১৯৪৬ সালে উপন্যাসোপম বড় গল্প মফিজন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে তাঁর প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বাঙালি মুসলিম নারীদের নিয়ে এমন লেখা কখনো এর আগে কেউ পড়েনি। তবে খুব কম পাঠক সেসময় তৈরি ছিলেন মফিজনের জন্য। রাতারাতি বিতর্ক তৈরি হলো এ-লেখা নিয়ে। অশ্লীল বলা হলো মফিজনকে। ‘অগত্যা’ নামের একটি পত্রিকা বিদ্রুপ করে লিখেছিল, ‘এই গল্পে জিনিস আছে। ২৮ পৃষ্ঠার গল্প যে এত বীভৎস, এত যড়ৎৎরনষব হতে পারে মফিজন পড়ার আগে সে জ্ঞান ছিল না।’
গল্পের লেখক সাহিত্যিক মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮-১৯৮১) ছিলেন বাঙালি মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ। ‘মোমেনের জবানবন্দী’ (১৯৪৬) তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি।
১৯৬৪ সালে প্রকাশিত মফিজনের একটি সংস্করণের ভূমিকায় মাহবুব-উল আলম অনেক খেদ নিয়ে লিখেছেন, ‘মফিজন-এর অনেক প্রতিকূল সমালোচনা হয়েছে। অল্পসংখ্যক শিল্প-রসিকের মত: এইটি একটি অনবদ্য শ্রেষ্ঠ রচনা, অধিক-সংখ্যক পাঠকের রায় রচনাটি অশ্লীল। তবে মফিজনকে কেহ ভুলিতে পারেন না। কারণ, ইহার শক্তিকে অস্বীকার করা যায় না।’
সত্যিই কি ‘মফিজন’ অশ্লীল? অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, আবুল ফজল ও সুফিয়া কামালসহ অনেকেই এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। মফিজন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক কাহিনিটুকু।
ছবিরন, মফিজন-ছবি ও মফি দুই বোন। ছবি বড়, মফি ছোট। ‘ছবির রং ময়লা, শরীর মাংসল। মফির রঙের খোলতা খুব, অথচ কৃশাঙ্গী।’ মক্তবে পড়ার সময় দুই বোনের দেখা হয় মক্তবের শিক্ষিকার দৌহিত্র (নাতি) মামুদের সঙ্গে। ছুটিতে বেড়াতে আসা মামুদ মেয়েদের মক্তবে পড়তে এসে সহজ হতে পারে না। তবে তার লজ্জা ভাঙায় মফিজন। এরপর মফিজন আর মামুদ পুকুর পাড় আর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে নিজেদের জগৎ রচনা করে নিল। সেখানে মফিজন বক্তা, মামুদ শ্রোতা। মফি নদী, মামুদ তার ডুবুরি। কিন্তু একদিন স্কুল খুলে গেল, মামুদেরও ছুটি শেষ। আর ঠিক তখনই গল্পের মফিজনও যেন বালিকা থেকে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়ে ওঠে। ‘চোখে চোখ রাখিয়া উভয়ে বুঝিতে পারিল, এই অবস্থা অসহ্য। ইহার সমাপ্তির জন্য কিছু একটা ঘটা চাই। তখন মফি করিল চোখ নত, আর মামুদ আগাইয়া গিয়া তার কপালে করিল চুম্বন। এবার হাসি-চোখে মফি করিল মামুদের ওষ্ঠে চুম্বন। মফিজনের জীবনে এভাবে প্রেম আসে।’
ওষ্ঠে চুম্বনের স্মৃতি নিয়ে সে বেড়ে উঠতে থাকে। ছবি ও মফির বাবা ওয়াজুদ্দীন শেখ পাটের দালালি করে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। পুঁথি পড়তেন বলে লোকে তাকে পণ্ডিত নামেও ডাকত। টাকা-পয়সা হলেও ‘শরিফ’ হিসেবে তখনো নাম হয়নি পণ্ডিতের। তার ছেলে নেই। বড় মেয়ে ছবিরনের জন্য তাই ভালো শিক্ষিত এক পাত্রের সন্ধান করলেন তিনি। তেমনি এক পাত্র মফিজনের বাল্যের প্রেমিক মামুদ। ছবির সঙ্গে মামুদের বিয়ের মধ্য দিয়ে মফিজনের ট্র্যাজেডির যেন শুরু।
