ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা

কবিতা পাঠের আনন্দ

করিম রেজা | শুক্রবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২২ at ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ

সমসাময়িক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি ময়ুখ চৌধুরী। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, জীবন-জগতের নানামুখী প্রশ্ন, বৈজ্ঞানিক কৌতূহল, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা উঠে এসেছে। যার প্রত্যেকটির ওপর ভিন্ন ভিন্নভাবে বিশদ আলোচনা করা সম্ভব। বিষয়ের এই প্রকরণগত বৈচিত্র্যের পাশাপাশি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার নান্দনিক সৌন্দর্যও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এখানে পাঠকচিত্তে আনন্দসঞ্চারী কবিতাগুলোর কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করব।
সাহিত্যের একটি অনুপম শিল্পমাধ্যম হলো কবিতা। পাঠক আনন্দরসের আকর্ষণে কবিতা পাঠ করে। দর্শন এবং বিজ্ঞানচর্চার মূল মাধ্যম কবিতা নয়। তবে দর্শন ও বিজ্ঞানের আনন্দ উপলব্ধির উপলক্ষ হতে পারে কবিতা। শিল্পসফল কবিতাগুলোতে সাধারণত বিস্ময়কর বর্ণনাভঙ্গি, অর্থের বহুমুখিনতা, উপমার চমক আর ভাবনার প্ররোচনা- এসবের কোনো না কোনো অনুষঙ্গের উপস্থিতি থাকে। এসবের অনুপস্থিতিতে কবিতা আর কবিতা থাকে না। নিরস গদ্যে পর্যবসিত হয়। ছন্দময়তার প্রশ্নও থাকে এর পাশাপাশি। তবে গদ্যকবিতার গতিশীলতা ধ্রুপদী তিন ছন্দের ছকবদ্ধ সীমারেখাকে ক্ষেত্রবিশেষে ছাপিয়ে গিয়েছে।
বিস্ময়কর বর্ণনাভঙ্গির কথা বলছিলাম। তেমন একটি দৃষ্টান্ত তুলে আনি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা থেকে। কালো বরফের প্রতিবেশী কাব্যের একজন ফিরে আসে কবিতা থেকে এই উদ্ধৃতি:
কুসুমেতে কীট থাকে, বিষ থাকে রঙিন গেলাশে
মর্মান্তিক খাদ থাকে স্বর্ণ আর নারীর ভেতর।
কেবল মাটির পাত্রে পিপাসার ঘুম নেমে আসে।

কতোকাল ধরে একজন
পুঁটলি চেপেধরা এক ট্রেনের যাত্রীর মতো প্রতারণা বক্ষে চেপে আছে
মিথের প্রতারিত আইহণ গোয়ালাকে কাব্যকলার সুষমায় কবি বর্ণনা করেছেন কালো বরফের প্রতিবেশী কাব্যের আইহণ গোয়ালা কবিতায়। এটি প্রতারিত পুরুষদের শাশ্বত বেদনার লিরিক:
ঘামে ভেজা দিন ছিলো, সাঁতারের চেষ্টা ছিলো রাতে
উর্বর জমির জন্যে স্বপ্নবীজ অন্তরে অন্তরে।
মানুষের শস্যক্ষেত্র বৃষ্টিহীন ষড়যন্ত্রে কাঁপে,
মেঘের আড়াল থেকে বিদ্যুতের ফণা ঢোকে ঘরে।

