বহুমুখী সংকটে সংকুচিত হয়ে আসছে ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারী বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। এক সময় চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে সারাদেশে পণ্য পরিবহন হতো। কিন্তু ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, চেক প্রতারণা বেড়ে যাওয়া, নৌ পথে পণ্য পরিবহনে ধস এবং সরু সড়কে দিনভর যানজটের কারণে আগের জৌলুসে ধস নেমেছে বলছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কর্পোরেট সংস্কৃতির হাওয়ায় অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ খাতুনগঞ্জ থেকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তবে এরমধ্যে আশার কথা হলো– চাক্তাই খালের কর্ণফুলী মোহনায় নির্মিত স্লুইস গেটের সুফল পাচ্ছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা ও জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পেয়েছে ব্যবসায়ীদের দোকান গুদাম। স্লুইচ গেটের নির্মাণের আগে শুষ্ক মৌসুমেও চাক্তাই খাতুনগঞ্জ কেবল জোয়ারের পানিতে শুষ্ক মৌসুমেও তলিয়ে যেতো নিচু এলাকা।
খাতুনগঞ্জের কয়েকজন প্রবীণ ব্যবসায়ী জানান, চাক্তাই খাতুনগঞ্জে আগের জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হলে সড়ক প্রশস্ত করে যানজট কমাতে হবে। কারণ যানজটের কারণে বিভিন্ন ট্রাক কাভার্ডভ্যানের অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়। এছাড়া সড়কের পাশাপাশি নৌপথে পণ্য পরিবহন বাড়াতে হবে এবং ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন স্কেল প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ এই ওজন স্কেল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের আর মহাসড়কে ওজন স্কেল নেই। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ব্যবসায়ীরা এই ওজন স্কেলের কারণে একটি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছে না। অন্যদিকে অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা সেখানে ১৬–১৭ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করছে একই পরিবহন ভাড়ায়। যা ভোগ্যপণ্যের দামেও প্রভাব পড়ছে। এছাড়া এক সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আমদানিকারকরা চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে পণ্য গুদামজাত করে সারা দেশে সরবরাহ দিতেন। এখন সেইসব আমদানিকারকরা লাইটার জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ কিংবা যশোরের নওয়াপড়ায় পণ্য আনলোড করছেন, শুধুমাত্র সড়কপথে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে ছোট–বড় প্রায় ১০ হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। বাপ–দাদার আমল থেকেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে এই বাজারের ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পাওনা টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। এতে বিশ্বাসের বাণিজ্য বিশেষত্ব হারাচ্ছে, আবার বাজারের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
চাক্তাই আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটের কারণে চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ থেকে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া যানজট তো আছেই। জলাবদ্ধতার কারণে চালের বাজার ধীরে ধীরে পাহাড়তলীমুখী হয়ে যাচ্ছে। চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা না গেলে এ অবস্থা হয়তো চলতে থাকবে।
জানতে চাইলে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা বাণিজ্য কমে যাচ্ছে। এছাড়া যানজট তো লেগে আছেই। ফলে অনেক গাড়ির চালক চাক্তাই খাতুনগঞ্জে আসতে চান না। যারা আসতে রাজি হয়, তারা আবার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। বিশেষ করে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন স্কেলের কারণে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। তাই এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে আগের মতো পণ্য কিনেন না।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জামাল হোসেন বলেন, বর্তমানে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে সমস্যার শেষ নেই। অনেকে জানেন, মৌখিক বিশ্বাসই ছিল খাতুনগঞ্জের লেনদেনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বছরের পর বছর এই প্রথাই চলে আসছিলো। বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) বা চেকের বিনিময়ে বাকিতে দৈনিক ৮০০ থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন চলে এই ভোগ্যপণ্যের বাজারে। কিন্তু টানা কয়েকটি প্রতারণার ঘটনায় সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ফলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস আগের জায়গাতে না।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ–সভাপতি ও বিএসএম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবুল বশর চৌধুরী বলেন, খাতুনগঞ্জ শত শত বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী একটি ব্যবসায়িক হাব। এই খাতুনগঞ্জ থেকে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর সৃষ্টি হয়েছে। তবে বর্তমানে খাতুনগঞ্জ অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে বড় হচ্ছে অবকাঠামোগত সমস্যা। খাতুনগঞ্জ যুগের সাথে যুগোপযোগী করতে হবে। এই খাতুনগঞ্জে আমরা দেখেছি, কেবল রাস্তা উঁচু করা ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি।
লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী