হ্যাঁ এই ভর সন্ধ্যায় এই লেইক পাড়ে কোনো চায়নিজ ভূতের সাথে দেখা হলে যতোটা না চমকে যেতাম, অতোটা না হলেও মোটামুটি কাছাকাছি রকমই চমকালাম, শুনশান এই নির্জন এলাকায় ভর সন্ধ্যায় পুত্রের কণ্ঠস্বর কানে যেতেই।
ছোট বেলায় গ্রামে মানে দাদিবাড়ি নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে শুনেছিলাম এই বিশেষ সময়টা তেনাদের জন্য খুব উপযুক্ত সময়। তেনাদের মানে ভূত পেত্নিদের। ভর সন্ধ্যায় নাকি তেনারা নিজেদের আবাস তেতুল গাছ, তাল গাছ, পাকুড় গাছ ছেড়ে নেমে আসনে ভূমিতে হাঁটাহাঁটি করে হাওয়া খেতে। যার মানে হল ভরসন্ধ্যা মানে ভূতসন্ধ্যা অতএব এসময় একাকী অজায়গা কু–জায়গায় থাকা ঠিক না। আবার এসময় তেনাদের সরাসরি নামও নেয়া বিপজ্জনক। এখানকার ভুতেরা অই একইরম সময় মানে কি না, জানি না। কুনমিং লেইকপাড়ে অনেক গাছগাছালি থাকলেও তেতুল, পাকুড় বা তাল গাছ আছে কি না, জানি না। অবশ্য বাঙালি ভূত আর চায়নিজ ভূতদের আবাস একই গাছে হবে তা তো নয়। কিন্তু সময় হিসাবে এটা তাদের জন্য এক্কেবারে মোক্ষম সময়, একই ভাবে এলাকাটা এক্কেবারেই চূড়ান্ত নির্জন।
তেনাদের জন্য এরকম একটা মোক্ষম সময়ে কোনদিকে থেকে ভেসে এলো আমার পুত্রের গলা? কিম্বা আদৌ কি তারই গলা শুনেছি? এরকম ভাবনায় চূড়ান্ত দ্বিধাগ্রস্ত যখন, তখনই এই দিকটার গেইট মানে সামার প্যালাসের বাইন দুয়ারের দিকে যে গেইট আছে, তা থেকে প্রায় মিটার ৪০/৫০ দূরে বাঁয়ে যে প্রাচীন ঘুমটি ঘরজাতীয় ঘরটি আছে, যার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি এখন, তার বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়াল জ্যেষ্ঠ পুত্র।
কী ব্যাপার বাবা? তুমি কী করছো এখানে? বাকিরা সবাই কোথায়? ওকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বেরিয়ে এলো একই সাথে তুমুল উদ্বিগ্ন ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গলার ঐ প্রশ্ন সমূহ।
‘সবাই তো গাড়িতে। আমি এসেছি তোমাকে খুঁজতে।’ সামনের দিকে এগুতে এগুতে উত্তর দিল দীপ্র।
আমাকে খুঁজতে মানে? তুমি যে একা আসলে, মা কিছু বলেনি?
‘মা’ই তো আসতে বলল। তোমার দেরী হচ্ছে বলে’।
মেজাজটা বিগড়ে গেল কথাটা শুনে। এটা একটা কথা হল? এভাবে ওকে একাকী পাঠিয়ে দেওয়া, তাও এই চায়নায়? মনে ঐ সব ভাবলেও মুখে বললাম, তা ফোন করলেই তো পারত। তোমাদের গাড়িতে উঠিয়ে দেবার সময়ই তো বলেছিলাম যে অই পাড়ে একটু ঘুরতে যাচ্ছি। এ নিয়ে এতো খোঁজাখুঁজির কী হল?
‘মা’র ফোন তো এখানে কাজ করে না! মা বলছিল তুমি কেন এতো দেরি করছ?’
তা তো বুঝলাম, কিন্তু লি খাঁকে বললেই তো সে ফোন করতে পারত? তার ফোনে তো আমার নম্বরটা সেইভ করা আছে।
‘বলেছিলাম তো। কিন্তু আংকেল তো কিছু বোঝেন না। শুধু ওকে ওকে বলছিল। এক দুই বার মনে হয় ফোনও করেছিল দেখছি। মনে হয় পাচ্ছিল না তোমাকে। তাই তো মা আমাকে বলল তোমাকে খুঁজতে যেতে!’
