চট্টগ্রামের সাম্পান : ঐতিহ্যে ও গানে

বাসুদেব খাস্তগীর | বৃহস্পতিবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ


চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলীর সাথে জড়িয়ে আছে আরেকটি নাম সাম্পান। এই সাম্পান চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করে রেখে পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যে। এক সময় এ চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালিত হতো সাম্পানকে ঘিরে। কর্ণফুলীর এপাড় থেকে ওপাড়ে পার হতেই সাম্পানই ছিলে ভরসা। মাছ ধরার জন্য সাম্পান এখনও অপরিহার্য জলযান। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক মানুষ যাতায়াতের মাধ্যম হিসাবে সাম্পান ব্যবহার করতো। শহরে চাকুরি করে সপ্তাহান্তে বাড়ি যেত মানুষ সাম্পানে চড়ে। চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা সন্দ্বীপ হাতিয়াসহ নানা জায়গায় ব্যবসায় কার্য পরিচালনা করতো সাম্পানের মাধ্যমেই। জাহাজ থেকে নিরাপদে কূলে ভিড়তেই সাম্পানের সৃষ্টি। এ রকম কাঠামোর সাম্পান আর কোথাও চোখে পড়ে না। প্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগে সেতু নির্মাণ হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। সাম্পানের সেই আগের ব্যবহার এখন আর নেই। কিন্তু ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসাবে সাম্পান চট্টগ্রামে বিশেষ একটি স্থান দখল করে আছে। এই সাম্পানকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে কবিতা গল্প গান কত রূপকথা। সেজন্য চট্টগ্রামের এই সাম্পান শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল উপজীব্য হিসাবে এসেছে বারবার। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের লেখায়, কণ্ঠে ও তুলির আঁচড়ে সাম্পান চিত্রায়িত হয়েছে নানাভাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চমৎকার যে লোগোটি আমরা দেখি এটি শিল্পী কামরুল হাসানের তৈরি, যিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইনারও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধূসর রং এর লোগোটির আকৃতি অনেকটা কুলার মত হলেও এটি হলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পানের সামনের দিকের অবয়বে তৈরি করা। সাম্পানের পশ্চাদপদ গলুই এর অংশটি নিয়ে লোগোটি গঠিত। সাম্পানের গঠন কাঠামো অনুসারে লোগেটি তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক একাডেমি, চাটগাঁ ভাষা পরিষদের মনোগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চট্টগ্রামের ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক সাম্পানের ব্যবহার দেখা যায়। সাম্পান চট্টগ্রামের কবিতা ছড়ায় যেমন করে দ্যুতি ছড়িয়েছে তেমনি করে গীতিকবিদের কথায়, শিল্পীর কণ্ঠেও প্রাণময় হয়ে ধরা দিয়েছে। এই সাম্পান কর্ণফুলী নদীর ঐতিহ্য। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, পল্লীগীতি কিংবা ভাটিয়ালি ঘরানার গানে সাম্পান উঠে এসেছে বারবার। সাম্পান মাঝির গল্প যেন এক রূপকথারই গল্প। এই সাম্পানওয়ালারা ছিলো একসময় কত রমণীর স্বপ্নপুরুষ। সাম্পান চলতে চলতে, ঘাটে ভিড়তে ভিড়তে কত রমণীর সাথে সাম্পানওয়ালার প্রেম হয়েছে সেই গল্পকথায় হয়তো কিছুটা বাস্তবতা আছে, কিছুটা হয়তো কাল্পনিক গল্পগাথাও আছে। কিন্তু সেই কাহিনি রচিত হয়ে নানা ধরনের গান হয়েছে, যেগুলো চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্যেরই অংশ হয়ে উঠেছে। সাম্পান নিয়ে গানের কথা আসলেই সংগীতজ্ঞ মোহনলাল দাশ রচিত ও শেফালী ঘোষের কণ্ঠে গাওয়া অনেকটা ফোক পল্লীগীতির ঢঙে রচিত ‘ ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি করলি দেওয়ানা’ গানটির কথা প্রথমেই আসে। চট্টগ্রামের সাম্পান নিয়ে গানের ইতিহাসে এই গান একটি মাইলফলক। এই গানের থিম নিয়ে পরবর্তীতে ‘সাম্পানওয়ালা’ নামে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মধ্যে মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি’ গানটি অনন্য এক সংযোজন। সেই গানেও সাম্পানের কথা এসেছে চমৎকারভাবে। যেমন ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি ফানি/ লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যার গৈ কর্ণফুলী/এক কূলদি শহর বন্দর নগর হত আছে/আর এক কূলত সবুজ রুয়ার মাতাত সোনালী ধান হাসে/ হালদা ফাডা গান হুনাইয়ারে সাম্পান যারে গৈ পাল তুলি/লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যার গৈ কর্ণফুলী। সাম্পানের সাথে ‘ক্যাঁ কোরত’ এ দুটো শব্দ যেন সমার্থক । এ দুটো শব্দ শুনলেই আমরা বলতে পারি এটি সাম্পান চলার শব্দ। সাম্পানটি যখন চালানো হয় তখন এ দুটো শব্দ ‘ক্যা কোরত’ উচ্চারিত হয়। বহুদূর এর শব্দ থেকে শোনা যায়। বিশেষ করে রাতের বেলায় ‘ক্যাঁ কোরত’ শব্দ শুনে অতি সহজে মানুষ বুঝে নিতো কোথাও সাম্পান চলছে। এ শব্দ শুনেই মানুষ ঘাটে অপেক্ষা করতো সাম্পানের জন্য। এই ‘ক্যাঁ কোরত’ শব্দ নিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় গান রচিত হয়েছে। ‘সাম্পানওয়ালা ক্যাঁ কোরত, কেনে যাইয়ুম বববুরত। বববুর জামাই থিয়াই রইয়ে ঘাঁটার দুয়ারত।’ অর্থাৎ ভাইজান তার বোনের বাড়ি কেমনে যাবে সাম্পান চলার শব্দে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। ‘রঙিলা মাঝিরে এ ঘাটঅদি সাম্পান ভিড়াইও।’ গ্রামের একজন অবলা নারীর আকুতি প্রকাশ পেয়েছে গানের কথায়। ঘাটে সাম্পান ভিড়ানোর জন্য এ আকুতি গ্রামের নারীর খুব সাধারণ একটি আহবান, যা শুনে সাধারণ মানুষেরও মন ছুঁয়ে যায়। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে সাম্পান আর আগের মত নদী পার হতে ব্যবহার হচ্ছে না। কারণ প্রযুক্তি অনেক কিছুকে পিছিয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিন নৌকা আসার পর সাম্পানের গুরুত্ব অনেকটাই কমে যাছে। এমন বাস্তবতায়ও সাম্পান নিয়ে গান লেখা হয়েছে, ‘সাম্পান মাঝি সাম্পান বায় আগের মত প্যাসিনজার ন পায়।’ অর্থাৎ সাম্পান মাঝিরা আগের মত যাত্রী পারাপারের জন্য যাত্রী পায় না। এখন এ সব সাম্পান মাঝিদের এখন বড়ই দুর্দিন। তবু এখনও বাপ-দাদার দিনের পুরানো পেশা সাম্পান বাওয়া অনেকেই ধরে রেখেছেন। সাম্পান শুধুই ঐতিহ্য নয়, আমাদের চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্যের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে চট্টগ্রাম কর্ণফুলী ও সাম্পান যেন একাত্ম হয়ে শিল্প সাহিত্যে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা। এখানে গানের কথায় নানাভাবে সাম্পান এসেছে এবং শিল্পীর কণ্ঠে রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে এ ধরনের গান যুগের পর যুগ। আমাদের চট্টগ্রামের গানের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধই করেছে এই সাম্পান। তেমন কিছু গান এখানে উল্লেখ করতে পারি। যেমন -১.‘ওরে কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা/ তোঁয়ার মুখখান কেয়া গইরজো কালা/ কন দুঃখে তোঁয়ার মননান বেজার আঁরে কইবা নি’ ২.বাশঁখালী মইশখালী পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই চলে/ তোরা কনকন যাবি আঁর সাম্পানে/ কর্ণফুলীর মাঝি আঁই নিয়ুম ভাটি উজানে’ ৩. ‘কি গান মাঝি শুনাইলো/কি বাঁশি মাঝি বাজাইলো কর্ণফুলী সাম্পাওয়ালা আমার মন কাড়ি নিলো ’ ৪.‘ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে/ অভাগিনীর দুঃখর কথা কঅবি বন্ধুরে/হক্কল সমত আইসতো যাইতো সাম্পাননান চালাই /এ ঘাট ঐ ঘাট ঘুইরতো বন্ধু ভাটিয়ালি গায়/ কদিন ন দেখির তারে/ আঁই মন দিলাম যারে’ ৫. ‘পালে কি রং লাগাইলো রে মাঝি সাম্পানে কি রং লাগাইলো’ ৬.‘আঁর খাল কূলত বাড়ি, বন্ধু মন গইরলো চুরি, রাইতে রাইতে আইসতো বন্ধু সাম্পানত গরি’ ৭.‘চাঁদ মুখে মধুর হাসি, ও ভাই চাঁদ মুখে মধুর হাসি, দেওয়াইল্যা বানাইলো মোরে সাম্পানর মাঝি’ ৮. ওরে রসিক মাঝি ভাই, আঁর তে পয়সা কড়ি নাই, তোঁয়ার সাম্পানত তুলি নঅ না আঁরে রে কিংবা দ্বৈত কণ্ঠের গান ৯. মহিলার কণ্ঠে-‘গইরার কূলর সাম্পানওয়ালা আঁররে নিবা না/দিত ন পাইরজুম তোঁয়ার কোন সাম্পানর ভাড়া/ পয়সা ছাড়া নিবা না পুরুষ কণ্ঠে-তোঁয়ার মত সুন্দর মাইয়া যাইতে নাই মানা/পয়সার বদল একখান জিনিস চাইলে দিবা না’ ১০. পুরুষ কণ্ঠে- ‘কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা পার গড়রাই দঅ না রে/ জি আন চাইবা দিওয়ুম তোঁয়ারে, ও মাঝিরে/ পুরুষ কণ্ঠে- ‘রিজার্ভ তোঁয়ারে পার গরাইয়ুম, কী দিবা কঅনা রে। খাড়াও না নৌকার উহরে, ও সখীরে।’ এ গানগুলোর প্রতিটি গানের কথায় সাম্পানের কথা উঠে এসেছে, সাথে এসেছে সাম্পান মাঝিদের সাথে গ্রামের অবলা নারীর মন মাতানো প্রেমের কথাও। গানের কথায় প্রেম, আকুতি, আনন্দ, বেদনা, হাসি-কান্নার অনুভূতিগুলো কী দারুণভাবে আমাদের মনোজগতকে দোলা দেয়। সাম্পান যেন এখানে শক্তিশালী এক উপাদান যা ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে কবির মনকে সৃষ্টির অপার জগতে নিয়ে যায়। এভাবে সাম্পান চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্যে একটি অনিবার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। শেফালী ঘোষের কণ্ঠে ‘বাহার মারি যারগই সাম্পান কিবা ভাটি কি বা উজান, বন্ধু বিনে পরান মানে না রে’, সঞ্জিত আচার্যের কণ্ঠে ‘কিয়র আশায় সাম্পান চালাই কিও নঅ জানে’, কল্যাণী ঘোষের কণ্ঠে ‘ময়ূরপঙ্খী সাম্পান তোঁয়ার চলে বাহার মারি পালে কি রং লাগাই আঁর মন নিলা কাড়ি’ কিংবা কান্তা নন্দীর কণ্ঠে ‘ হক্কল সমত আইসতো যাইতো সাম্পান নান চালাই /এ ঘাট ঐ ঘাট ঘুইরতো বন্ধু ভাটিয়ালি গায়’ গানের কলিগুলো যখন শুনি তখন মনে হয় সাম্পান চট্টগ্রামের শুধু একটি পারাপারের যানই নয়, এটি যেন রোমান্টিকতা সৃষ্টির জাদুকরী এক সম্মোহনী শক্তি। যার আবেদন শিল্প সাহিত্যে ছড়িয়ে রচিত হচ্ছে বৈচিত্রময় সৃষ্টিশীল কর্ম। তাই সাম্পান চট্টগ্রাম লোকজ সংস্কৃতির অনিবার্য এক নাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকান্ত ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধ‘যুক্ত করো হে সবার সাথে মুক্ত করো হে বন্ধ’