ছবির সুখের শুরু, আর মফির দুঃখের। পাটের ব্যবসায় হঠাৎ লোকসানে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ল মফির বাবা ওয়াজুদ্দীন শেখ। ঠিক তখন বার্মাপ্রবাসী ব্যবসায়ী বকশু টাকা নিয়ে এগিয়ে এল। বয়স্ক বর বকশু বিয়ের রাতে জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে চলে যায় আকিয়াব। এরপর মফিজন শ্বশুরবাড়িতে থেকেছে দীর্ঘকাল কিন্তু কখনো ফিরে আসেনি স্বামী। ফিরে আসার আগেই অপঘাতে মৃত্যু হয় তার।
শ্বশুরবাড়িতে থাকতে থাকতে নিঃসঙ্গ মফিজনের সঙ্গী হয়ে ওঠে বালক খোকা। স্বামীর কাছে পদবন্দী চিঠি লিখে মফিজন গ্রামে পরিচিতি পেয়েছে। তার কাছে রাজ্যের পুঁথি। খোকাকে সেসব থেকে পড়ে শোনাত সে। পুঁথি পড়া চলে, সময় গড়ায়। ধীরে ধীরে চোখ ফুটতে থাকে খোকার। খোকা যেন পড়ার জন্য পুঁথি ছাড়াও আরেকটি বই পেয়ে যায়। ‘ক্রমে মফির দেহ হইয়া ওঠে খোকার দ্বিতীয় পাঠ। কিন্তু, সেটা লুকোচুরির মধ্য দিয়া। শীঘ্র মফি ঘুমাইয়া পড়ে, অর্থাৎ চোখ বোজে। তখন খোকা পুঁথি লক্ষ করিয়া উন্মুখ হইয়া বসে।’ মফিজন খোকার এই কৌতূহল উপভোগ করে। এই প্রথম সে আবিষ্কার করে তার সৌন্দর্যও মুগ্ধ করতে পারে কাউকে। হোক না সে বালক।
কিন্তু বকশুর মৃত্যু সংবাদ আসার পর শাশুড়িও মারা গেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে মফিজনের পাঠ উঠে যায়। অতীত হয়ে যায় খোকা। মফিজনের বিয়ে হয়ে যায় নছিপুরের পির সৈয়দ বোরহানুদ্দীনের সঙ্গে। নতুন শ্বশুরবাড়িতে সবাই খোলসে ঢাকা। এমনকি তার স্বামীও। অধিক রাতে স্বামী পিরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসত।
‘যেমন করিয়া বাঘ নখর দিয়া তার শিকারকে ফালা ফালা করে, ঠিক তেমনি মফিকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে লাগল তার স্বামী।’ কিন্তু এরপরও বেঁচে থাকে মফিজন। কীভাবে? লেখক তার ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। ‘ইহার পরও মফি রহিল স্থির, অবিকম্প আর জাগ্রত। চোখে অঙ্গুলি ফুটানোর ন্যায় তাহার যন্ত্রণা প্রতি অঙ্গে। কিন্তু নিজে যন্ত্রণার কথা সে ভাবিতেছিল না। মৃত্যুর চর্বণের মধ্যে পড়িয়াও গুণিয়া গুণিয়া তাহার দাঁত দেখিবে, মফি এমন মেয়ে।’
মফিজনকে অশ্লীল বলার অন্যতম একটা কারণ বোধ হয়, এই গল্পে প্রথমবারের মতো খোলামেলাভাবে বাঙালি মুসলিম নারীর প্রেমানুভূতি ও শরীরী আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সে সঙ্গে প্রথা ও সংস্কারের ভেতরে পড়ে মফিজন যে সারাজীবন প্রেমবঞ্চিত রয়ে গেল তারই মর্মস্পর্শী বিবরণ এই কাহিনি।
অন্নদাশঙ্কর রায় ‘মফিজন’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সত্য তার অনাবৃত রূপ নিয়ে নিজের সৌন্দর্যের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফরাসি নারীবাদী লেখিকা সিমোন দা বোভোয়া বলেছিলেন, নারী হয়ে কেউ জন্মায় না। বরং সমাজ একজনকে ধীরে ধীরে নারী করে তোলে। ‘মফিজন’ গল্পে মফিজনের পরিণতি তেমনই হয়েছিল। তাকে সংবেদনশীল মানুষ থেকে ধীরে ধীরে নারী হয়ে উঠতে হয়েছিল।