মোহন বাঁশির সুরে প্রতারিত লৌকিক জীবন,
লবণাক্ত বান ঢোকে কৃষিক্ষেত্রে মাটির চুলায়।
সিঁদুরের অন্ধ কৌটো গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়
বেপাড়ার বেলফুলে, বেলাশেষে পথের ধূলায়।
প্রেমের হাহাকারের আরেকটি কবিতা অর্ধেক রয়েছি জলে, অর্ধেক জালে কাব্যের ‘এখন আমি’ কবিতাটি। প্রেমিক আর গৃহী- নির্বিশেষ সকলের ভালো লাগবে এই কবিতার পাঠ:
এখন আমি
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে-থাকা সুন্দরীদের মন খুঁজি না,
কালোচুলে লুকিয়ে যাবার বন খুঁজি না;
গোলাপফুলের পাপড়ি দুটি কম হলো কার ঠোঁটে গিয়ে
এসব খবর আর রাখি না।
প্রেমে পরাজিতদের সান্ত্বনামূলক চমক ধাধানো একটি কবিতা প্যারিসের নীলরুটি কাব্যের ‘আরেক হেলেন, আরেক নেপোলিয়ন’ কবিতাটি। ওয়াটার লু’র যুদ্ধের পরাজিত সেনানায়ককে পৃথিবীবাসী মনে রেখেছে। জয়ীকে কেউ মনে রাখেনি। সুতারাং সব পরাজয়ে গ্লানি নেই:
ওয়াটার লু’র যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিল;
জিতেছিলো কে?
সমস্ত পৃথিবী পরাজিতের নামটাই মনে রেখেছে।
আমিও
তোমার প্রেমে হেরে গিয়েছিলাম।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার একটি অধ্যায়জুড়ে আছে প্রকৃতি আর উদ্ভিদ নিয়ে কাব্যসম্ভার। এসব কবিতায় প্রকৃতিবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাকে তিনি কাব্যিক লালিত্য দিয়ে নির্মাণ করেছেন। চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহীন কাব্যের ‘ক্যাকটাসের কথা’ এমন একটি কবিতা:
কখনো হয়তো ভুলে শিশিরের ঘামটুকু ছুঁতে চেয়েছিলে
তাই বলে এইভাবে সবটুকু সজলতা প্রত্যাহার করা!
সরে যেতে চাও? -যেতে পারো,
যেভাবে শরীর যায় পায়ের পাতার ছবি এঁকে
যেভাবে শরীর যায় ঘ্রাণ ফেলে মগজের কোষে।
জীবন ও জগতের জিজ্ঞাসামূলক কবিতাতেও আছে নির্মাণের অনুপম সৌন্দর্য। জীবনব্যাপী মানুষের নিরন্তর ছুটে চলাকে কাব্যালঙ্কারে কবি সাজিয়েছেন কালো বরফের প্রতিবেশী কাব্যের ‘বরফ-মানুষ’ কবিতায়:
শীতার্ত লোকটা ছোটে জোনাকী ও চুরুটের আলো দেখে-দেখে
আলো নয়, চাই তার আগুন, এখন তার আগুন-পিপাসা।
সেঁকবে দু’হাত আর পায়ের অসাড় তালু,
ঘষে ঘষে তাপ নেবে, ভাপ দেবে শীতদগ্ধ গালে।