নাহ, ভেতরের বিরক্তিটা এবার রাগে পরিণত হচ্ছে দ্রুত। নাহ আর ছেড়ে দেয়া যায় না। এরকম একটা অচেনা জায়গায় ভর সন্ধ্যাবেলায় ওকে এভাবে পাঠানোর কি মানে থাকতে পারে? কতবারই তো বলেছি এখানে কেউ আমরা বিচ্ছিন্ন হবো না ঘোরাঘুরির সময়। নাহ যাই থাকুক কপালে, স্ত্রীর এরকম অবিমৃষ্যকারিতার জন্য একটা গরম গরম একশনে যেতে হবে!
‘কী ব্যাপার? তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান আছে? কতোক্ষণ হল আমাদের এইখানে এইভাবে বসিয়ে রেখে হাওয়া খাচ্ছ নিজে লেইক পাড়ে? নাকি এখানেই আজকের রাত কাটানোর প্লান করছিলা?’
‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ এই স্ট্রাটেজিক তত্ত্ব কোনো নারী দিয়েছিলেন? নাকি পুরুষ দিয়েছিলেন জানি না। যদি তিনি নারী হয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয় ছিলেন উনি কারো স্ত্রী। তাই নিজে তা প্রতিনিয়ত প্রয়োগের সুফল ভোগের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন। আর উনি যদি পুরুষ হয়ে থাকেন, অবশ্যই ছিলেন তিনি বিবাহিত পুরুষ। তাই প্রতিনিয়ত কারণে অকারণে আক্রান্ত হয়ে ভুক্তভোগী হিসাবে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা থেকেই তিনি এই বোধি লাভ করেছিলেন। আর হবেই বা না তা কেন? হাওয়া বিবির হাত ধরেই যে বাবা আদমের জ্ঞান লাভ হয়েছিল, লেখা আছে তা সেই আদি পুস্তক নামে খ্যাত ওল্ড টেস্টামেন্টে। অবশ্য তাতে দুজনেরই স্বর্গচ্যুতি ঘটে মর্ত্য লাভ হলেও, এখন স্ত্রীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত জ্ঞানলাভে ব্যর্থ পুরুষের স্থান যে কোথায় হবে তা তো জানা নাই!
পুত্রসমেত গাড়ির কাছে ফিরে, তাকে পেছনের দিকে তুলে দেবার জন্য দরজা খুলতেই টাইফুন গতির ঐ স্ত্রী ভৎসর্নার মুখে এতক্ষণের মনের ভেতরের বীরপুরুষটি যাকে বলে এক্কেবারে বেক্কল বনে গেল আর কী! তবে বেক্কলেরও যে এ ব্যাপারে প্রবল হুঁশ থাকে, তার প্রমাণ হলো অকারণেই বিনা পূর্বাভাসে টাইফুনের মুখোমুখি হওয়ার পরও সে মুক ও বধির থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কথাই তো আছে ‘বোবার কোনো শত্রু নাই’।
এদিকে লি খাঁ ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেখছি, তাকিয়ে আছে আমার দিকে, হুকুমের অপেক্ষায়। যতোই ভাবলেশহীন মনে হোক না কেন তার চেহারা, এবং যতই না বুঝুক সে বাংলা ভাষা পেছনের সিট থেকে আসা টাইফুনের ঝাপটাটা মনে হচ্ছে সে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। নীরব ভাষায় মনে হচ্ছে সে বলছে,
‘জনাব, মন খারাপ করবেন না। এ ব্যাপারে আপনি আমি তো কোনো ছাড়, ঐ যে সামার প্যালেসে গেলেন যে সেই প্যালেসের রাজা সাহেবসহ সবাই আমরা আছি একই কাতারে।’
