নিখুঁত-চিন্তক আবুল ফজল

মিলটন রহমান | রবিবার , ১০ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ


বাংলা ভাষায় লেখক হয়ে ওঠা আবুল ফজলের জন্য দূরূহই ছিলো। সে সময় বাঙালী মুসলিম সমাজ ফার্সি আর উর্দু চর্চায় মগ্ন। তাঁর পরিবারেও এ পরিস্থিতি চরমভাবে রেখাপাত করেছিলো। মৌলানা পিতার সন্তান বাংলায় লেখালেখি করবে তা হবে কেনো! লিখতে হয় যদি তাহলে ফার্সি না হোক অন্তত উর্দুতে লিখতে হবে, পিতার এমন নির্দেশ উপেক্ষা করা খুব সহজ ছিলো না। তবে মাতৃভাষা বাংলা তাঁকে মাটির দিকেই টেনে রেখেছিলো। গোঁড়া পিতার কথা তাঁকে আটকে রাখতে পারলো না। বাংলাভাষার বিভিন্ন গ্রন্থপাঠ, বাংলা ভাষায় লেখা তিনি চালিয়ে গেলেন। মোহাম্মদ আবুল ফজল কেবল আবুল ফজল নামে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ায় ইহজগতে থাকাকালীন তাঁর পিতা জানতে পারেন নি সন্তানের বাংলা ভাষায় বিখ্যাত লেখক হয়ে ওঠার খবর। ‘বন্ধুমন্ডলী আর গুটি কয়েক সাহিত্যানুরাগী ছাড়া অন্য কেউ জানে না। অভিবাবকদের জানার কথা নয়-তাঁর ছিলেন ভিন্ন জগতের মানুষ। স্মৃতিচারণ বিষয়ক গ্রন্থ ‘রেখাচিত্র‘ তে এভাবেই পিতার না জানার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
পিতার নির্দেশে তিনি ওকালতি পাঠ বাদ দিলেও বাংলা ভাষায় লেখালেখি বাদ দেন নি। এর মাধ্যমে তিনি বংশ পরম্পরায় চলে আসা গোঁড়া রীতি ভেঙে দিলেন। তিনি একের পর এক রচনা করলেন, চৌচির (১৯৩৪), প্রদীপ ও পতঙ্গ (১৯৪০), মাটির পৃথিবী (১৯৪০), বিচিত্র কথা (১৯৪০), রাঙ্গা প্রভাত (১৯৫৭), রেখাচিত্র (১৯৬৬), দুর্দিনের দিনলিপি (১৯৭২) প্রভৃতি গ্রন্থ। আবুল ফজল তাঁর মনে বাংলা ভাষাপ্রীতি এবং কুসংস্কার বিনাশী যে মানসিকতা পোষন করতেন তার বিস্তার ঘটাতে শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ‘ তাঁকে ইচ্ছে বাস্তবায়ন এবং আলোক বিচ্ছুরণে সহায়তা করেছিলো। এ সংগঠনের মুখপত্র আবুল হুসেন সম্পাদিত‘শিখা‘ আবুল ফজলকে তিমির বিনাশী পথের সন্ধান দিয়েছিলো। একে ঘিরে সে সময় যাঁরা পরিক্রমণ করেছিলেন তারাই প্রতিভাত হলেন ‘শিখাগোষ্ঠি‘ নামে। বাংলাসাহিত্যান্দোলনে ‘শিখাগোষ্ঠির ভূমিকা বিবিধ অনুরনণ তুলেছিলো। এই গোষ্ঠির একজন আবুল ফজল। তিনি ‘শিখা‘ পঞ্চম সংখ্যার সম্পাদকও ছিলেন। এর আগে ‘শিখা‘ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন কাজী মোতাহার হোসেন(দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা), মোহাম্মদ আবদুর রশিদ(চতুর্থ সংখ্যা)। তাঁরাই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অগ্রজন। এই আন্দোলন বাংলাসাহিত্যকে একটানে দাঁড় করিয়ে দেয় ইতিহাসের পাতায়। আবুল ফজলের কথাসাহিত্যের রেখাগুলো সেই গানেই মুখর। শিক্ষা সংস্কার, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে নতুনের সন্ধান বা পদ বাতলে দেয়ার প্রচেষ্টা তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প-উপন্যাসে দৃশ্যমান। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত তার অবদান অবশ্যই স্বীকার্য। এসব বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ থাকেন নি। বলায় নিয়েছেন ঝুঁকি। বলেন, ‘সবিনয়ে স্বীকার করছি নির্লিপ্ত শিল্পী বা লেখক হতে পারি নি, পারি নি অন্যায়-অবিচার দেখে একেবারে চুপ মেরে থাকতেও। বন্ধুদের নিষেধ সত্বেও কথা বলেছি, না বলে পারি নি বলে। কেউ কোন কথা বলছে না দেখে নিজের দায়িত্বটা যেন আরো বেশি করে বেড়ে যায়। এ আমার একটা ঝোঁক।‘ এই হচ্ছে গোটা আবুল ফজল। গোঁড়া ধর্মীয় পরিবার থেকে বেড়ে উঠেও সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এ লেখক তাঁর সময়ে যে ভূমিকা রেখেছেন সমাজ ও রাস্ট্রে তার ছাপ খোঁদায় হয়ে রইলো। তিনি সব সময় নতুনের সন্ধান করেছেন। ভাব-চিন্তা এবং বলার কৌশল এর সবকিছুতেই তিনি চলমান প্রক্রিয়া থেকে দূরে অবস্থান করেছেন। ফলে নিজের সময়ে চর্চিত সাহিত্যকে তিনি সব নদীতে একই স্রোতের প্রবাহ হিসেবেই দেখেছেন। রবীন্দ্র পরবর্তী তিরিশের কবিদের বাদ দিলে এর পরের সময়ে নতুন কোন স্বর নেই বলেই তিনি দাবি করেছেন। ‘একদল প্রাচীন চিন্তার জাবর কেটেই আত্মতৃপ্ত, অন্যদল পরিবেশ আর জীবন বিচ্ছন্ন এক রকম পল্লবগ্রাহিতাতেই খুঁজছে নিজেদের আত্ম প্রকাশের পথ‘ (সাহিত্যের ভূমিকা, সমাজ সাহিত্য রাস্ট্র)। ১৯৬৬ সালে রচিত তাঁর প্রবন্ধে এই ছিলো মূল্যায়ন। সে সময়ের আধুনিক সাহিত্যকে তিনি বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণ বলে দাবি করেছেন। এছাড়া সাহিত্যে কেবল আঙ্গিক নয় চিন্তা চর্চার প্রতিও তিনি গুরুত্বরোপ করেছেন। প্রাসঙ্গিক ভাবে এলিয়টের ধর্ম জীবনের সমন্বয় অনুসন্ধান এবং জাঁ পল সাঁর্ত্রের অস্তিত্ববাদের সন্ধান বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। শিল্প সম্পর্কে আবুল ফজলের চিন্তায় বিপুল বৈরাগ্যের অনুরণনও দেখা যায়। তিনি যখন বলেন, ‘শিল্পীর জন্য পৌঁছাটা বা গন্তব্যতো কোন কালেই বড় কথা নয়-চলাটাই বড় কথা।‘ এ ভাষ্যের পরে একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর চিন্তার পরিমাপ করতে কোন চিন্তক বা ধীমান পাঠকের বেগ পাওয়ার কথা নয়। শিল্প তো গতিশীল। তাকে কোন এক প্রান্তে গিয়ে ফুরিয়ে গেলেতো চলবে না। শিল্পের কাজই হচ্ছে গন্তব্যহীন পথে ছুটে চলা এবং নবতর অনুসন্ধান। সেই কথাই আবুল ফজল বলেছেন। রাজনীতি ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কেও তাঁর বক্তব্য কাল ছাপিয়ে মহাকালের দিক নির্দেশ করেছে। রাজনীতি বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ এখন আরো বেশি কার্যকর। তিনি দেখেছেন ব্যক্তি-সমাজ কেউ রাজনীতির বাইরে নয় এবং বাইরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এর ঘূর্ণীপাক থেকে কারোই রেহাই নেই। তাঁর পর্যবেক্ষণ এখন আরো বেশি কার্যকর। রাজনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের মজ্জায় আক্রমণ করে বসে আছে। একই পরিস্থিতি বিরাজমান ধর্ম বিশ্বাসে। আবুল ফজল ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে ধর্মের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বেড়ে যাবে। তা এখন প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে এর কার্যকারিতা প্রবল। ব্রিটেনে অসংখ্য চার্চ এখন ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে, প্রার্থনার জন্য নয়। বাংলাদেশে এ হার ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অপব্যাখ্যা। ধর্ম এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক যন্ত্র হিসেবে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ধর্ম। এই পরিস্থিতি অনেক আগেই ব্যাখা করে গেছেন আবুল ফজল। একজন চিন্তকের দৃষ্টির প্রখরতাই হচ্ছে ভবিষ্যত নির্ণয় করা। তিনি কথাসাহিত্যে এ কাজটি করেছেন চিন্তার তীক্ষ্মতায়।
আবুল ফজলের নাট্যগ্রন্থ ‘স্বয়ম্বরা‘ বাংলা কথাসাহিত্যে প্রচন্ড প্রভাব বিস্তারী। সময় এবং পরিপার্শ্বে বিরাজমান জগত সংসারের ধীমান দর্শক এবং ধারাভাষ্যকার তিনি। তিরিশের রোয়াবি সাহিত্যান্দোলনের পরিপেক্ষিতে তাঁর রচিত নাটক তাই দলিল হয়ে আছে। তাঁর বয়ানেই জেনে নিই প্রাককথা, ‘ত্রিশের সাহিত্যান্দোলেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগাযোগ আমাদের ছিল না বটে। তবে পরোক্ষ প্রভাব, সজাগ পাঠক হিসেবে আমরাও এড়াতে পারি নি। সে আন্দোলনের এক বড় লক্ষণ: চলতি সবকিছুকে ব্যঙ্গ-কৌতুকে বিদ্ধ করা আর সবকিছুর প্রতি একটা উন্নাসিকতা তীর্যক ভঙ্গিতে তাকানো। মনের ঐ আবহাওয়া ও পরিবেশে আমি কয়েকটি একাঙ্কিকা লিখেছিলাম-পরে সেগুলি ‘একটি সকাল‘ আর ‘আলোকলতা‘ নামে দুই স্বতন্ত্র গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিলো। শুধু একাঙ্কিকা নয় মনের ঐ অবস্থায় কিছু সংখ্যক গল্পও লিখেছিলাম আমি। তার একটির নাম ‘সাহসিকা‘ -ওটারই নাট্যরূপ ‘প্রগতি‘। ‘প্রগতি‘ও স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসেবে চালু ছিল দীর্ঘকাল।‘ নাটক ‘স্বয়ম্বরা‘ আমাদের চিরচেনা সমাজের বিরূপ মানসিকতার ছাপচিত্র। কনে খুঁজতে গিয়ে পাত্র পক্ষের নানান কাসুন্দি ও ফিরিস্তি উঠে এসেছে এতে। একটি পোশাকের মতো একটি প্রমাণ সাইজের পাত্রী খোঁজা নিয়ে এই নাটকের গল্পের বিস্তার। এক সময়ের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য মাহমুদ নিজের তৈলমর্দন গুনে সমাজের উপরের তলায় কিভাবে উঠে আসেন এবং পরবর্তীতে ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে গিয়ে তাঁর নিজের ঊন মানসিকতার পরিচয় দেয় তাই এ নাটকের মূল প্রতিপাদ্য। খোঁচাত্মক এই নাটকের মধ্য দিয়ে আবুল ফজল ব্যক্তি-সমাজের যে চিত্র এঁকেছেন তা এখনো বহমান। নাটকটির বক্তব্য এবং বর্ণণার রসাত্মক স্টাইল উপভোগ্য। চরম হাস্যরসের ভিতর দিয়ে সমাজের কঠিক বাস্তবতার চিত্র তুলে আনার ক্ষেত্রে তাঁকে কথাসাহিত্যের চিরকালীন আসনে বসিয়েছে। ক‘টা লাইন উদ্বৃত করেই তার স্বাক্ষ রাখা যেতে পারে।
‘বেত্রদন্ড হস্তে স্বরস্বতী ও লক্ষ্মীকে শাসন করিয়া তদবিনিময়ে যাহা আদায় করিবেন ভাবিয়াছিলেন, তাহা তাহার ভাবনা অনুযায়ী হয়নাই। ফলে তাহার ভাবনাই শুধু বাড়িয়াছে। বেত্রদন্ডকে শুধু যে ভূত ও মানুষ ভয় করে তাহা নয়; দেব দেবীরাও তাহাকে ভয় করিয়া এড়াইয়া চলেন। কাজেই স্বরস্বতির সঙ্গে তার শিষ্যদের এবং লক্ষ্মীর সাথে তার নিজের রীতিমত হাতাহাতি চলিতেছে।‘
এ নাটকটি পাঠকালে স্মরণে আসে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ছড়া এবং মধুসূদন দত্তের প্রহসনগুচ্ছ। সেই কাতারে স্বভাবতই উঠে আসে অমৃতলাল বসুর বিবাহ বিভ্রাট, বাহবা বাতিক, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কল্কি অবতার, বিরহ, মীর মোশারফ হোসেনের এর উপায় কি, ভাই ভাই এইতো চাই‘ এবং দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী, বিয়ে পাগলা বুড়োর দৃশ্য।
নাটক ‘নেতা‘ পাঠ করতে গিয়ে গদ্য এবং বর্ণনার শক্তি প্রত্যক্ষ করে মনে হয়েছে আবুল ফজল তীক্ষ্ম এবং দ্রুতবেগের গদ্য নির্মাণে একেবারে স্বতন্ত্র। এ গল্পটিতে একজন শিক্ষক কিভাবে নেতা হয়ে ওঠেন তারাই বর্ণণা ব্যপক হাসির যোগান দিয়েছে এবং বরাবরের মতোই অন্তে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ম্যসেজ। প্রহসনের এটিই শক্তি। আমি ‘স্বয়ম্বরা‘ গ্রন্থভূক্ত সবগুলো নাটককেই একসাথে প্রহসনগুচ্ছ বলতে চাই। এ গ্রন্থের অন্যান্য নাটকগুলো হলো, মেয়েলোক, মধুরেণ, শেষপথ, কবির বিড়ম্বনা, ভাই ভাই, তা‘ত হবেই, বোরকা এবং প্রগতি।
সামজ এবং রাস্ট্রে, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি সবদিকে সজাগ দৃষ্টি প্রক্ষেপণে আবুল ফজল অসাধারণ বীক্ষণের অধিকারী। অবিভক্ত ভারত সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নতুন পাঠককে সে সময়ের দৃশ্য অনুধাবনের দৃশ্য সহজতর করে তুলে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রেখাচিত্র‘ এর স্বগত বক্তব্যেই তিনি সে সময়ে দৃশ্য তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কবি এলান লুইসের ভারত দর্শনের বক্তব্যে বলছেন, ‘এ দেশে পরিণতি তথা মানসিক পরিপূর্ণতা অর্জন অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। মানুষের পরিবেশ দেখে ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো এতো বস্তু এখানে রয়েছে যে সংযত-মনা হওয়া সম্ভবই নয়।‘
ওই পরিস্থিতিতে কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যকলমও স্থির থাকতে পারে নি বলে মনে করেন আবুল ফজল। এই যে প্রান্তরবিস্তারি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তা তাঁকে কথাসাহিত্যের পোক্ত আসন পেতে দিয়েছে। ‘রেখাচিত্র‘ গ্রন্থে তিনি নিজের জীবন এবং সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসলগ্ন থেকেছেন। ফলে পুরো গ্রন্থটি সাহিত্যালংকার পরিধান করে হয়ে উঠেছে ‘জীবনিতিহাস‘। যার মধ্যে শুধু তিনি একা নন, সাথে রয়েছেন তাঁর চোখে দেখা অসংখ্য ঘটনা ও মানুষের চেহারা।
বাংলাসাহিত্যের ছোটগল্পে আবুল ফজল দূর্দান্ত গাল্পিক। গল্পের শরীর নির্মাণে, কাহিনী এবং দৃশ্যায়নের যে ক্ষমতা তিনি প্রদর্শন করেছেন তা পাঠকের কাছে সব সময় স্মরণীয়। একইভাবে এই ছোটগল্পেও তিনি বিরুদ্ধ সময় পরিবর্তনের গান গেয়েছেন। চেয়েছেন সংস্কার। গল্পে কখনো চলতি আর কখনো সাধু ভাষা প্রয়োগ করেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রেও তার মুন্সিয়ানা শতভাগ। তিনি বিশ শতকের ছোটগল্পের অন্যতম শিল্পী-তুলিকার। সম্ভবত গ্রামে বেড়ে উঠেছেন বলেই আবুল ফজল সামাজিক এবং পরিবারিক দ্বন্ধের গভীর পর্যবেক্ষক। তাঁর ‘মা‘ গল্পটি তারই প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। মা নিজের সন্তানকে খুনের দায় থেকে বাঁচার সুযোগ দেন নি। নিজের সন্তানদেরই ফাঁসির মঞ্চে পাঠিয়ে দিলেন সত্যকে ভালোবাসেন বলে। এ দৃশ্য আমাদের আশেপাশেই ঘটে কিন্তু আবুল ফজলের সৃষ্ট ‘মা‘ এই নশ্বর সমাজের জন্য একটি বার্তা।
আবুল ফজলের কথাসাহিত্য বিষয়ে অসংখ্য রচনা রয়েছে। এসব রচনার খুব কমই তাঁকে পুরোপুরি বর্ণণা করতে পেরেছে। সে তুলনায় আবুল ফজল বিষয়ে আমার বলার প্রচেষ্টা নিতান্তই ক্ষুদ্র। তবে আমি এতে তাঁর মজ্জার খবর তুলে আনার প্রয়াস চালিয়েছি। তবে সেই মজ্জানিসৃত শিল্প বর্ণনা এতো স্বল্প পরিসরে কোন মতেই সম্ভব নয়। কেবল বলতে চাই বাংলা কথাসাহিত্যে আবুল ফজল নিজের রাজ্যে রাজা হয়েই রইবেন। তাঁর সময়ে এতো দৃষ্টিপ্রসারী আমার জালে আটকায় নি। ফলে একজন পাঠক হিসেবে আবুল ফজলের কথাসাহিত্য বাংলাসাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদর্শক বলেই মানি। তিনি একজন নিখুঁতচারী চিন্তক।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবদিউল আলম চৌধুরী : এক প্রতিবাদী পুরুষের প্রতিকৃতি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামই জাতীয় অর্থনৈতিক সৌধের মূল ভিত্তিভূমি