লোকটা আর নেই, চলে গেছে;
রেখে গেছে আগুনের পাশে তার টুপি,
দস্তানা, ওভার কোট, মোজা আর ফিতে-ঢিল জুতো।
ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যে গদ্যকবিতার পাশাপাশি ছন্দরীতির কবিতাও বিরল নয়। পায়ে ছন্দের বেড়ি থাকলেও এসব কবিতায় কাব্যরসের কমতি হয়নি। স্বরবৃত্ত তাল লয়ের সর্বাঙ্গিন সুন্দর একটি রাজনৈতিক কবিতা মিছিল, তুমি বাম দিকে যাও (জারুলতলার কাব্য)। এই কবিতাটি সাম্যবাদী রাজনৈতিক মঞ্চে মুহুর্মুহু উচ্চারিত হওয়ার মতো একটি কবিতা। সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত কবিতাটি ৪+৪+৪+২ পর্ব বিভাজনে নির্মিত। কয়েকটি পঙক্তি লক্ষ্য করুন:
ডান দিকে নয়, ডান দিকে নয়, বাম দিকেতে যাও;
বাম দিকে যাও কাস্তে কোদাল লোহিত পালের নাও।
ডান দিকে সব রক্তচোষা বাদুড় ঝুলে আছে,
বাম দিকে ঐ মুক্তি নাচে শিমুলপলাশ গাছে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের একটি কবিতা ‘বালিশে মাথা’ রেখে। কবিতাটি অর্ধেক রয়েছি জলে, অর্ধেক জালে কাব্যের অন্তর্ভূক্ত। প্রতি পঙক্তিতে ১৪ মাত্রা। পর্ব বিভাজন ৭+৭।
বালিশে মাথা রেখে তোমাকে মনে পড়ে
কখনো থেকে থেকে বালিশে মাথা রেখে
তোমকে মনে পড়ে তোমাকে মনে পড়ে
বিছানা-কুসুমেরা কাঁটাতে ভরে যায়
সাপিনী শ্বাস ফেলে এ ফণিমনসায়
ভাঙবে বুঝি ঘর গহন কালো ঝড়ে
তোমাকে মনে পড়ে
পুরান ঢাকার ভাষায় এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ময়ুখ চৌধুরীর লেখা দুটি কবিতা দৃষ্টিগোচর হয়। প্রথমটি হলো ‘ক্যাঙ্গারুর বুক পকেট’ কাব্যের ট্রাক-দুর্ঘটনা এবং দ্বিতীয়টি ‘পিরামিড সংসার’ কাব্যের মরিয়মের কিস্তা। ‘ট্রাক-দুর্ঘটনা’ কবিতায় ‘প্রেম কইরা আমরাভি জান দিতে পারি’- এই পঙক্তি থেকে বোঝা যায় ভাষাটি পুরান ঢাকার। কয়েকটি পঙক্তি এমন:
আর না, বহুত হইছে, সহ্যেরও একটা সীমা আছে
ইস্টিশানে গিয়া আইজ পেট ভইরা মাল টানছি আমি
হেডলাইটের পাশে আমার ব্যক্তিগত লাল চক্ষু দেইখাও
বানচোত হারামজাদা বুঝতেই পারলো না
কী করতে যাইতেছি আমি
তবে আগাগোড়া কবিতায় পুরান ঢাকার ভাষা প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশ পায়নি। কবিতাটির কাব্যিক বিন্যাস অনুপম। পুরান ঢাকার ভাষায় সর্বোত শিল্পসফল কবিতা লিখেছিলেন শামসুর রাহমান। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা ‘মরিয়মের কিস্তা’ (‘পিরামিড সংসার) কবিতাটিও পাঠককে অভিভূত করে।
কী কয় জানসনি অডি, পুন্নিমার কালে
চাঁদের ওলান ধরি দুধ খাইতে মনে কয় তার!
বাইজ্জা খোদা, এ কী কথা, -এখনো মনত আছে আঁর।
ফাসারা কথার বোঁদা লই হামিশ্‌ক্ষণ হাঁডে,
আঁরে দেখিলে খালি পইরর কচুরিপানা ঘাঁডে।
কবিতাটিতে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ পুরোপুরি সফল হয়নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ক এবং খ এর ব্যবহার বিরল। এই দুটি বর্ণের স্থলে ‘হ’ এর ব্যবহার হয় বেশি। কবি এই দিকটির প্রতি লক্ষ রাখলে কবিতাটি আরো প্রঞ্জল হতে পারতো।
কবিতার জন্মই হলো আনন্দের জন্য। সেই আনন্দের রকমফের থাকতে পারে; থাকতে পারে দৃষ্টিভঙ্গির তফাত। সংবাদ প্রতিবেদন আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য আছে। সংবাদ প্রতিবেদনে যা পাওয়া যায় তা-ই যদি কবিতায় বিন্যস্ত হয় তাহলে পাঠক ধৈর্যক্ষয় করে কবিতা পাঠ করতে যাবেন কেন? কবিতার শব্দে চাই অভিধান ছাড়িয়ে যাওয়া অর্থের হাতছানি। চাই ফণা হয়ে শিহরণ জাগানো উপমা আর ভাষার বয়ান। ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় কমতি নেই এসব বিস্ময়ের। ভাবীকালে তিনি বাংলা কবিতাকে আরও সমৃদ্ধ করবেন, এটাই কাব্যমোদীদের প্রত্যাশা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নধূসর মেঘ
পরবর্তী নিবন্ধবায়েজিদ বোস্তামী থানায় ওপেন হাউস ডে