চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে সিটি গেইটের আগে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের লাগানো পূর্ব পার্শ্বেই রয়েছে একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন হাট। যার নাম কর্ণেল হাট।
প্রাচীনকাল থেকেই নগরীর উত্তর–পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন কাট্টলী নামক অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠে। নগরায়নের ফলে সেই কাট্টলী দুটো ওয়ার্ডে বিভক্ত হয়ে উত্তর কাট্টলী ও দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড হিসাবে তৎকালীন পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের আজকের আলোচ্যবিষয় উত্তর কাট্টলীর ঐতিহাসিক ও প্রাচীন কর্ণেল হাট কীভাবে স্থাপিত হলো এবং এর নামকরণইবা কর্নেল হাট কেন? অর্থাৎ কার নামে এই হাট বা কর্নেল হাটের কে এই কর্নেল?
কাট্টলী ও তৎসংলগ্ন এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে কী কারণে বা কীভাবে এই হাট স্থাপিত হয়। এলাকায় গুঞ্জন বা লোকমুখে কাহিনি রয়েছে, একদা উত্তর কাট্টলীর লোকজন পাশের জোলার হাট (বর্তমানে আবদুল আলী হাট) থেকেই সওদাপাতি করতেন। এভাবেই চলছিল উত্তর কাট্টলীর মানুষের সপ্তাহিক হাটবাজার। কিন্তু এক মর্মান্তিক দুঃখজনক ঘটনায় নাকি কর্ণেলহাটের উৎপত্তি। তৎকালীন সময়ে মুসলমানরা মোহরম মাসের দশমদিবসে তাজিয়া মিছিল বের করত। মঞ্জিল সাজিয়ে হায় হোসেন, হায় হোসেন মাতম করে তাজিয়া মিছিল সহকারে রাস্তাঘাট প্রদক্ষিণ করে ঈদগাঁ ময়দান, দেওয়ান হাট বা প্যারেড ময়দানে জড়ো হয়ে তা শেষ করত।
১৯৪৩ সালে উত্তর কাট্টলী থেকে এমনি এক তাজিয়া মিছিল যাবার সময় জোলার হাটের মিছিলকারীর সাথে ভুলবোঝাবুঝি ফলে বিবাদ ও সংঘর্ষ হয় এতে দুঃখজনকভাবে উত্তর কাট্টলীর ফররুখ আহমদ নামে এক ব্যাক্তি গুরুতর আহত হয়ে মারা যায়। এই অপ্রীতিকর ঘটনার প্রতিবাদ হিসাবে উত্তর কাট্টলীর লোকজন ঢাকা রোড়ের পাশে নাজির বাড়ির মালিকানাধীন জায়গায় একটি হাট স্থাপন করে এবং পরবর্তীতে এটি কর্ণেলহাট নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতার প্রমাণ নাই।
কর্নেলহাট স্থাপন সম্পর্কে ইতিহাস ও ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ অন্য কথা বলে। প্রায় আজ থেকে দুশো বছর আগে ১৮১৮ সালের দিকে চট্টগ্রাম শহরের মানচিত্রে কর্ণেল কা হাট নামে এই হাটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
অতীত চিত্রে চট্টগ্রাম গবেষণা গ্রন্থে বলা হয় ব্রিটিশ ও চসিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ১৮১৮ সালের চট্টগ্রাম শহর মানচিত্রে এই কর্ণেল কা হাটের অবস্থান সুস্পষ্ট। তাহলে ধরে নিতেই হয় কর্ণেল হাট অষ্টাদশ শতাব্দীর একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক হাট।
এবার আসা যাক এই হাটের নাম কর্ণেল হাট হল কীভাবে কিংবা এই কর্নেলই বা কে ছিলেন। কর্নেল হাট থেকে পশ্চিমে সমুদ্র পাড় পর্যন্ত উত্তর কাট্টলীর প্রধান সড়কটির নাম রয়েছে কর্ণেল জোন্স রোড়। কিন্তু এই জোন্স সাহেব কর্ণেল ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিচারপতি। তাঁর নাম জাস্টিস স্যার উইলিয়াম জোন্স। ভুলবশত এই রোডটি কর্ণেল জোন্স রোড নামে পরিচিতি পায়। ঐ জোন্স সাহেব যেহেতু কর্ণেল ছিলেন না, সেহেতু তাঁর নামে এই হাট হবার কথা নয়। আরেকজন সামরিক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বাধিনায়ক হিসাবে অল্পকিছু দিন কর্মরত মেজর এডওয়ার এলার্কার। তিনি যেহেতু সে সময় কর্ণেল নন, তাহলে তাকেও ধরে নেয়া সমীচীন হবে না। তবে যে ব্যক্তিটি যথার্থ বলে অনেকটা নিশ্চিত, তিনি হলেন লে: কর্নেল জন এরস্কিন। ১৭৯৪ সালে লে: কর্ণেল জন এরস্কিন চট্টগ্রামে বর্মী সেনাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও আক্রমণ টেকাতে তিন ব্যাটালিয়ন সেনা ও গোলন্দাজ বাহিনীসহ কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামে সেনা অধিনায়কের দায়িত্ব নেবার পর পরই তিনি কর্ণেল পদে পদোন্নতি পান। কর্ণেল জন এরস্কিনই একমাত্র উচ্চ পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা যিনি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পদ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। পুরাতন দলিলপত্রে পাওয়া যায়, সেনা প্রধানের নিয়ন্ত্রণে তাঁর সময়কালে চট্টগ্রামে মিলিটারি বাজার নামে এক ধরনের বিশেষ বাজার চালু ছিল, যা থেকে সেনা সদস্যরা বিনা শুল্কে জিনিসপত্র ক্রয় করতেন। এইরূপ মিলিটারি বাজার হিসাবে কর্ণেল জন এরস্কিন এর নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে তাঁরই পদবি মতে উত্তর কাট্টলীর কর্ণেল হাটটির নামকরণ হয়েছে বলে ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই থেকে আজ অবধি প্রায় দুশত বছর উত্তর কাট্টলীর কর্ণেল হাট নামে পরিচিতি। তবে বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই হাটকে বহুতলা ভবন করে সিটি কর্পোরেশন কর্নেলহাট বাণিজ্য বিতান নামকরণ করেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক