প্রতিটি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে। একজন শিশু নিজের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, বিদেশি ভাষায় সে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। এজন্য নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু প্রতিটি জাতির মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করা দরকার। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রতিটি জাতিসত্তার জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে। এর মাধ্যমে বহু ভাষা ও বহু জাতির যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহ্য রয়েছে, তা সবার কাছে ফুটে উঠবে। মুক্তিযোদ্ধা ও জোষ্ঠ্য সাংবাদিক এ কে এম রইসুল হক বাহার বলেন, মানব জাতির ইতিহাস সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভাষাকে সংরক্ষণ করতে হবে। তাই এ দেশের কোন সংখ্যালঘু জাতির ভাষা যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক মুহাম্মদ আমীর উদ্দীন বলেন, ভাষার জন্য এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে। কিন্তু এখনো সংখ্যালঘু জাতিগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা মাতৃভাষায় চালু হয়নি, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া কমাতে মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। শুধু ভাষাগত সমস্যার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করছে পাহাড়ি শিশুরা। মারমা ভাষাবিদ ক্যহ্নাউ চৌধুরী বলেন, ভাষাগত সমস্যার কারণে তিন পার্বত্য জেলায় বিশেষ করে বান্দরবানে ১১টি জনগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দুর্গম এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অর্ধেকের বেশি শিশু পাঠ্যবই ও পাঠদানের ভাষা বুঝতে না পেরে ঝরে পড়ছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে মূলধারায় নিয়ে আসার উপর জোর দেওয়ার সময় এসেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমতলের জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করতে হবে। বাঙালী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্ঠা করতে হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্র প্রশাসন, ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ও দল যে যেভাবে পারছে, স্বীয় স্বার্থে সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবেই। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে এদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার জন্য দিনের পর দিন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে। ইংরেজী শাসনের পর পাকিস্তান শাসকের নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরচদ্ধে যে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম চলেছিল তাতে আমাদের এই নৃগোষ্ঠীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। তারাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে এবং তারাও এই বাংলার উন্নয়নে বিভিন্ন উপায়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিভিন্ন প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজে এই জনগোষ্ঠী অত্যন্ত গুরচত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই এই জনগোষ্ঠীকে আরো সুসংহত, কর্মমুখী ও জ্ঞানমুখী করার জন্য তাদের নিজস্ব ভাষাকে চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্রেইল বই দেওয়া হচ্ছে ৯৭০৩জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে। আগে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু ব্রেইল বই দেওয়া হত। আর পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষার্থীকেও বই দেওয়া হবে। এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও ওঁরাও। চাকমা ও মারমা ভাষার বইগুলো তাদের নিজস্ব লিপিতে লেখা। বাকী তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বইয়ে কোনটি বাংলা লিপিতে কোনটি রোমান হরফে। অন্যান্য শিশুর মত এই শিশুরাও বছরের শুরচতে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ পাবে। এবার শুধু প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হবে। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণি ও এর পরের বছর দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইও মাতৃভাষায় ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। তবে এরপর ধীরে ধীরে সবাইকে জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে বই পড়তে হবে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধদিের বই দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এবার হয়ত তথ্যের অভাবে সব দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে বই দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে শুমারী অনুযায়ী পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, এবার প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রায় মোট ৩৭ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। যা গতবারের চেয়ে প্রায় দুই কোটি বেশি।
সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে।
শিক্ষা দিবসে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা তাদের মান্নোয়নের পাশাপাশি শিক্ষার উন্নয়নে তাদের প্রস্তাবিত দাবিগুলোর উপর জোড় দেয়। বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও মানববন্ধনের মাধ্যমে তাদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে সকল ধরনের বৈষম্য নিরসনে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্ঠা চালিয়ে যায়। বিশেষ করে আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং উচ্চ শিক্ষার ৫% শিক্ষা কোটা আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। উচ্চ শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করতে হবে। লুলাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চসাথোয়াই মারমা বলেন, জেলা ও উপজেলা শহরের বাইরে অনেক দুর্গম এলাকায় মান সম্মত শিক্ষা তো দূরের কথা, ভাষা না বোঝার কারণে শিশুদের পাঠদান করাও সম্ভব হয় না। ভাষা বোঝার দুরহ ব্যাপারটিকে সহজ করতে মাতৃভাষাতেই শিক্ষা জীবন শুরচ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই সমভাবে উপকৃত হবে। শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ছাড়া পাহাড়ি শিশুদের নিজ ভাষায় পাঠ্যবই দেওয়া হলেও পাঠদান সম্ভব না। এর কারণ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার জন্য এখনো কোন শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরচ হয়নি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশ ও দেশাত্ববোধ জাগ্রত করতে হলে তাদের নিজস্ব ভাষায় নিজেদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির পরিচয় তুলে ধরার জন্য মাতৃভাষা চালুর কোন বিকল্প নেই। আগে যদি নিজেকে চিনতে পারা না যায়, আগে যদি নিজেদের অবস্থান মূল্যায়ন করা না যায় এবং আগে যদি নিজের গুরচত্ব অনুধাবন করা না যায় তাহলে কখনো কেউ সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারে না। তাই তাদেরকে মানুষ ও নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই মাতৃভাষার উপর জোর দিতে হবে।
একটি দেশের উন্নয়ন তার সমগ্র জাতিসত্তার উন্নয়নের উপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের একটি বিশাল অংশ নিয়ে জুড়ে আছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী। হাজার বছরের বাঙ্গালীর ইতিহাসে এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তরা নিজ নিজ অঞ্চলের পাশাপাশি সারা দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। আমাদের দেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাস। সংখ্যায় তারা ২৫ লাখ। যার ৪২ শতাংশ বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাস করে। বাকীদের বাস দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলায়। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলোর সমস্যার সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। বিশেষ করে শিক্ষার উন্নয়নে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার যথাযথ চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা জরচরি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষক-শিক্ষিকা কেউ নিজেদের ভাষায় লিখতে পড়তে পারেন না। ফলে নিজেদের ঐতিহ্য ও গুরচত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। এই দেশের আপামর জনসাধারনের জন্য এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে শিক্ষার হার বাড়াতে হলে তাদেরই নিজস্ব ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাছাড়া আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে বহিঃবিশ্বে তুলে ধরে জাতীয় কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের উন্নয়নের পথকে সুগম করতেও তাদের মাতৃভাষাকে তাদের নিজস্ব শিক্ষাতে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এদেশের মানুষ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের জন্য রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং এদেশের প্রতিটি মানুষই জানে মাতৃভাষা ছাড়া কোন অঞ্চল ও জাতির সঠিক ও যথাযথ উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম