বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি ছবি যাঁরা তুলেছেন প্রত্যেকেই ইতিহাসের এক একটি অংশ। বছর তিনেক আগে জাতীয় জাদুঘর এর একটি হলে নিজ হাতে তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন দেশবরেণ্য আলোকচিত্রী শিল্পী পাভেল রহমান। তিনি বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ছবিই এক একটি ইতিহাস।’ কেননা সেইসময় ছিলনা আধুনিক প্রযুক্তি, ছিল না সাংবাদিকদের জন্য আজকের মতো অতিরিক্ত বিশেষ ব্যবস্থা। সেইসময় বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলেছিলেন একজন ফটো সাংবাদিক এর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি আমার শহর চট্টগ্রামের এক খ্যাতিমান সাংবাদিক। তাও আবার এই চট্টগ্রামেই বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার দারুণ ইতিহাস।
‘মূলত দৈনিক দেশবাংলায় আমাকে প্রফেশনাল ফটো রিপোর্টার এর পরিচিতি দেয়।এই পরিচিতি আমাকে বঙ্গবন্ধুর নৈকট্য পেতে এবং ছবি তোলায় সহায়ক হয়। প্রথম মহেন্দ্রক্ষণটি আসে ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে প্রথম চট্টগ্রামে আসেন। দৈনিক দেশবাংলা তখন চট্টগ্রামে আলোচিত – আলোড়ন সৃষ্টিকারী পত্রিকা। আমরা নিয়মিত পত্রিকায় ছবি ছাপাই। জেলা প্রশাসন থেকে আমি প্রেস ফটোগ্রাফার এর কার্ড সংগ্রহ করি। সকাল সকাল পৌঁছে যাই সার্কিট হাউসে। সার্কিট হাউসের বাইরের মাঠে (যেখানে এখন শিশু পার্ক) বিশাল জনসমাগম। মূল ভবনের সামনে বাগান। পাশে খোলা চত্বর। লাগোয়া পেছনে সেগুন বাগিচা। আমি একা সেই বাগানের পাশের চত্বরে হাঁটছি। উত্তেজনায় ভরপুর মন। সফেদ শার্ট পেন্ট পরা আমার।দুইটি ক্যামেরা, একটি গলায় ঝোলানো। ৩৫ এম এম আগফা ইসোলা ক্যামেরা। হাতে ইয়াসিকা ১২০ এম এম বঙ ক্যামেরা। কোমরে গুজেছি ব্রাকেট লাগানো ফ্লাশ গান। ক্ষণিক বাদে একটি হেলিকপ্টার ল্যান্ড করলো ঐ খালি চত্বরে। সব মিলে ৫/৬ জন সেই কপ্টার থেকে নামলো। এডভান্স পার্টি তারা। তাঁদের মধ্যে ২ জন ফটোগ্রাফার। ইয়া বড় বড় ক্যামেরা।ল্যান্স আর কাধে ব্যাগ। দেখলাম আমাকে দেখে তারা দুজনে চোখাচুখি করে মুচকি হাসলো।একজন পি আই ডির ফটোগ্রাফার জহিরুল হক। হাজি জহির নামে খ্যাত। অন্যজন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ আলম। বহু পরে ইত্তেফাকে আমার সহকর্মী হন।একসময় মোহাম্মদ আলম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কোন পত্রিকায় কাজ করি। মিনিট দশেক পর বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টার অবতরণ করলো অনতিদূর নেভেল হেলিপোর্ট এ। সেখান থেকে কয়েক গাড়ি বহরে বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউসে পৌঁছালেন। তার পেছন পেছন একদল নেতাকর্মী দ্বিতলে উঠে গেল। আমিও পিছু পিছু ছুটলাম। বঙ্গবন্ধু মাঝের রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে জনতার দিকে দুহাত নাড়ছেন। তাঁর পেছনেও ভিড়। আমার ছবি তোলার কোন সুযোগ নেই। নিচে থেকেও এই ক্যামেরায় সম্ভব নয়। কোনমতে কনুইয়ে ভিড় ঠেলে বঙ্গবন্ধুর ডান পাশের (পশ্চিম দিকে) রেলিং এর কাছে গেলাম। মুহূর্তে আর করণীয় ভাবলাম না। বাম পা টি রেলিং এর ফাকে বড়শির মতো লাগিয়ে পুরো শরীর বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে লাগলাম। এই দৃশ্য যতলোক বাইরে ছিল সবারই চোখে পড়েছে।একদিকে বঙ্গবন্ধুর উঁচান দুহাত। তিন চার ফুট তফাতে আমার ঝুলানো দেহ। আমার বাম পা সরলে সরাসরি স্বর্গে। নিশচয় বঙ্গবন্ধুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেও তা এড়ায়নি। তা অনুধাবন করি আরো একবছর পরে।” এই কথাগুলো তাঁর, যিনি বঙ্গবন্ধুর ছবিটি ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তুলেছিলেন। যিনি দৈনিক আজাদীর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এম এ মালেক যখন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন তখন তিনি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন এম এ মালেক স্নেহাস্পদ। নাম ওসমান গণি মনসুর। যিনি সত্তর দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি যখন তোফায়েল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব সেই সময় যাত্রীক এর ব্যানারে (তখন সরাসরি ছাত্র সংগঠন এর নাম দিয়ে নির্বাচন হতোনা।) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্যানেলে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে তাঁর এই কথাগুলো তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন এবং বই আকারে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। সেখান থেকেই এই ইতিহাস নেয়া। তাঁর পা ঝুলানো ছবি তোলার ক্ষণটি পাভেল রহমান ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁকে হস্তান্তর করেছিলেন। আমাদের সাংবাদিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কতো ছবি, কতো সংবাদ আমাদের পৌঁছে দেন তার খবর আমরা কজন রাখি? পরবর্তী দেখায় জাতিরপিতা তাঁকে কাছে ডেকেছিলেন এবং পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন বলেও তিনি লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু এমন এক মানুষ যাঁর চোখ কোন কিছুই এড়িয়ে যেতো না। ইতিহাস পাঠে আমরা তা-ই জেনেছি। তাইতো আজো গর্ব করে উচ্চারণ করি- ‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ / আমি কি তেমন সন্তান / যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিশু সাহিত্যিক