নীরবে সবার মন জয় করে নেয়া সাদিক মিয়ারা ক্ষণকালে জন্মায়

নুসরাত সুলতানা | বুধবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

আহারে জীবন! আহারে সাদিক মিয়া! আপনার মৃত্যু সংবাদ আমাদের সবাইকে কাঁদাচ্ছে। এভাবেই কেনো চলে গেলেন! আমাদেরকে কতোটা সাহস দিতেন আপনি! সে আপনিই পানিতে ঝাঁপ দিলেন! ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রায় চার বছর আমার হাজব্যান্ড বাংলার সৌরভের ক্যাপ্টেনের দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। বাংলার সৌরভের ক্যাপ্টেন থাকাকালীন তাঁর সাথে অসংখ্যবার আমরা জাহাজে গিয়েছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি সাদিক মিয়ার সহজ সরল বিশ্বস্ত জীবন। উচ্চস্বরে কথা বলেননি কখনো। আমরা জাহাজে আসবো শুনলেই কেবিন কুল করে রাখতেন। আমরা কেবিনে পৌঁছার সাথেই আজমাঈনের জন্য চা বিস্কিট নিয়ে আসতেন। ওখান থেকেই আজমাঈন এনার্জি বিস্কিট দিয়ে চা খেতে শিখেছে। আমাদের মেয়েদের জন্য চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বিভিন্ন রকমের ফলমূল নিয়ে আসতেন, মেয়েরা খাবারগুলো খেতে চাইতো না বলেই সাদিক মিয়া বলতেন, স্যার আপনার বাচ্চারা এমন কেনো? সবগুলো খাবার ফেলে রাখে! জেনারেল স্টুয়ার্ড সাদিক মিয়া সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্যাপ্টেনের সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্বে থাকতেন। কেবিনের চাবি, স্টোরের চাবি থাকতো সাদিক মিয়ার কাছে। ক্যাপ্টেন সাহেবের কেবিন গুছিয়ে রাখা, কাপড় লন্ড্রি করে রাখা, সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে ডিনার পর্যন্ত সব ধরনের খাবার সার্ভ করা সবকিছু সাদিক মিয়া একাই করতেন। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে যখন আমরা ভয় পেতাম, বাচ্চারা খাবার না খেয়ে বসে থাকতো তখন সাদিক মিয়া এসে দেখলেই আমাদের বাচ্চাদেরকে সাহস দিয়ে বলতেন কিছু হবে না মামা, ভয় পাইও না তোমরা! আমি তো বহু বছর ধরে এখানেই আছি, কিছু হবে না! আজমাঈনকে ওনার নাতনির ছবি দেখিয়ে বলতেন, দেখো আমি এখন দাদা হয়েছি, কতো বয়স হয়েছে আমার! এতো বছর আমি এই জাহাজেই আছি!…. এই যে আমাদেরকে সাহস দিয়ে কিছু হবে না বলা মানুষটাই যখন চলে গেলেন তখন আমরা আমাদের ভাষা হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়লাম। ৪০ বছর ধরে কাজ করেছেন তিনি। কতো অফিসারের সাইনঅন, সাইনঅফ হয় সাদিক মিয়ার সামনেই কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাদিক মিয়ারা এভাবে নীরবেই থেকে যান। নীরবে কাজ করে যান।

গত শুক্রবার (৪ ঠা অক্টোবর) গভীর রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের আউটার এঙ্কোরেজে থাকা বাংলার সৌরভ জাহাজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটলে, আগুনের লেলিহান শিখায় ভীত হয়ে সাগরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তিনি। যখন শুনলাম সাদিক মিয়া মারা গেছেন আমার হাজব্যান্ড আর আমি গুমরে কেঁদেছি। এতো ভালো একজন মানুষ এভাবেই চলে গেলেন!

০৬ অক্টোবরের পত্রিকায় ওনার ছবি দেখে, সংবাদ পড়ে আমরা আরো বেশি কষ্ট পেয়েছি। কী মর্মান্তিক! জাহাজে আগুন লাগার এক ঘণ্টা আগেও তিনি ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন জাহাজ ডলফিন জেটিতে গিয়ে ক্রুড অয়েল আনলোড শেষ করলেই জাহাজ থেকে সাইনঅফ করে একেবারেই বাড়িতে চলে যাবেন। ৫/৭ টা দিন পরে অবসর নিয়ে একেবারেই বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা যার তিনি জীবন থেকে চিরতরেই হারিয়ে গেলেন। চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তবে আমার বিশ্বাস সাদিক মিয়া বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, মানুষ তাঁকে বিশ্বস্ত জেনারেল স্টুয়ার্ড হিসেবে আজীবন মনে রাখবেন, সম্মান জানাবেন। সাদিক মিয়ার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। মহান আল্লাহ তাঁর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়ে তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিষয় : একাকীত্ব
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে