পাহাড়ের কোলে প্রসূনজিতের বাড়ি। সরকারি চাকুরে। আগামি বছর অবসরে যাবেন। এক ছেলে। তার বিয়ে দিয়েছে গত বছর। বউমা ভালো মেয়ে, মিষ্টি, ফর্সা। আদুরে চেহারা। ইংরেজিতে মাস্টার্স করে একটি ইশকুলে শিক্ষকতা করছে।
প্রসূনজিতের বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। বাড়ির পেছনে তাল- সুপুরির গাছ। আকাশ উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি আম-লিচুর গাছ। মৌসুমে আমলিচুতে গাছ ভরে যায়। দারুণ, মিষ্টি।
সুস্মিতা বাড়ির গিন্নি। তাঁর কথায় পরিবার চলে। সুস্মিতা সুন্দরী,- সবাই বলে। আবার ধর্মানুরাগি। দুখি মানুষের পাশে ছুটে যায়। সামাজিকতায় তাঁর যথেষ্ট সুনাম।
বাড়ির পূরবি কাজের দ্বিতীয় জন। প্রথম জন বিজয়া। দু’জনের ঝগড়া হয়। এক বিছানায় শোয়। কথা বলে না কেউ। বিজয়া ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ ধরে রাখে। সকালে উঠে। বাড়ির সবার সকালের নাস্তা একাই তৈরি করে। একটু পরে প্রসূনজিত উঠে। ড্রইংরুম থেকে অতিথি রুম পর্যন্ত চল্লিশ মিনিট দৌঁড়াবে। ডায়াবেটিকস রুগী প্রসূনজিত।
সুস্মিতার কড়া কথা, সকালে হাঁটবে। ডাইবেটিকস রুগীর প্রথম অষুধ এটা। বউয়ের কথা শোনে প্রসূন। বউকে খুব ভালোবাসে সে।
একদিন সুস্মিতার বোন, বোনের জামাইয়ের সামনে বেশি খাওয়ার কথা বলে। যেগুলো ডায়াবেটিকস রোগ বিরোধী খাবার। প্রসূন রেগে যায়। সুস্মিতা কথা বাড়ায় না। চুপ থাকে। এই জায়গায় ওদের প্রচুর মিল। একে অপরকে বোঝে। তাই সংসারে অনাবিল সুখ- আনন্দ ভরপুর।
শোবার ঘরে সুস্মিতাকে প্রসূনজিত বলে,
– একটি কথা শোনো মিতা। তুমি শাসন করবে না কে করবে? একজন স্বামীর ভালো মন্দ দেখার প্রিয় মানুষটি ঐ বউতো! শোবার ঘরে যা বলার বলবে। মানুষের সামনে নয়। বিবেকে বাজে। সম্মানে লাগে।
– ঠিক আছে এবার থেকে তাই হবে, কথা দিলাম।
দৌঁড়ার পর মুখহাত ধুয়ে প্রসূন সকালের প্রার্থনা করেন। তারপর সকালের নাস্তায় ডাইনিং টেবিলে বসে। ইনসুলিন নেয়। খালি পেটে এক খোসা রসুণ, লেবুর জল খায়। এটা আজকাল সকালের নিয়ম। এই নিয়ম সুস্মিতার। সবাই এই নিয়ম পালন করে।
তখনও পূরবি ঘুমায়। এটা তার অভ্যাস। পূরবির উপরে সুস্মিতা কথা বলে না। সুস্মিতার বয়স বাড়ে। প্রতিদিন ঘর মুছতে পারে না,ঝাড় দিতে পারে না। যদিও করে, সারাদিন হাত ব্যথায় থাকে। তাই পূরবিকে রাখা। পূরবির একপা ল্যাংড়া। স্বাভাবিক হাঁটতে পারে না। সাত ভাইয়ের দুইবোন ওরা। দুইভাই মারা গেছে। পাঁচভাই বেঁচে আছে। সবাই সুখে আছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে পূরবি ভাইয়ের বাসায় যায়। বেশি দিন থাকে না।
পূরবি সবাইকে বলে,
– বাড়ির বড়ো গিন্নিটা ভীষণ ভালো। দয়া মায়ায় ভরা। আমি ঘুম থেকে সকাল সাড়ে আটটার পরে উঠি। বড়ো গিন্নি রাগ করেনা।
বিজয়ার রাগ হয়। মনেমনে বলে,কি অদ্ভুত মেয়ে। বাড়ির মালিক উঠার অনেক পরে ঘুম থেকে উঠে। লজ্জা শরম নেই একটুও। চঞ্চল, রাগীও আবার।
বিজয়াকে বলে,
– বাড়ির কর্তাকে মোটেও ভালো লাগে না। শুধু আমার বিরুদ্ধে কথা বলে। সবসময় আমাকে রাগ চোখে দেখে। আমি যেরকম সেরকমই আমার স্বভাব। সেভাবেই চলি। গিন্নিদিতো কিছুই বলে না। কত্তো ভালো মেয়ে।
বিজয়া বলে,
– পূরবি, তুমিতো এই বাড়ির কেউ নও, কাজের মেয়ে। তুমি যে সকাল আটটার পরে ঘুম থেকে ওঠ, এটা কি ঠিক?
– গিন্নিদিতো কিছুই বলে না।
– গিন্নিদি বলে না,তাই প্রতিদিন দেরিতে উঠবে? আচ্ছা পূরবি, তুমি দাদার বাসায় কি দেরিতে ওঠ?
-পাগল! বল কী? তা’ কি সম্ভব? চেঁছিয়ে দরজা ভাঙবে বৌদি। বকবে । তাইতো বেশিদিন থাকতে পারি না।
– ও তাই! আচ্ছা, পুরবি তোমার চেয়ে অনেক অসুন্দরীর বিয়ে হয়েছে। একহাত নেই মেয়েরও বিয়ে হয় দেখেছি। আবার তিন চার ফিট বেঁটে মেয়েরও বিয়ে হতে দেখেছি। তোমার হয়নি কেন?
– আমার স্বভাবের জন্য। ঘুমপাগল, রাগী আমি। পূরবির উত্তর।
– আগেতো অনেক বাসায় চাকরি করতে। ওখানেও কি দেরিতে উঠতে?
বিজয়া প্রশ্ন করে।
– পাগল! কারো বাসায় দেরিতে ওঠা বাড়ির গিন্নি মানবে?
– তো এখানে দেরিতে ওঠ যে।
– বাড়ির গিন্নিদিতো দয়ার সাগর। কিচ্ছু বলে না। তাই দেরিতে উঠি। কাজ করি ধীরে ধীরে। দেখো বিজয়াদি আমি সহজে এই বাড়ি ছাড়ছি না। এই সুখ পৃথিবীর কোথাও নেই। তুমিও কি কম সুখে আছো?
– সেটা আবার কী রকম? বিজয়া উল্টো প্রশ্ন করে।
– তোমাকে পরিবারের সবাই ভালোবাসে। বাড়ির বড় কর্তা, ছেলে, ছেলের বউ, গিন্নিদিতো আরো বেশি। যেন গিন্নিদির প্রাণ তুমি। তাছাড়া এতো দামি অষুধ খাও! সবতো গিন্নিদি, বাড়ির কর্তা কিনে দেয়। মাসিক বেতন পুরোটা হাতে থাকে। কী আনন্দ তাতে।
বিজয়া চুপ হয়ে যায়।
আজ সারাদিন বৃষ্টি। সাথে মেঘের গর্জন। বাড়ির সামনে জল জমে আছে। প্রসূনজিত অফিস যায়নি। রাস্তা মুখে থইথই জল। গাড়ি চলছে না। আদিত্য অফিসে চলে গেছে। বউমাও ইশকুলে গেছে।
বিজয়া ছোট টুকরো করে আঁখ আনে।
সুস্মিতা পাশের সোফায় বসে। প্রসুনজিতকে বলে,
– খাও।
প্রসূনজিতের লোভ হয়। প্রসুনজিত খাওয়া রসিক মানুষ। ডায়াবেটিস রুগী জানার পরও যা তা খায়। কী মিষ্টি, জুস, সন্দেশ, রসমলাই। কিছুই বাদ দেয় না। অথচ যেখানে যাবে, সেখানে সবাই চিনি ছাড়া চা দেয়। সবাই প্রসুনজিতকে ভালোবাসে।
সুস্মিতার কথায় টুকরো আঁখ মুখে দেয়। চিবুয়। দুই তিন টুকরো মুখে দেবার পর আঁখের সাথে রক্ত বেরুয়। প্রসুনজিত কিছু বলে না। দুপুরের পর থেকে দাঁতের ব্যথা শুরু হয়! দুপুরের ভাত খেতে পারে না। বিছানায় ছটফট করে। প্যারাসিটামল খায়। ব্যথা কমে না। দাঁত ব্যথায় টনটন করে। বিকেল ফুরোয় না। প্রসূনজিত দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাবে ভাবছে। কিছুদিন আগে ছয়টা দাঁতে ক্যাপ লাগিয়েছে। ছাব্বিশ হাজার টাকায়। একটা দাঁতের ক্যাপ ভেঙে গেছে।
আবার আজ দাঁতের প্রচণ্ড ব্যথা।
দাঁতের ডাক্তার মানে টাকার ছড়াছড়ি। চিকিৎসা না করে উপায় নেই।
শরীরের সব ভালো থাকলে মানুষের মন ভালো থাকে। কাজে আনন্দ পায়। একটা কিছু বিকল হলে যেন জীবনটাই শেষ।
দাঁতের ব্যথা, সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি।
প্রসুনজিত অসহ্য ব্যথায় অসহায় মানুষের মতো ছটফট করছে। অসহ্য যন্ত্রণা। দাঁতের ব্যথা যার হয়েছে, সে ছাড়া কেউ বুঝবে না। সুস্মিতাকে বলে,
– ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আর সহ্য হচ্ছে না।
– ঠিক আছে যাও।
তখনও বৃষ্টি পরছে, মেঘ ডাকছে। কার্তিক চলছে। যেখানে শীত এসে দাঁড়াবার কথা, সেখানে প্রচুর বৃষ্টি ঝরছে। আজকাল ষড়ঋতুর নিয়ম মানে না মাসে। সবাই বলে, জলবায়ু পরিবর্তনে হচ্ছে এসব।
সুস্মিতা মাসিক নিয়মে অমাবস্যা, পূর্ণিমা, অষ্টমীতে অষ্টশীল রাখে। আজও রেখেছে। আজ পূর্ণিমা, অষ্টমী নয়। তাই মন্দিরে যায়নি। না হয় দুপুরে চলে যায়। ভাবনায় বসে, ভন্তের দেশনা শোনে, অষ্টশীল নেয়।
সুস্মিতা বাড়ির মন্দিরে যায়। প্রার্থনা করবে। ভাবনায় বসবে। ধর্মকে আঁকড়ে ধরে আছে দীর্ঘদিন। এই আকাশ সংস্কৃতি যুগে কজন ধর্মকে ধরে রাখতে পারে!
সুস্মিতার বয়স বাড়ছে। তবে সে অন্য মেয়েদের মতো নয়। আধুনিক সমাজের সাথে তাল মিলে চলে। জীবন যেখানে যেমন, সেভাবেই চলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সে।
সুস্মিতার সাথে তাঁর স্বামীর অদ্ভুত মিল। তাই, ওদের ঝগড়া হয় কম।
সুন্দর সংসারের প্রিয়জন ওরা। সুস্মিতা বুদ্ধের ঘরে। প্রসুনজিত কাপড় পরে তৈরি ডাক্তারের কাছে যাবে। বৃষ্টির সেই ভয়ংকে রূপ। একটুও পরিবর্তন নেই। পরছে, ঝরছে, মেঘ ডাকছে গুড়ুম! গুড়ুম!
প্রসূনজিতের দাঁতের ব্যথা আর সহ্য হয় না যেন। বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে যায়। হাতে পুরনো দিনের ছাতা।
রাস্তায় রিকসা নেই। একটা দু’টো ট্যাকসি যাচ্ছে। খালি নেই। ঝুপঝুপ বৃষ্টি। মেঘে আকাশ কালো হয়ে আছে। একটিবারও বৃষ্টির বিশ্রাম নেই। দাঁতের প্রচণ্ড ব্যথায় প্রসূন। হুট করে একটি ট্যাকসি দাঁড়ায়। পাড়ার। প্রসুনজিতকে জানে। ট্যাকসি ড্রাইভারের প্রশ্ন,
– মামু কোথায় যাবেন?
– জামালখান চেরাগী পাহাড়।
– উঠুন।
সোজা ডাক্তার চেম্বার।
প্রসুনজিত প্রথম রুগী। পরপর আরো কজন রুগী আসে। একটু পর ডাক্তার আসেন। মুখোমুখিতে নমস্কার প্রদান। এক ভদ্রমহিলা ডাক্তার আসার পর থেকে ডাক্তার রুমের দরজায় যাওয়াআসা শুরু করে। মনে মনে ভাবছে সে আগেই যাবে।
না, সে হবার নয়। রুগীর সিরিয়াল লেখক হাত ইশারায় ডাকে। মহিলাটি এগিয়ে যায়, সাথে প্রসুনজিত। মহিলাটি দাঁড়ায়। পা বাড়ায় না। মহিলাটি হয়তো বুঝতে পারে, সে অন্যায় করছে।
এই হলো স্বাধীন দেশের হালচাল।
গায়ের জোরে সব হয়। অন্যায়ও ন্যায় হয়। মিথ্যে হচ্ছে প্রতিটি জায়গায় সত্যি। ক্ষমতা, পেশি শক্তি, গুণ্ডামি, সন্ত্রাসীরা সব পারে এইদেশে।
দেশতো দ্রুত এগুচ্ছে উন্নতির দিকে। সরকার প্রধানের আন্তরিকতার অভাব নেই। সরকারের অন্য সবাইতো দেশপ্রেমিক নয়। দেশে ক্যাসিনো বাণিজ্য, ইশকুল মেয়ে ধর্ষণ, খুনডাকাতি চলছে অহরহ। থরথর করে সবকিছুর দাম বাড়ছে। পঁচিশ টাকার পিঁয়াজ একশ বিশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সময়হীন অষুধ বিক্রি হচ্ছে। মানুষ মরছে।
চেম্বারে ঢুকেই প্রসূনজিত দাঁত ব্যথার কারণ বলে। প্রসূনজিতের উপর নীচ সব দাঁত লাগানো। যে ক’টা আছে, তার একটির প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার বললেন,
– এই দাঁতটি ফেললে পাশের দাঁতও বেশিদিন স্থায়ী হবে না। তাই না ফেলাই ভালো। আপনি রুডক্যানেল করেন।
তখন ও গুড়ুম গুড়ুম মেঘের বিভৎস ডাক। ডাক্তার মুখ হা করে ছোট হ্যামার দিয়ে দাঁতে আঘাত করে। প্রসূনজিতের দু’চোখ বেয়ে জল পরে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদে প্রসূনজিত। ডাক্তার জিগ্যেস করেন,
– ব্যথা লাগছে?
প্রসূনজিতের মুখে ডাক্তারি সরঞ্জাম। মুখে নয়,মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
অনেকক্ষণ পরে ডাক্তার কাজ শেষে বলেন,
– আরও দু’দিন আসতে হবে।
প্রসূনজিতের চোখে নোনাজল। কুলকুচি করে ডাক্তারের সামনের চেয়ারে বসে। দাঁতে তখনও ব্যথা। বৃষ্টি থামছেনা। বৃষ্টি পরছে। ডাক্তার প্রেসক্রিপসান লিখে দেন। অষুধগুলো খাবেন ব্যথা কমবে।
প্রসুনজিত ডাক্তার ফিস দিতেদিতে বলেন,
– দাদা, এই বৃষ্টি জলে চেয়েছিলাম এই দাঁতটিকে বিসর্জন দেবো। আপনি দিলেন না। সত্যিই আপনি বিবেকবোধ একজন মানুষ। মানুষের মঙ্গল, কল্যাণ কামনা করেন।
প্রসূনের কথায় ডাক্তার বাবু মুখে হাসি ছুঁড়ে দেন।
দুইহাত জোড় করে প্রসুনজিত বিদায় নমস্কার জানিয়ে চেম্বার থেকে বেরুয়।
বাইরে বৃষ্টি পরছে তখনও। সাথে মেঘের ডাক।
এটা কার্তিক বৃষ্টি! কখন থামবে কেউ জানে না!
এমন কি আবহাওয়াবিদরাও!