স্বপ্নধূসর মেঘ

নাসের রহমান | শুক্রবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ

মেয়েটি চেরাগী পাহাড়ে এসে দাঁড়ায়। পাহাড় কোথায়? সে পাহাড় খুঁজে পায় না। অনেক আগে ছিল হয়তো। এখন আর নেই। চিহ্ন যেটুকু আছে তাকে পাহাড় বলা যায় না। তবুও লোকজন জায়গাটাকে চেরাগী পাহাড়ের মোড় বলে। বহুকাল আগে পীর দরবেশরা এ-পাহাড়ে এসে চেরাগবাতির আলো জ্বালিয়ে জিনপরিদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে পাহাড়টির নাম চেরাগী পাহাড়। মেয়েটি এদিক-ওদিক তাকায়। কিছুটা পশ্চিম-দক্ষিণদিকে উঁচা পাহাড়ের মতো দেখায়। তবে সেটার নাম ভিন্ন। সবাই ডিসি হিল বলে। তাহলে চেরাগী পাহাড় কোথায় গেল? হয়তো বিলীন হয়ে গিয়েছে। এসব নিয়ে তার ভাবনার কী দরকার! এমনিতে অনেকে তাকে পাগল মনে করে। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ আবার পাগল ভাবতে পারে। হেঁটে যাওয়ার সময় অনেকে তার দিকে আড়চোখে তাকায়। কেউ কেউ কথা বলতে চায়। সে একটু ছাড় দিলে কাছে এসে দাঁড়াবে। এরকম সুযোগ মেয়েটি কাউকে দিতে চায় না।
সে হাঁটতে শুরু করে। উত্তরদিকে রাস্তা ধরে হাঁটে। তার মনে হয় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। একটু থমকে দাঁড়ায়। পেছনের দিকে তাকায়। চেরাগী পাহাড়ের চিহ্নটুকু বেশ উঁচু মনে হয়। এবার সে মনে করতে পারে, এখানে একসময়ে পাহাড় ছিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে লোকজন নিচের দিকে নেমে আসতো। রাস্তা হয়েছে, আশেপাশে দালানকোঠা গড়ে উঠেছে। এমন সব বহুতল ভবন যেগুলো পাহাড়ের চেয়ে অনেক উঁচু। চেনার উপায় নেই। কিন্তু পাহাড়ের ঢাল পুরাপুরি বিলীন করতে পারেনি। প্রশস্ত রাস্তা, দুপাশে ফুটপাত। সে হাঁটতে হাঁটতে লিচুবাগানের কাছে এসে যায়। একটিও লিচুগাছ নেই। কেউ কখনো দেখেছে কি না তাও বলতে পারে না। তবুও জায়গাটিকে লিচুবাগান বলে। তবে একসময় নামটি আর থাকবে না।
প্রেসক্লাবের সামনে এসে সে আবার দাঁড়িয়ে যায়। এটা সাংবাদিকদের ক্লাব। সাংবাদিকরা অবসর সময়ে ক্লাবে এসে বসে। গল্পগুজব করে সময় কাটায়। টুকিটাকি খেলাধুলারও ব্যবস্থা আছে। ক্লাবের সামনে ফুটপাত জুড়ে সবসময় লোকজন থাকে। ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে দাবিদাওয়ার কথা জানায়। কোনো কোনো সময় সামনের রাস্তাও ব্লক হয়ে যায়। নানান পেশার লোকজন জড়ো হতে থাকে। এখানে এসে বললে সাংবাদিকরা ওদের কথা পত্রিকায় লিখবে। ব্যানারসহ সবার ছবি তোলে। সবার ছবির সাথে মেয়েটির ছবিও উঠে যায়। তার তো কেনো দাবি নেই। তার ছবি কেন পত্রিকায় ছাপাবে সে ভেবে পায় না। তবে গ্রামের লোকজন কখনো এখানে এসে জড়ো হতে পারে না। এদের দাবির কথা কাউকে বলা যায় না।
জামাল খান গোল চত্বরে এসে মেয়েটি আর এগুতে পারে না। অনেক বড় শোভাযাত্রা। তরুণ তরুণীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। সবাই যেন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে অনেকে উল্লাসে মেতে উঠছে। কিসের এত আনন্দ? মেয়েরা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সাফ গেমে নেপালকে হারিয়ে ট্রফি জিতে নিয়ে এসেছে। এ গৌরব কোথায় রাখবে? তাই রাস্তায় নেমে এসেছে। আনন্দে মেতে উঠেছে। মেয়েটিরও খুব ইচ্ছা করছে ওদের সাথে আনন্দফুর্তি করতে। মেয়েদের এরকম সাফল্য আগে কখনো আসেনি। শোভাযাত্রায় কখন সে ঢুকে পড়ে টের পায় না। সবার মতো সেও আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। শোভাযাত্রা এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না। এগিয়ে চলে। সে কিন্তু বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারে না। থেমে যায়।
সে গোল চত্বরের দিকে ফিরে আসে আবার। অনেকদিন এভাবে আনন্দ উল্লাস করেনি। হঠাৎ লাফালাফি করতে গিয়ে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে আবার ঠিক হয়ে যাবে। সে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে। গোল চত্বর পার হয়ে খাস্তগীর স্কুলের কাছে এসে দাঁড়ায়। তখন স্কুল ছুটি হয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে মেয়েরা স্কুল থেকে বের হয়ে আসছে। গেইটের সামনে অনেক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে এসেছে। তাদের চোখেমুখে অনেক স্বপ্ন। স্কুলড্রেসে সবাইকে একইরকম লাগছে। এরকম প্রাণবন্ত কিশোরীরাও কেন আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে বুঝতে পারে না। কিসের এত অভিমান তাদের! সুন্দর এ-পৃথিবীর মায়া এত সহজে কী করে ছাড়তে পারে? মেয়েটি অবাক নয়নে তাদের দিকে তাকায়।
এসময়ে তার অজপাড়া গাঁয়ের কিশোরী মেয়েটির চেহারাটি ভেসে উঠে। যে পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে যেতে পারেনি। আগের দিন স্কুল থেকে প্রবেশপত্র আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। কয়েকজন মিলে অসহায় মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ফেলে চলে যায়। এত জঘন্য অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। প্রমাণ করতে হয় ধর্ষিতাকে। সহপাঠিরা যখন হলে গিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে তখন কিশোরী মেয়েটিকে পুলিশ পাহারায় সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। বাবা রিকশাচালক আর মা বাসায় বুয়ার কাজ করে। মেয়েকে এসএসসি পাশ করাতে চেয়েছিল। লেখাপড়া শিখাতে চেয়েছিল। মা বাবা আর মেয়ের স্বপ্ন কীভাবে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। শুধু কি স্বপ্ন ধুলার সাথে মিশিয়ে গিয়েছে? কিশোরী মেয়েটির জীবনটাও দুর্বিষহ করে ধূলির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। এ অসহায় কিশোরীর কথা কে ভাববে? তার কথা কে বলবে? সে যা হারিয়েছে তা কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে? এরকম নানা প্রশ্ন মেয়েটির মাথায় এসে ভিড় করে। এসবের উত্তর কারো কাছে নেই। সে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলে।
সেন্ট মেরীস স্কুলের পাশে এসে সে আবার থমকে দাঁড়ায়। বড় বড় মনীষীদের ছবি দেখে হা করে তাকায়। বঙ্গবন্ধুর ছবিটা কে না চেনে। তবে ছবির মানুষটাকে কতটুকু চিনে তা বলা যায় না। চিনলে এত বিরোধ থাকতো না। অন্তত তাঁর প্রশ্নে সবাই এক থাকতো। পরের ছবিটাকেও সবাই চিনে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অনেকে বলে রবিঠাকুর। সত্যিই তিনি বাংলার রবি। তাঁর কবিতা আর গান শোনেনি এমন কেউ নেই। এর পরের ছবিটা কাজী নজরুল ইসলামের। সবাই কবি নজরুল বলে। সবার প্রিয় কবি। জাতীয় কবিও তিনি। মেয়েটি স্কুলে পড়ার সময় এদের কবিতা পড়েছে। এখনো কবিতার প্রথম দশ লাইন মুখস্থ বলতে পারে। নামাজের সময় সুরা-কেরাত যেভাবে না ভেবে বলা যায় এসব কবিতাও সেরকম যেন মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছে। কোনোমতে আর সরে না। দেয়ালে একের পর এক বরেণ্য জনের ছবি দেখে সে এগিয়ে যায়। কাউকে চিনে আবার কাউকে চিনতে পারে না।
এবার সে বেগম রোকেয়ার ছবির কাছে এসে দাঁড়ায়। পাঠ্যবইয়ে পড়েছে বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের অগ্রদূত। সবাই মহিয়সী রমণী বলে জানে। ছোটবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ের বই পড়তো। কোনোদিন স্কুলে যেতে পারেনি। তারপরও লেখাপড়া শিখেছে। মেয়েদের জাগিয়ে তুলেছে। সকল বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছে। সমাজের লাঞ্ছনা গঞ্জনা কোনো কিছুই থামাতে পারেনি। এখানে এসে মেয়েটির ক্লান্তি কোথায় উড়ে যায়। এদিক-ওদিক তাকায়। যেদিকে তাকায় উঁচু উঁচু পাহাড় আর বহুতল ভবন। একটু আগে সে পাহাড় খুঁজেছে। চেরাগী পাহাড়। খুঁজে পায়নি। এখন যেদিকে তাকায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সবুজ পত্রপল্লবে শোভিত পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কত ইমারত গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের চুড়ায় স্কুলকলেজও গড়ে উঠেছে। উঁচু উঁচু গাছপালাঘেরা এসব ভবনে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। গাছের ডালে ডালে পাখিরা গান গায়। সে অনেক দিন থেকে পাখিদের গান শুনতে পায়নি। যানবাহনের শব্দে কি গান শুনা যায়? পাহাড় থেকে আকাশের মেঘ ভারী সুন্দর দেখায়। ধূসর মেঘেরা পাহাড়ের চুড়ায় ভেসে বেড়ায়। কখনো পাহাড়ের কোল ঘেঁসে দূর অজানায় পাড়ি জমায়। আহা কত অপুর্ব সে দৃশ্য! কতদিন দেখা হয়নি। তার ইচ্ছা পাহাড়ে উঠার, পাখিদের গান শুনার, আকাশে মেঘ দেখার। যে করে হোক পাহাড়ে উঠবে সে। তার মনে এখন অনেক শক্তি। বেগম রোকেয়ার শক্তি তাকে অনেক সাহসী করে তুলেছে। সে পাহাড়ে উঠতে চায়, আবার স্কুল-কলেজে যেতে চায়। কিন্তু পথ খুঁজে পায় না। চারিদিকে দেয়াল আর দেয়াল। ইটের দেয়াল, পাথরের দেয়াল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুঁশিয়ারি রাশিয়ার
পরবর্তী নিবন্ধময়ুখ চৌধুরীর কবিতা