তার এই নির্বাক সান্ত্বনার বানী যতই শব্দহীন হোক না কেন, ব্যাপারটা বড়ই কানে লাগল! অতএব যতোটা পারা যায় নিজ মনে জমা হওয়া উষ্মা যথাসম্ভব চাপা দিয়ে বললাম, কী চাচা মিয়া ফ্যাল ফ্যাল কইরা চাইয়া আছেন কেন? চলেন, চলেন এখন হোটেলের দিকে। এখানে তো আর এ সময়ে ভাজার মতো কোনো ভেরেণ্ডা নাই। সাথে দিলাম হাতের ইশারাও তাতে গাড়ি সচল হয়ে ধীরেসুস্থে এক পাক ঘুরে সামার প্যালেসের বাইন দুয়ারের চত্বর ছেড়ে উঠল গাড়ি রাস্তায়। গাড়ির মধ্যে শুনশান নীরবতা। মাতাপিতার ঐ দ্বৈরথে পুত্ররা গিয়েছে এক্কেবারে চুপসে। আমিও তাই উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি উইন্ডশিল্ডের ওপাশে।
কুনমিং লেইক পাড়ে বিজলি বাতি কিছু থাকলেও ওখানে ছিল বরং প্রাকৃতিক আলোরই রাজত্ব। লোকজনও ছিল না তেমন। ফলে ঐ জায়গাটা নির্জন ভরসন্ধ্যার আবহ থাকলেও রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টগুলো সব এরই মধ্যে জ্বলে ওঠাতে, মনে হচ্ছে রাস্তায় এরই মধ্যে বুঝি রাতের অন্ধকার জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। গাড়িও আছে বেশ রাস্তায়। সামান্য একটু দূরত্বের ব্যবধানে এই রাস্তার আবহ আর লেইক পাড়ের আবহে ভালোই তফাৎ।
‘দাদা, এখান থেকে হোটেলে যেতে কতক্ষণ লাগবে, জিজ্ঞেস কর তো ড্রাইভারকে?’ গাড়ির ভেতরের অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে মাঝের সিট থেকে হেলেন জিজ্ঞেস করতেই, কিছুটা তিক্ত গলাতেই উত্তর দিলাম যে, এটা আর জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ আছে কি? তোর কি কোনো তাড়া আছে নাকি হোটেলে ফেরার? যখনই পৌঁছাবে পৌঁছাক না। রাতে তো খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর কাজ নাই আমাদের।
‘কেন বাবা, আমরা কি ঐ অ্যাপেল স্টোরে যাবো না?’ সতর্ক ভঙ্গির দীপ্রর এ প্রশ্নের ঘাড়ে ভর করেই যেন এসময় চলে এল রাস্তায় একটা জ্যাম। ফলে থেমে গেল গাড়ি। ‘যাহ! ইশ! এখনি আবার জ্যাম!’ অভ্রর নিম্নকণ্ঠ এই হতাশ উচ্চারণে মনে হল আচ্ছা, আমাদের রাগ বিরাগের কারণে এ বেচারাদের আনন্দ নষ্ট করি আর কেন? ফলে ওদের আশ্বস্ত করার জন্য বললাম আমার মনে হয় আমাদের লি খাঁ রাস্তাঘাট খুবই ভালো চিনে বেইজিং এর। চিন্তা করো না। জ্যাম বেশি হলে সে নিশ্চয় কোনো গলিটলি তে ঢুকে হলেও শর্টখাট মেরে নিয়ে যাবে হোটেলে। আমাদের পৌঁছে দিতে পারলেই তো তারও ছুটি। অতএব তাড়া তো তারও আছে। হোটেলে ফেরার পর যদি দেখা যায় দোকানপাঠ খোলা আছে, তবে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়বো অ্যাপেল স্টোরের দিকে। হোটেলে কিন্তু দেরি করতে পারবে না। ‘এই তো জ্যাম ছুটেছে মনে হচ্ছে।’ রাস্তার থেমে থাকা গাড়ির দিকে মনে হয় আকুল নয়নে তাকিয়ে ছিল এতোক্ষণ দীপ্র। তাই সামনের গাড়িগুলোর নড়ে উঠতেই সবাইকে আশ্বস্ত করলো এইমাত্র। অতপর জ্যাম ছোটার পর গাড়ি চলা শুরু করতেই দুই ভাই ফের ব্যস্ত হয়ে পড়লো এই আধো অন্ধকারে রাস্তায় চলমান গাড়িগুলো দেখে কোনটা কোন ব্র্যান্ডের তা আন্দাজ করার খেলায়। আর আমিও ভাবলাম, এই গাড়িবহুল রাস্তায় তো আর খুব জোরে গাড়ি ছোটাতে পারবে না লি খাঁ। তার উপর গত দুইদিনে তার গাড়ি চালানোর যে স্টাইল দেখলাম, তাতে মনেও হয় না যে সে আমাদের দেশের মাইক্রোবাস ড্রাইভারদের গতিউন্মাদ। অতএব এই ফাঁকে একটু ঝিমিয়ে নেয়া যাক। ভাবতে ভবতে দিলাম হেলান সিটে। নাহ খুব বেশিক্ষণ ঝিমুতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না। খুব জোর মিনিট পনের কী বিশ ঝিমিয়েছি মনে হয়। পেছন থেকে আসা পুত্রদ্বয়ের যুগপৎ হৈ চৈ য়ের কি কারণ তা বোঝার জন্য চোখ রগড়ে ঘাড় ঘোরাতেই, অভ্র বলল,
‘ঐ যে দেখো বাবা, এই রাস্তাটা দিয়ে আমরা আগে গিয়েছি না? আমি বলছি, কিন্তু ভাইয়া মানছে না।’ ‘আরে তাইতো, ঐ যে এই রাস্তাটা দিয়ে আমরা ঐ দিন হেঁটে গিয়েছিলাম মনে হয়। আরে ঐ যে, ঐ যে আমাদের হোটেল, অভ্র ইউ আর রাইট। বাবা, আমরা তাহলে আর রুমে যাবো না। হোটেলের সামনে নেমেই যাবো অ্যাপেল স্টোরের দিকে। ‘অভ্রকে নির্দ্বিধায় বিজয়ী মেনে নিয়ে করলো দীপ্র আব্দার। এরই মধ্যে আসলেই গাড়ি একটা পাশ রাস্তায় ঢুকে একটু সামনে গিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে হোটেলের পেছন দিকের রাস্তা ধরে সোজা এসে থামল এক্কাবারে হোটেলের সামনের ড্রপ অফ এর জায়গায়। সাথে সাথেই পাশ দরজা খুলে পুত্রদ্বয় গাড়ি থেকে নেমে, তাদের অত্যাসন্ন অ্যাপেল অভিযানের আনন্দে টগবগ করতে লাগলো উত্তেজনায়। ফলে ওদের সামলানোর জন্য আমিও নেমে পড়লাম দ্রুত। অতপর পেছনের সিট থেকে ধীরে সুস্থে হেলেন আর লাজু নামতেই, কাউকে নির্দিষ্ট করে কিছু না বলে, বললাম ঠিক আছে তোমরা যাও সবাই উপরে, আমি গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে আসছি। তারপর দীপ্র অভ্রকে নিয়ে বেরুবো অ্যাপেল স্টোরের উদ্দ্যেশ্যে। বলেই রওয়ানা করলাম কন্সিয়ার্জ কন্যা মিস ইনা কে খুঁজতে।
লবিতে ঢুকতেই, বা দিক থেকে মিস ইনার উল্লসিত কণ্ঠের, হ্যালো মিস্টার, গুড ইভিনিং শুনতে পেয়ে হাসি মুখে ওর কাছে গিয়ে, সে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম আজকের দিনটা খুব ভালোই গেছে। বলতে বলতে, মিস ইনার হাতে লি খাঁর পাওনা তুলে দিতে দিতে বললাম শোন, আগামীকাল আমাদের গাড়ি লাগবে না। আর পরশু দিন সকালে উঠেই ছুটতে হবে এয়ারপোর্টে সেদিন যেন আমাদেরকে লি খাঁ এয়ার পোর্টে ড্রপ দেয়।
‘ওকে নো প্রব্লেম।’ তুমি ওর সাথে কথা না বইলাই বললা, যে নো প্রব্লেম, আরে লি খাঁ এইরকম ছুটা ট্রিপ মারবে কি না সেটা জিগাও। বললাম অবশ্য কথা কটি ধীরে ধীরে ইংরেজিতে। ‘নো অরি। হি ইজ মাই এলদার ব্রাদার।‘হাসি মুখে নিশ্চয়তা দিল মিস ইনা!
লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।