দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে কক্সবাজার–মহেশখালী নৌপথে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলো আধুনিক সি–ট্রাক সার্ভিস। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় নতুন এই যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে মহেশখালীর মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থায় যুক্ত হলো এক নতুন দিগন্তের। এদিন কক্সবাজার শহরের ৬নং জেটিঘাট থেকে ছেড়ে আসা ২৫০ জনের অধিক যাত্রী নিয়ে সি–ট্রাকটি ১০ কিলোমিটার সমুদ্রপথ মাত্র ৩৫ মিনিটের নির্ধারিত সময়েই মহেশখালী জেটি ঘাটে পৌঁছায়। বিআইডব্লিউটি’র পরিচালক (প্রশাসন) একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, আজ (গতকাল) থেকে কক্সবাজার–মহেশখালী নৌপথে পরীক্ষামূলক সি–ট্রাক চালু হয়েছে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করবে।
সি–ট্রাকের যাত্রা শুরু উপলক্ষে উপস্থিত যাত্রীরা আনন্দ, উল্লাস এবং আশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নতুন এক অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিআইডব্লিউটি’র পরিচালক (বন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিন, যুগ্ম পরিচালক সবুর খান, উপপরিচালক (চট্টগ্রাম দপ্তর) মো. কামরুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক মো. খায়রুজ্জামান প্রমুখ। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ২৫ এপ্রিল থেকে নিয়মিত যাতায়াত করবে সি–ট্রাকটি। যাত্রীপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ হতে পারে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা। নৌপথটিতে শতাধিক দ্রুতগতির নৌযান স্পিডবোট, কয়েকটি কাঠের নৌকা ও লোহার গামবোট যাত্রী নিয়ে চলাচল করে আসছে। স্পিডবোটে ১০ কিলোমিটারের নৌপথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৮ থেকে ৯ মিনিট। আর কাঠের ট্রলার ও গামবোটের লাগে ৪০ মিনিট। সন্ধ্যা ৬টার পর এই নৌপথে স্পিডবোট ও গামবোটের চলাচল বন্ধ থাকে। ১০ জন ধারণক্ষমতার স্পিডবোটের জনপ্রতি ভাড়া ৯০ টাকা, আর ৪০ জন ধারণক্ষমতার গামবোটে ভাড়া ৩০ টাকা করে।
সি–ট্রাকটিতে যাত্রী হয়ে কক্সবাজার থেকে মহেশখালী আসেন মহেশখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে সি–ট্রাক ভিড়েছে মহেশখালীতে। স্থাপন করা হয়েছে পল্টুন। মহেশখালীর মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। জনগণের দুর্ভোগ লাগব করতে আমরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবো।
সি–ট্রাকের প্রথম যাত্রায় ছিলেন মহেশখালীর বাসিন্দা এবং মৎস্য ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারক আবদুস শুক্কুর। তিনি বলেন, মহেশখালীর ৫ লাখ মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হলো। সি–ট্রাক চালুর মাধ্যমে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ লাঘব হবে। এখন উত্তাল সাগর এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও মহেশখালীর যাত্রীরা কক্সবাজার শহরে নিরাপদভাবে পারাপারের সুযোগ পাবেন। ন্যায্যমূল্য পাবে মহেশখালীতে উৎপাদিত মিষ্টি পান, লবণ ও চিংড়ি চাষিরা। পর্যটকেরাও নিরাপদে মহেশখালী দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ পাবেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মহেশখালীতে একটি নির্ভরযোগ্য ফেরি বা সি–ট্রাক সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন দ্বীপবাসী। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও প্রশাসনিক প্রয়োজন মেটাতে কক্সবাজার জেলা সদরে যাতায়াত করেন। কিন্তু নৌপথে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবহনের অভাবে বরাবরই জনদুর্ভোগ ছিল তীব্র। বিশেষ করে, দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ছোট ট্রলার, স্পিড বোট ও কাঠের নৌকায় যাতায়াত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
গত বছর ৫ আগস্ট মহেশখালীর ছাত্র–জনতা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর নড়েচড়ে বসে। এরপরই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সি–ট্রাক চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। পন্টুন স্থাপন, ঘাট উন্নয়ন এবং যাত্রার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর অবশেষে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা হয়। সি–ট্রাক মূলত একটি মাঝারি আকারের, দ্রুতগামী ও সুরক্ষিত নৌযান। যা যাত্রী ও হালকা পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এতে আধুনিক আসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তামূলক ফ্লোটেশন যন্ত্রপাতি এবং ভারী ঢেউ প্রতিরোধে সক্ষম প্রযুক্তি যুক্ত থাকে। সি–ট্রাক চালুর ফলে বিশেষ করে অসুস্থ, শিশু ও নারীদের যাতায়াতে স্বস্তি আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ঘাটে উপস্থিত যাত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, আগে ট্রলার ধরে যেতে হতো। কখনও ভয়ে উঠতে চাইতাম না। আজকে এই ট্রাকে আসতে পেরে মনে হলো এটাই চেয়েছিলাম। মহেশখালীর কলেজছাত্র মাহফুজুর রহমান বলেন, আমাদের সময় বাঁচবে। ঝুঁকি কমবে। এটা এক বিশাল অগ্রগতি।