উত্থান গণতন্ত্রের সংগ্রামকে অতি প্রয়োজনীয় করে তুলেছে। দেখা যাক এবারের সম্মেলনে বিশ্বগোষ্ঠী কী বার্তা দেয়।
লেখক ; চিকিৎসক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রবক্তা শহীদ স্বপন চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় আ. লীগের মনোনয়ন পেলেন না বর্তমান চার চেয়ারম্যান