দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে কর্ণফুলী নদী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ২০ জুন, ২০২২ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ


অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো কর্ণফুলী নদী। দেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড়ে হতে উৎপত্তি হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে শেষ হয়েছে। কর্ণফুলী নদী বা কথলাংতুইপুই নদী (মিজোরামে পরিচিত নাম) বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত ও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৭০ কিঃমিঃ, যার মধ্যে বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১৬১ কিঃমিঃ গড় প্রস্থ ৪৫৩ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। কাপ্তাইতে এই নদীর উপর বাধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যা দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প (যার লাইফটাইম ২০৪০ সাল পর্যন্ত। এরপর এই লেক ভরাট হয়ে পানির ধারণ ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে)। এখানে অতি অল্প মাত্র ৪৫ পয়সা/ইউনিট খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। যা সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব ও ইকো ফ্রেন্ডলি। এই বাধের ফলে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় যে লেকের সৃষ্টি হয়, তাতে রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। এই লেকে মাছ ধরে হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। লেকের পানি দিয়ে পুরা রাঙ্গামাটি জেলার পানির চাহিদা পুরণ ও চাষাবাদ করা হয়। অর্থাৎ পুরো রাঙ্গামাটি জেলার যাতায়াত ও অর্থনীতি এই লেকের মাধ্যমে আবর্তিত হয়। এই নদীর পানিকে রাংগুনিয়ায় অবস্থিত পানি শোধনাগারে পরিশোধন করে চট্টগ্রাম শহরে খাওয়ার পানি হিসাবে সরবরাহ করা হয়। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মংস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী এই কর্ণফুলী নদীর সাথে যুক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই নদীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো এই নদীর শেষ প্রান্ত অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। যার মাধ্যমে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০% কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বলা চলে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এই নদীকে ঘিরে। তাই এই নদীকে সচল ও বাঁচিয়ে রাখা এবং একে কঠোর নজরদারীর মধ্যে রাখা দরকার। তবে দখল ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই নদী দিনকে দিন জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিনিয়ত কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা কমছে। ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠনের জরিপে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে এই জরিপ পরিচালিত হয়। এতে আরো অংশগ্রহণ করেন কর্ণফুলী নদী গবেষক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, মেরিন ফিশারিজ একাডেমির খণ্ডকালীন শিক্ষক অধ্যাপক নোমান আহমেদ সিদ্দিকী। জরিপ সমীক্ষার প্রতিবেদনটি গত ২২ মে ২০২২ইং চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ২০০০ সালে কর্ণফুলি নদীর চাক্তাই খালের সংযোগ অংশে প্রস্থ ছিলো ৯৩০ মিটার। আর ২০২২ সালের মার্চ এপ্রিলে নদীর প্রশস্ততা হলো ৪১০ মিটার। অর্থাৎ গত ২২ বছরে নদীর প্রশস্ততা কমেছে ৫২০ মিটার বা ১৭০৬ ফুট।

তবে এই পরিমাপ ভাটার সময় করা হয়। প্রশস্ততার পাশাপাশি কমেছে নদীর গভীরতাও। নদীর বেশিরভাগ জায়গায় গভীরতা দুই থেকে সাড়ে তের ফুটে গিয়ে ঠেকেছে। তবে কোথাও গভীরতা সর্বোচ্চ ৭৮ ফুট পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়, ফ্যাদোমিটার ও ম্যানুয়েল (দড়িতে পাথর বেধে পরিমাপ) পদ্ধতিতে নদীর প্রস্থ ও গভীরতা পরিমাপ করা হয়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান তার বক্তব্যে নদীর বিভিন্ন স্থানের গভীরতা ও প্রশস্ততা তুলে ধরেন। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর গভীরতা পরিমাপ করা হয়। এতে চাক্তাই খালের মোহনায় নদীর গভীরতা ছিলো মাত্র ২ ফুট।

ওখানে চারপাশে পলি জমে চর জেগে উঠেছে ও খালটি সংকুচিত হয়েছে। রাজাখালী খালের মোহনায় গভীরতা পাওয়া গেছে মাত্র ৪ ফুট। শাহ আমানত সেতুর ১ ও ২ নং পিলারের মাঝে গভীরতা পাওয়া গেছে মাত্র ৭.৭ ফুট, অথচ এখানে গভীরতা থাকার কথা ২৫ ফুট (ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী)। ২ ও ৩ নং পিলারের মাঝে গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট। বাস্তবে ওখানে চর জেগেছে। ৩ ও ৪ নং পিলারের মাঝে গভীরতা থাকার কথা ৩৮ ফুট। ওখানে গভীরতা পাওয়া গেছে ৬৪.৭ ফুট। ৪ ও ৫নং পিলারের মাঝে গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট (চর পাথরঘাটা এলাকার মাপ অনুযায়ী)। ওখানে গভীরতা পাওয়া গেছে ৭৮.৬ ফুট, যা নদীর ফিরিঙ্গি বাজার হতে শিকলবাহা খালের মুখ (প্রায় ৩ কিঃমিঃ) এলাকার সবচেয়ে গভীরতম স্থান। ফ্যাদোমিটার দিয়ে পরিচালিত জরিপে এখানে পিলারের পাশে নদীর তলদেশের মাটিতে ফাটল দেখা গেছে। যা সেতুর জন্য উদ্বেগজনক। সংকীর্ণ গতিধারায় পানির স্রোতের কারণে সেতুর ৪ ও ৫ নং পিলারের নীচে ৭৮.৬ ফুটের বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে সেতুর দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি নদীর তলদেশের গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় তীরের মাটি ধসে সেতু ধসে পড়তে পারে। অবশ্য চর পাথরঘাটার ব্রীজঘাট থেকে উত্তরে নদীর ১০০ মিটার দূরত্বে গভীরতা পাওয়া যায় ২৫ ফুট। এখানে নিয়মিত ড্রেজিং করায় গভীরতা স্বাভাবিক পাওয়া যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দখল, অপরিকল্পিত খনন ও চাক্তাই খালের মুখে নদীর একটি অংশ মাছ বাজারের জন্য বন্দর কতৃপক্ষ ইজারা দেওয়ায় নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা কমেছে। সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, ২০১৫ সালে হাইকোর্টে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে কর্ণফুলী নদীর জেগে উঠা চর বা তীর দখল করে ২,১১২ টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালে এই স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়। উচ্ছেদের অংশ হিসাবে নগরের মাঝিরঘাট, লালদিয়া চরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলে। কিন্তু চাক্তাই ভেড়ামার্কেট ও সেতু এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় নি। ফলে ওখানকার অবৈধ বসতি রয়ে গেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর প্রবাহের এলাকা কমে যাওয়ায় সেতুর পিলারের নীচে নদীর তলদেশের মাটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলেন এটি সেতুর জন্য মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ। এ ছাড়া কয়েকটি পিলারের গোড়ার মাটি সরে যাচ্ছে বলেও তারা জানান। জরিপে নেতৃত্ব দানকারী চুয়েট অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত বলেন, নদীর দক্ষিণ দিকে পানির স্রোত বাড়ছে। আর উত্তর দিকে অর্ধেকের মত জায়গায় চর জেগেছে। পানি প্রবাহের জায়গা বা প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় স্রোতের বেগ বেড়ে গেছে। যার কারণে উত্তর দিকের পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এই জন্য উত্তর দিকে খননের পাশাপাশি ক্ষয়ে যাওয়া পিলারের গোড়ায় পাথরের আস্তরণ দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে চারটি সুপারিশ করা হয়। এগুলো হলো, পরিকল্পিত খনন, অবৈধ দখল মুক্ত করা, ইজারা দেওয়া ও ময়লা আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা এবং নদীর পাড়ে গড়ে উঠা অবৈধ বসতি ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা। তারা আরো বলেন, বিভিন্ন সময় ভাটার সময় দেখা যায়, কর্ণফুলীর সংযোগ খাল চাক্তাই ও রাজাখালীর মুখে মানুষে মলমুত্র মিশ্রিত কালো দুর্গন্ধময় পানিতে ভাসছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা বর্জ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন চাক্তাই ও রাজাখালী খাল হয়ে নদীতে পড়ছে কয়েক হাজার টন তরল ও কঠিন বর্জ্য।

এই সব বর্জ্যের কারণে প্রতিনিয়ত আশেপাশের নদীর এলাকা ভরাট হচ্ছে ও চর পড়ছে। আর এই সব চর দখল করে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা ও বসতি।তাই দেশ ও জাতীর বৃহত্তর স্বার্থে কাপ্তাই লেকসহ পুরো কর্ণফুলী নদীকে দুষণ ও দখল মুক্ত করতে হবে এবং কঠোর তদারকির মাধ্যমে এর গতিধারা, নাব্যতা ও প্রশস্ততা রক্ষা করতে হবে ও পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। না হলে লবণাক্ত পানির জন্য হালদা নদী যেমন গুরুত্ব হারাবে ঠিক তেমনি ওয়াসার পানি শোধনাগারও তার কার্যকারিতা হারাবে। তাই প্রয়োজন বোধে এই নদীর তদারকির জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই নদীর নাব্যতা ও প্রবাহ যত সংকুচিত হবে দেশের অর্থনীতিও তত সংকুচিত হবে। তাই এই নদীকে রক্ষার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে, এই প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুফিয়া কামাল : সাঁঝের মায়ায় বসে যিনি দেশের মানুষের জন্য মায়ার জাল বুনেছিলেন
পরবর্তী নিবন্ধমধ্যরাতে ম্যানোলা বাংলোয় কী ঘটেছিল