পর্ব–৩
(৫)
এখন আর খুব একটা বাড়ি যাওয়া হয় না। চাকরি করি, তাই দূরে থাকতে হয়। রোজ রোজ তো নয়ই, সপ্তাহান্তেও যাওয়া হয় না আর। কখনও কখনও বৃহস্পতিবার মায়ের ফোন আসে– বাড়ি আসব কিনা জানতে। আমি অফিসের কাজ, আরও নানা ব্যস্ততার কথা বলে তাকে এ সপ্তাহে বাড়ি যেতে না পারার কথা জানাই। আমরা দুজনেই বাড়ি যাওয়া নিয়ে এমন সুরে কথাগুলো বলি যেন সংসারের কোনো দরকারি কাজ সেরে নিচ্ছি। আমার বাড়ি যাওয়া নিয়ে তার প্রশ্নের সুর যেন বাড়িতে ‘তেল নুন’ আছে কিনা তা নিয়ে কেজো কথোপকথন; আর উত্তরে আমার কন্ঠও এমন সরল সাবলীল যেন আমি তার আহ্বান বুঝতেই পারিনি। ‘বাড়ি ফেরা’ কথাটার মধ্যে জড়িয়ে থাকা সান্নিধ্যের কাতর আকাঙ্ক্ষাটাকে আমরা দুজনেই আড়াল করি।
অনেকদিন পর সেদিন গিয়েছিলাম বাড়ি। যেতে যেতে সন্ধ্যা। আমার শৈশবের সেই মাটির ঘরটার একপ্রান্তে এখন লোহার ভারী সদরদরজা। বাড়িতে ঢোকার সময় আমাদের পুরোন বাড়ির কাঠের দরজাটার কথা মনে পড়ে গেল। দিনে কতবার যে কড়া নাড়ার শব্দে খুলতে হত সেটা! কেমন একটা ‘খটমট’ শব্দ হত সে দরজা খোলার সময়– মনে পড়ে। দুপুরের আগে আগে কেউ হয়ত একটু হলুদ নিতে আসত পাড়ার; কিংবা বিকেলে আমার বোনেদের বান্ধবীরা হয়ত আসত কারও বাড়ি থেকে মেহেদি পাতা তুলে আনার জন্য তাদের ডাকতে; অথবা সন্ধ্যার পর পাড়ার কোনো মাঝবয়সী মহিলা হয়ত আসত আমার মায়ের সাথে গল্প করতে। উঠোনের মাটির উনুনের পাশে সান্ধ্য রান্না করতে করতে মা তাদের সাথে গল্প করতেন। সেসব গল্পের কতসব বিচিত্র বিষয়– পাড়ার কারও কেচ্ছা কেলেঙ্কারী থেকে শুরু করে জ্বীন–ভূত, পীর–পয়গম্বর আরও কত কি! একটু দূরে লন্ঠনের হলুদ আলোয় মেঝেতে পাটি পেতে পড়তে বসা আমি আসলে পড়ার ভান ক’রে আড়ি পেতে তাদের গল্প শুনতাম। উনুনের আলো তাদের মুখে প’ড়ে আলো–ছায়ার একটা অপার্থিব অবয়ব ফুটে উঠত।
এভাবে সারাদিনে কতজন কত কাজেই না আসত আমাদের বাড়ি, আর প্রতিবার ‘খটমট খটখট’ শব্দে বেজে উঠত ঐ দরজার কড়াটা।
আমাদের বাড়ির এখনকার নক্সা করা ভারী লোহার দরজায় কোনো কড়া নেই আর…!
লোহার দরজা পেরিয়ে আরেকটা কাঠের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে যখন ঢুকলাম, তখন কেন জানি আঁধার মনে হল বাড়িটা– যদিও দুটো সাদা আলো জ্বলছিল। এটা একটা ডাইনিং স্পেস, পাশের ঘরটায় আব্বা–আম্মা থাকেন। বছর দেড়েকের বেশি হল বাড়ি ঢুকেই আমার প্রথম কাজ হচ্ছে ঐ ঘরটায় যাওয়া। ঘরটায় নানান ঔষধ, অনেকদিনের অ–ধোয়া কাঁথা–বালিশ আর ইউরিন এর গন্ধ মিলেমিশে একটা রোগ রোগ আবহাওয়া ঝুলে থাকে সবসময়। আলো সবসময় মৃদু করে রাখা হয় এঘরে। দিনের আলোতেও জানালাগুলো ভিড়িয়ে রাখা হয়– যেন ঘরের আলো ম্লান থাকে। আব্বা বেশি আলো নিতে পারেন না এখন। …হয়ত এভাবেই প্রস্তুতি চলে খুব গোপনে সেই চূড়ান্ত ক্ষণটার– আমরা বুঝতে পারি না, নাকি বুঝতে চাই না…। দেড় বছর ধরে তিনি এ ঘরের বিছানাতেই শুয়ে থাকেন সবসময়। শরীরের প্রায় পুরোটাই অবশ, কিন্তু সবই বোঝেন, সাড়া দেন সেইমত।
প্রতিবার বাড়িতে ঢুকেই আব্বার বিছানার পাশে একটা মোড়া নিয়ে বসি আমি। সেদিনও বসলাম। খেয়াল করলাম, তার ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে চাইছেন তিনি, কিন্তু পারছেন না। খুব কাঁপে হাতটা, আর প্রাণপনে তিনি সেটা থামানোর চেষ্টা করেন– যেন প্রবল কোনো কিছুকে অস্বীকার করতে চাইছেন। আমি হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরলাম। কথা বলতে গিয়ে তিনি যা বলেন তার কিছুই বুঝি না এখন, শুধু কেমন একটা যান্ত্রিক ঘরঘর শব্দ শুনি। আমার মা সেই কথাগুলো অনুবাদ করে দিলে সে মোতাবেক জবাব দিই। তার দু’চোখ এখন সবসময় জলে ভরা থাকে। পাশে বসলে বুঝতে পারি না– সেটা অশ্রু নাকি চোখের কোনো সমস্যা হয়েছে।
প্রথমদিকে খুব কষ্ট হত আব্বাকে এমনটা দেখে। প্রতাপশালী সিংহকে অসহায়, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান দেখলে যেমন করুণ একটা ব্যথাবোধ জেগে ওঠে বুকে– তেমন অনুভূতি হত। মনে পড়ত তার গম্ভীর, তীব্র হুংকারের কথা যা শুনে তার কর্মচারীরা, আমরা ভয়ে স্থির, নিষ্পন্দ হয়ে যেতাম। তিনি রাগতেন খুব কম, কিন্তু যখন রাগতেন– আমরা দেখেই বুঝতে পারতাম। সেদিন বাড়িতে প্রায় ইশারা–ইঙ্গিতে কথাবার্তা চলত আমাদের ভাই–বোনদের মধ্যে। বাড়িতে মায়ের সাথে আমাদের রাগ, অভিমান, ঝগড়া সবই চলত– কিন্তু আব্বা আসলে সব চুপ। আব্বার মুখটা থমথমে থাকলে সেদিন আরও চুপ সব।
এই মানুষটাই আবার আমাদের চমকে দিতে ভালবাসতেন। শৈশবে ডালিমকুমারের পঙ্খীরাজ ঘোড়া নিয়ে আমার তীব্র মোহ দেখে একদিন আমার ঘোড়ায় চড়ার শখ পূরণের জন্য মফস্বলের সবচেয়ে দক্ষ ঘোড়সওয়ারসমেত একটা জ্যান্ত ঘোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতে। দরজা খুলে ঘোড়াটা দেখে আর তা পাঠানোর কারণ শুনে কেমন প্রবল বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম, তীব্র আনন্দে কেমন রক্ত ছলকে উঠেছিল বুকের ভেতর– তা এখনও মনে পড়ে! সেই মানুষটিকেই ওভাবে অসাড় পড়ে থাকতে দেখে খারাপ লাগত প্রথমদিকে। মনে হত, যদি হঠাৎ মন্ত্রবলে সব ঠিক হয়ে যেত আবার! আবার তার কন্ঠের গর্জনে আমরা ভাই–বোনেরা ভয়ে চুপসে যেতে পারতাম শৈশবের আলোর প্রাচুর্যেভরা কোনো দিনে!
এখন কিন্তু আব্বাকে দেখে সেই কষ্ট মনে জাগে না আর। বরং মনে হয় তাড়াতাড়ি সব চুকে গেলেই ভাল। আম্মারও যন্ত্রণা জুড়ায়– কাজের লোক সাথে নিয়ে আর কত করবেন তিনি! আমিও আমার অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পাই!
মনে পড়ে, আম্মার খুব আগ্রহের একটা প্রশ্ন্ন ছিল ছেলেবেলায় আমার কাছে। প্রায়ই তিনি প্রশ্নটা করতেন।
– ‘বাবু, আমরা বুড়ো হলে আমাদের দেখবি তো?’
প্রশ্নটা করেই আগ্রহভরে আমার দিকে চেয়ে থাকতেন তিনি। আব্বা দূরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে মৃদু হাসতেন। তিনিও যে শুনছেন সব তা বুঝতে দিতেন না। আমি বুঝতাম আম্মা কি উত্তর আশা করছেন। কিন্তু আমার খুব সংকোচ হত তেমন উত্তর দিতে। প্রশ্নটা আর তার উত্তরের মধ্যে লেগে থাকা আবেগটুকুকে আড়াল করে উল্টো তাকেই প্রশ্ন করে বসতাম– ‘আমিতো দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়াব বড় হলে। পারবে তোমরা বুড়ো হলে আমার সাথে দেশ–বিদেশে ঘুরে বেড়াতে?’ আম্মা হাসতেন।
–একটা সময় ছিল যখন আমি নিবিড় একটা সংসারের স্বপ্ন দেখেছি। …সেখানে একজন মমতাময়ী নারী, দুরন্ত সন্তান, স্নেহময়ী পিতা–মাতা, শিউলি আর নারিকেল গাছের লাগোয়া সবুজে ছাওয়া একটা বাড়ি, আর সে বাড়িতে ‘সান্নিধ্যের কাতর আকাঙ্ক্ষা’য় অপেক্ষায় থাকা…
এখন হাসি পায় সেসব কথা মনে হলে! বাস্তবে ওসবের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকটভাবে চোখে পড়ে এখন।
–স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় এর পাত্র–পাত্রীগুলোর কার কি ভূমিকা হবে তা ঠিক করার আমি কে? প্রতিটা মানুষই তো তার নিজস্বতায় আলাদা– তবে বাস্তবে তাদের ভূমিকা ঠিক করার কি কোনো অর্থ আছে? কিছুদিন হয়ত তারা আমাদের আকাঙ্ক্ষার ভূমিকায় অভিনয় করে– পরে অন্তর্গত ভূমিকাটাই পালন করে। তা সে প্রেমিক–প্রেমিকা, স্বামী–স্ত্রী, সন্তান–সন্ততি, বাবা–মা যেই হোক না কেন। আমাদের আকাঙ্ক্ষার সংসার, প্রেম, সম্পর্ক শুধু আমাদের স্বপ্নেই থাকা সম্ভব!
আপনারা হয়ত হাসছেন আমার এসব কথাবার্তায়। হাসুন, কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, আমাদের সবার স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের গল্পের উপলব্ধিগুলো এমনই অর্থহীনতায় গিয়ে শেষ হয় না কি?
হ্যাঁ, এখন আব্বা আমার হাতটা ধরতে চাইলে একটা সুক্ষ্ম কৌতুকবোধ জাগে মনে। কে যেন হাসে ভেতরে। বলে-‘জীবনের সাথে জড়ানোর কি এমন আছে আবার? জীবন কি খুউব আকর্ষণীয়? সবাই তো মৃত্যুর আগেই একদিন ফুরিয়ে যায়, বাতিল হয়– তাহলে এত আকাঙ্ক্ষা কেন? বরং মৃত্যুই কি সম্ভাবনাময় নয়? এই বাতিল হওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের চিরাচরিত আখ্যানের বিপরীতে মৃত্যুই কি সম্ভাবনাময় নয়!
বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারিনা আব্বার পাশে। আমার কথা ফুরিয়ে যায়। এরপর চুপচাপ বসে থাকা…। কেমন একটা অস্বস্তি লাগে। কেমন একটা অপরাধবোধ মনে লেগে থাকে। রাত্রির কুয়াশায় নির্জন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর মতো আমার সেই অনুভূতি– বিষন্ন, একাকী, কুয়াশাঘেরা। আমি তাকে বুঝি না। নাকি বুঝতে চাই না বলেই কুয়াশায় ঘিরে রাখতে চাই!
একসময় কাপড় পাল্টানোর কথা বলে ওখান থেকে উঠে আমি আমার ঘরে চলে আসি। আমার ঘরটা এখন দোতলায়, ঠিক আমার শৈশবের সেই মাটির ঘরটার উপরেই। কিন্তু ঘরে দাঁড়াই না আমি, ব্যাগটা রেখেই ছাদে চলে যাই। ছাদটা অন্ধকার, তবু আলো জ্বালাইনা ছাদের। ছাদের ঠিক সেইখানটায় গিয়ে দাঁড়াই, যেখানে সবসময় এসে দাঁড়াই আমি। ছাদের এই স্থানটা একটা আশ্রয়ের মত আমার কাছে। পূবদিকের কয়েকটা একতলা বাড়ির উপর দিয়ে বারবার দেখা সেই আমবাগানটার দিকে তাকাই। বাগানটা চারিদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে এখন– আমার ছেলেবেলায় চারিদিক খোলা ছিল। জায়গায় জায়গায় বেশ কিছু আলো দিয়েছে, তাই কিছু জায়গায় আলো আর বাকি সবটুকু জুড়ে আঁধার ছড়িয়ে আছে সেখানে। মাঝখানে পাঁচিলহীন খোলা কয়েকটা থামের উপর লোহার পাত দিয়ে বাঁধা আলতো আলোকিত টিনের একটা শক্ত চালাঘর দেখা যাচ্ছে।
(চলবে)