“নদী কখনও উৎসমুখে ফিরে যায় না। কিন্তু উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নদী বাঁচে না। একইভাবে তরুণ প্রজন্মও উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বাঁচবে না। পরম্পরা বজায় রাখতে হবে। ইতিহাস জানতে হবে। রিসেট বাটন টিপে দেওয়াই যায়, তারপর কী হবে, সে বোধটুকুও থাকতে হবে।” –সুলতানা কামাল
তিনি যথার্থই বলেছেন। উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না। কিন্তু এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা প্রথম স্বাধীনতাকে প্রতিপক্ষ মনে করার কারণ কি? আর দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমার্থক করার চেষ্টা কেন করা হচ্ছে? দুটোর গুরুত্বকে একীভূত করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।
এই জুলাই আন্দোলনের পরে জেন–জি–দের কিছু কিছু ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। প্রথমত তারা মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করতে চাইছে না। এটা কেন? এটাই তো আমাদের ভিত্তি! এটাই আমাদের শিকড়। শিকড়হীন হলে তো যে কেউ যে কোনো সময় উপড়ে দিতে পারে! আর একটা ঘটনায় আমি হতবাক হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী শামসুন নাহার হলের দেওয়ালে আঁকা বেগম রোকেয়ার ছবির মুখে কালি মেখে দিয়েছে! সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেই ছাত্রী বলেছে এই ছবি দেখলে তার “ইরিটেট” লাগে! আবার কারো কারো বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে ইরিটেট লাগছে! পাঁচই আগস্টের পরও দেখেছি বেগম রোকেয়ার ছবিকে অশ্লীল বাক্যে বিদ্ধ করতে! সমস্ত আলো বন্ধ করে দিলে সামনে চলার পথ তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর ইরিটেট লাগছে বেগম রোকেয়ার ছবি! নারী জাগরণের প্রতিকৃৎ যিনি আজীবন যুদ্ধ করেছেন নারী শিক্ষার জন্য, নারীর অধিকারের জন্য। এসব কোন অন্ধকারের হাতছানি? আরো একটা দুশ্চিন্তায় পড়েছি আমাদের কাছাকাছি একটা স্কুল থেকে প্রতিদিন সকাল আটটার দিকে আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর ভেসে আসতো সেই সুর আর এখন আসছে না! কেন আসছে না? মন ভালো করতে পারছি না! কোনো কারণ কি আছে?
আজকে আমি লিখতে বসেছিলাম বেগম সুফিয়া কামালকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য। ২০ নভেম্বর ছিল তাঁর প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু লেখার জন্য বসে সামপ্রতিক কিছু বিষয় অনাহুতের মতো চলে এলো! বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের জননী সাহসিকা! তিনি ছিলেন আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রবর্তী সৈনিক। তিনি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হলেও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। বরং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনে গতি এনেছেন। ৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থান, ৭১–এর স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়! ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করলে তিনি মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। পাকিস্তান সরকার থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল জাতীয় পুরস্কার তঘমায়ে ইমতিয়াজ। ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর জুলুম নির্যাতন শুরু করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি নারীমুক্তি বিষয়ে বলতেন নারী মুক্তিই মানবমুক্তি! তিনি আজীবন সমতাপূর্ণ সমাজের জন্য সংগ্রাম করেছেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালির ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির কোনোভাবেই যেন ক্ষুণ্ন না হয় সে ব্যাপারেও ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি! সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে তিনি বহুমুখী কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা তাঁর কাছে যেমন পরামর্শের জন্য যেতেন তেমনি বিপদে আশ্রয়ও পেতেন তাঁর কাছে। তিনি সবার কাছে হয়ে উঠেছিলেন জননী সাহসিকা। আবার কারো কারো কাছে নির্ভরতার প্রিয় খালাম্মা।
অনেক ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তাঁর প্রথম জীবন কেটেছে। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। তাঁর জন্মের সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, আমরা জন্মেছিলাম, এক আশ্চর্য রূপায়নের কালে, প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁসের পুনরুত্থান, রাশিয়ার বিপ্লব, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য সংস্কৃতির নবরূপের সূচনা। এসবের শুরু থেকে যে অভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ আমাদের মনে ছাপ রেখেছে সুগভীরভাবে।
তাঁর শৈশব কেটেছে নানাবাড়ির নবাব পরিবারে। নবাব পরিবারের নবাবী চালচলনের চেয়ে তাঁর বেশি আকর্ষণ ছিল নবাব বাড়ির পাইক পেয়াদাদের আয়োজিত পুঁথিপাঠ, বেহালার সুর ও সংস্কৃতি চর্চার আয়োজনগুলো যা মাটি থেকে উঠে আসতো!
জাতির যে কোনো সংকটে জাতির অভিভাবকরূপে সংকট উত্তরণের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বেগম রোকেয়ার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। বেগম রোকেয়া তাঁকে আদর করে ডাকতেন ফুল কবি বলে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হয়েছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহচর্য পেয়েছেন। নারীর অধিকার ও জাতীয় সমস্ত ন্যায্য আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নারী মুক্তি মানেই মানবমুক্তি। এমন বিভ্রান্ত সময়ে তাঁকে মনে পড়ে। মনে হয় যেন কেউ কোথাও নেই! যারা চলে যান তাঁরা আর ফিরে আসে না। আমাদের জন্য জাহানারা ইমাম আর ফিরে আসবেন না, সুফিয়া কামাল ফিরে আসবেন না! তাঁদের পদচিহ্ন আঁকা আছে হৃদয় জুড়ে। সব অন্ধকার দূর হোক। আলোয় আলোয় ভরে উঠুক বাংলার বিস্তৃত প্রান্তর। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি আমাদের জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামালকে।