আজ ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এ দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছে, তার নজির ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু সেই নয় মাসের নৃশংসতা ছাপিয়ে গেছে যে মর্মান্তিক ঘটনা, তা হলো বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা রাতের অন্ধকারে লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-চিকিৎসক-সাংবাদিক-প্রকৌশলীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। যদিও ২৫ মার্চের কালরাত থেকেই অন্যদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরাও হত্যার শিকার হয়ে আসছিলেন। আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা সেই মহান সন্তানদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
এখনো পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা, তাঁদের বিষয়ে সুস্পষ্ট তালিকা নেই। যদিও অতি সম্প্রতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করতে ১১ সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি করেছে সরকার। গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। তালিকা যাচাই-বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানাসহ এই কমিটিকে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটি মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের মধ্যে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে। বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকার কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্য যাচাই বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করবেন তারা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সারা দেশে যে ভয়ংকর গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ, দেশত্যাগ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে আর লাখ লাখ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেসবের ওপর নানা ধরনের গবেষণাও হয়েছে। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি গবেষকরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রবন্ধও প্রকাশ করেছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে এসব দলিলের তথ্যও কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও ইতিহাসগুলো বিশ্লেষণ করে সঠিক তথ্য সংযোজন করা দরকার।
আমরা প্রায় প্রতিবছর এমন দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করি। কিন্তু যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদের বছরের একটি দিন স্মরণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাঁদের শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে, নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে কেন তাঁরা জীবন দিয়েছেন। এবছর সরকারের পক্ষ থেকে একটা ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এদিন দেশের সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করতে বলা হয়েছে। দিবসটির ইতিহাস ও তাৎপর্য তুলে ধরতে এদিন অনলাইনে বা যেখানে সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এছাড়া দিবসটির সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন বাস্তাবায়ন কমিটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে এসব সুপারিশ করেছে। তা আমলে নিয়ে সব স্কুল-কলেজে দিবসটি উদযাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। একই সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ১০০ দিনের কুইজ প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, এসব সুপরিশ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন বাস্তাবায়ন কমিটি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছিল। এতে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দিতে বলা হয়।
বিলম্বে হলেও এই বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ ঘাতকের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত করে লালন করে দেশ পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ বলে বুদ্ধিজীবীদের প্রদর্শিত পথে পরিচালিত হতে চায়। এক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশকে তাঁদের অনুসৃত পথেই চালিত করতে হবে।