অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দরকার। কিন্তু সেই সম্পর্ক হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। প্রতিবেশীর সঙ্গে পারস্পরিক সমান সম্মান এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। গতকাল রোববার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে যে নতুন স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা থেকে দূরে সরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ভুল ধরিয়ে দিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। বেলা ১১টা থেকে সভা চলে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। সভায় মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে কথা বলেন এবং খোঁজখবর নেন। খবর বাসস ও বিডিনিউজের।
সভায় বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের নিজ চিন্তায় অনড় থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যে যত পরামর্শ দেয়, এটা থেকে বেরিয়ে আসো, সে পরামর্শ তোমরা গ্রহণ করো না। তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ, সঠিক। এটা মুঠো থেকে ছাড়বে না। যদি আমরা এ স্বপ্ন থেকে দূরে সরার কোনো কাজ করি, স্মরণ করিয়ে দেবে। আমাদের কারও কোনো ইচ্ছা নেই এ স্বপ্ন থেকে বাইরে যাওয়ার, এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা আমাদের সার্বক্ষণিক কাজ। ভুলক্রমে আমরা যদি সীমা অতিক্রম করি তাহলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জানাবে–এ শপথ নিয়ে আমরা সবাই একত্র হলাম। যারা আজকে উপস্থিত হতে পারে নাই, তাদের জানিয়ে দিও, আমরা একযোগে, এক সঙ্গে এ কাজে নামলাম। এটাকে সফল করব।
ক্ষমতাচ্যুতদের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এতদিন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে এরা স্বপ্নের মধ্যে ছিল, স্বপ্ন দেখছিল, আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে তাদের ঘুম ভাঙে। তারা কি চুপচাপ বসে থাকবে? খুব চেষ্টা করবে তোমাদেরকে আবার দুঃস্বপ্নে ফিরিয়ে নিতে, শান্তিতে তাদের আবার রাজত্ব চালাতে। তাদের চেষ্টার ত্রুটি করবে না। কাজেই যে কাজ শুরু করেছ, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের জন্ম থেকে ৫৩ বছরে এ সুযোগ আর আসে নাই। যে সুযোগ তোমরা আমাদের দিয়েছ, এ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ থাকবে না। এটা কোনো রাষ্ট্র আর থাকবে না। এটা যেন শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দুনিয়ার মানুষ তোমাদের কাছে শিখতে আসবে, তোমাদের নিয়ে যাবে, বলবে কী মন্ত্র দিয়ে এটা করেছ? এ মন্ত্রটা তারা শিখতে আসবে। সে মন্ত্রটা তোমরাও টের পাচ্ছ না, এটা কীভাবে আসল? কিন্তু একটা বিরাট মন্ত্র তোমরা আবিষ্কার করেছ, সেটাকে ধরে রাখবে। এ মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায় তাহলে আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সেই দুঃখ যেন আমাদের দেখতে না হয়।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আহতদের হাসপাতালে দেখে আসার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। যখন হাসপাতালে তাদের দেখার জন্য যাই, তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এইরকমভাবে কীভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দিকে পা চলে গেছে, ওইদিকে…’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ইউনূস।
আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বলল, ফুটফুটে একটা ছেলে, ‘স্যার আমি সারাজীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম, ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন আমার পা কেটে ফেলেছে’। ওই পা রাখার উপায় ছিল না। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘স্যার ক্রিকেট খেলব কী করে’। ক্রিকেট তার মাথা থেকে যাচ্ছে না, পা নাই। যতবার দেখি ততবার মনে প্রশ্ন জাগে, এই বাংলাদেশ আমরা বানিয়েছি যে, এতগুলো তাজা প্রাণ, তাদেরকে চলে যেতে হয়েছে। আমরা যারা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাদের একমাত্র দায়িত্ব তাদের এই ত্যাগ, এই জীবনের বিনিময়ে তারা আমাদের এখানে বসার সুযোগ দিয়েছে, তারা না গেলে আমরা আজকে এখানে বসতে পারতাম না, সবাই আমরা সরকারের মধ্যে বসেছে… কেউই একই ভূমিকায় আসতে পারতাম না।
ড. ইউনূস বলেন, কালকে একটা হাসপাতালে গেলাম, আবার সেই দৃশ্য, কচি কচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নাই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য; এঙরে দেখাচ্ছে ওখানে দাগ। ছোট ছোট ফুটো করা, আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে কী দেখাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কী! এতগুলো গুলি তার শরীরে রয়ে গেছে! সে বেঁচে আছে! যতবার দেখি, যতবার শুনি আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয় যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করব। এটার থেকে আমাদের বেরিয়ে যাবার উপায় নাই। আমাদের যোগ্যতা না থাকতে পারে, ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইল, আমরা এটা করব। এই যে দৃশ্য দেখলাম, এটা তো সবাই দেখছে না, যারা হাসপাতালে আসছে তারা দেখছে, প্রতিদিনের ঘটনা। মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে এর পেছনে কী ছিল।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারও সভায় উপস্থিত ছিলেন।