‘যুক্ত করো হে সবার সাথে মুক্ত করো হে বন্ধ’

সর্বজনীন দুর্গা পূজায় প্রত্যাশা

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বৃহস্পতিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

দুর্গাপূজা বাঙ্গালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এটি কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, তা বাঙ্গালীর সামাজিক উৎসবও বটে। পূজা হিন্দুদের কিন্তু উৎসব সবার। দুর্গা পূজা দুর্গতি নাশিনী মা দুর্গা দেবীর সাথে সাথে প্রকৃতিরও পূজা। শরৎকালে বাংলাদেশের যে সমস্ত জিনিস পাওয়া যায় তার সবই দুর্গা পূজার আবশ্যকীয় উপকরণ। দুর্গাপূজা একান্নবর্তী পরিবার প্রথার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এতে দুর্গাকে বাঙ্গালী ঘরের মেয়ে হিসেবে আরাধনা করা হয়। এই উৎসবে কন্যাস্থানীয় দেবী দুর্গা সপরিবারে তিনদিনের জন্য হিমালয়ের কৈলাস থেকে পিত্রালয়ে আগমন করেন। তিনি সাথে আনেন তাঁর চার সন্তানকে । দুর্গা প্রতিমার ডানপাশে লক্ষ্মী, গণেশ, এবং বাম পাশে সরস্বতী, কার্তিক। তাদের মধ্যে লক্ষ্মী বৈশ্যদের প্রতীক, গণেশ শুদ্রদের প্রতীক, সরস্বতী ব্রাক্ষ্লণদের প্রতীক ও কার্তিক ক্ষত্রিয়দের প্রতীক। আর মাঝে আদ্যশক্তি মহামায়া। এভাবে মা দুর্গার সপরিবারের মূর্তি সমাজের চারবর্ণের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে। মহালয়ায় দেবীকে আবাহন করে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী পালনের মাধমে পূজার পরিসমাপ্তি হয়।
দুর্গাপূজা সবার সাথে যুক্ত হবার অনুসঙ্গ। দুর্গাপূজার উৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালি যুক্ত হয়। সকলের অংশ গ্রহণে দুগাপুজার প্রাঙ্গন হয়ে উঠে সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলা। দুর্গাপূজা বন্ধন মুক্তিরও অনুসঙ্গ ইতিহাসে দেখা যায়, সর্বাজনীন দুর্গাপূজা অনুষ্টানের শুরু ১৯০৫ সাল থেকে। অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রহিত আন্দোলনের প্রাক্কালে। তার আগ পর্যন্ত দুর্গাপূজা ছিল বিত্তবান বাঙ্গালি হিন্দুর পারিবারিক ধর্মীয় উৎসব। বঙ্গভঙ্গ রহিত আন্দোলনকে উপলক্ষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে এই পূজায় যুক্ত করতে উদ্যোগী হন। তিনি ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের দিন দুর্গাপূজা উপলক্ষে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। বাঙ্গালি জাতীয়তাবোধের চেতনায় হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে যুক্ত করে বৃটিশ শাসকদের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহবান জানান। সর্বস্তরের বাঙালী এই মিছিলে শরিক হয়। এতে বৃটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠে।্‌ এই ১৯০৫ সালের বিজয়া সম্মিলনি অনুষ্ঠানে কবিগুরু উদাত্ত আহবান জানান, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য হউক, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক হে ভগবান…. বাঙালির প্রাণ, বাঙ্গালির মন, বাঙ্গালির ঘরে যত ভাইবোন এক হোক এক হোক এক হোক হে ভগবান’।
দুর্গতি নাশিনী দুর্গা মুক্তি সংগ্রামের আলোক বর্তিকা। দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশকে নিয়ে কবিগুরুর এই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণ আন্দোলনে এবং তার অনেক পরে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাঙ্গালি পরস্পর যুক্ত হয়েছিল। বাঙ্গালি একতা বদ্ধ হয়ে পাকিস্থানের বন্ধন মুক্ত হয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। তবে দুভার্গ্যজনক হলেও সত্যি আমাদের এই অন্যান্য সাধারণ প্রাপ্তি পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে ব্যাহত হয়ে পড়ে। হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে বাঙালিত্বের মহান চেতনাকে বিভিন্নভাবে খন্ডিত করা হয়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর সংবিধানের চার নীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জিত হয়। শুরু হয় রাজনৈতিতে ধর্মের অপব্যবহার। বাঙ্গালির জাতীয়তা- বোধের উপর চরম আঘাতটি আসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী তথা রাষ্ট্রধর্ম আইন প্রর্বতনের মাধ্যমে। তার প্রতিবাদে ১৯৮৫ সালে সারাদেশে দুর্গাপুজা প্রতিমার পরিবর্তে ঘটপূজা হিসাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকে দুগাপুজা আবার আপামর বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়।
এবার নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো কোভিড মহামারিতে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। হিন্দুশাস্ত্রমতে, এবার দূর্গা দেবীর ঘোটকে আগমন; (ফলংঃ ছত্রভঙ্গস্তরঙ্গমে) এবং দোলায় গমন; (ফলং: দোলায়াং মরকং ভবেত)। অথ্যাৎ দেবীর আগমন ও গমন উভয়ই চলমান কোভিড সৃষ্ঠ ভোগান্তি ও মৃত্যুকে নির্দেশ করে। ইতিমধ্যে এই কোডিডে আমরা আমাদের অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি। এখনো অনেকে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কোভিড থেকে আত্মরক্ষায় আমরা এখনো সামাজিকভাবে অনেকটা বিছিন্ন হয়ে রয়েছি। আমরা দীর্ঘ ১ বছর ৮ মাস বিভিন্নভাবে বন্ধ অবস্থায় কাটিয়েছি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পরে ধীর ধীর খুলছে। তাই এবারের দুর্গাপূজায় আমাদের প্রত্যাশা কোভিড থেকে আমাদের প্রিয় স্বদেশ তথা সারা বিশ্বের পরিত্রাণ। চলমান কোভিড ভ্যাকসিন কার্যক্রম ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে কোভিড প্রতিরোধ করে আমরা আবার দূর্গাপুজার উৎসবে সামিল হই। আমরা যুক্ত হই সবার সাথে; আমরা মুক্ত হই বন্ধ থেকে। এতদিন কোভিট সৃষ্ট পরিস্থিতি আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আমাদের জীবনকে ছন্দহীন করে তুলেছে। সেই প্রাণের ছন্দ সেই জীবনের ছন্দ আবার ফিরে আসুক। দুর্গা দেবীর কাছে আমাদের সম্মিলিত নিবেদন তিনি আমাদের সকল কর্মে ছন্দ ফিরে আসুন। কবিগুরুর ‘পূজা প্রার্থনা’ এর মত আমদেরও প্রার্থনা হোক-‘যুক্ত করো হে সবার সাথে, মুক্ত করো হে বন্ধ, সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।’ সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
লেখক : প্রফেসর ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের সাম্পান : ঐতিহ্যে ও গানে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল