হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৭ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা সম্পর্কে যত জানছি, ততই অবাক হচ্ছি। একেবারে শূন্য থেকে শুরু, আর কোথায় তার উত্থান। সাত বছর বয়সে সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মা কুমুদিনী দেবী মারা যাবার পর রণদা প্রসাদ সাহার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। বেঁচে থাকার জন্যে অনেক কষ্ট করতে হয় তাকে, ১৬ বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়। জীবন ও জীবিকার কারণে সেখানে তাকে কখনো হকার, কখনো রিক্সা চালিয়ে, কখনোবা শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হয়। এমনও দিন তার গেছে যখন পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে গেছেন। নিজের জীবনকে বাজি রেখে পরকে সাহায্য করা বুঝি তার রক্তে। একবার কলকাতার এক রেল স্টেশনে তিনি পত্রিকা বিক্রি করে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন একটি শিশু প্লাটফর্মের রেল লাইনে পড়ে গেছে। লোকজন জড়ো হয়েছে বটে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না ওই শিশুটিকে বাঁচানোর জন্যে। অন্যদিকে এগিয়ে আসছে ট্রেন। রণদা প্রসাদ তড়িৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করলেন শিশুটিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মেডিকেল-কোরে যোগ দিয়ে বাগদাদ চলে যান। সেখানেও তিনি ক্যাম্পের এক ভহাবহ অগ্নিকাণ্ডে নিজের জীবন বাজি রেখে ২০ জন আহত সৈনিকের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে রণদা ফিরে এলেন কলকাতায়। তারপর শুরু করেন ব্যবসা। সেই যে শুরু আর তাকে পিছু তাকাতে হয়নি। দাঁড়িয়ে যান নিজ পায়ে। অঢেল অর্থের মালিক তখন তিনি। কিন্তু ভুলে যাননি চিকিৎসার অভাবে তার মায়ের মৃত্যুর কথা। দেশে ফিরে এসে ১৯৩৮ সালে মায়ের নামে তৈরি করলেন ২০-বেডের ‘কুমুদিনী হাসপাতাল’, যাতে তার মায়ের মত আর কোন নারী চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়, যাতে গরিব জনগণ চিকিৎসা পায়। আজ সেই হাসপাতালে প্রায় হাজার খানেক বেড। বিনা অর্থে চিকিৎসা দিয়ে চলেছে আজ অবধি। যত তার কথা শুনছি ততই তার প্রতি মাথা নত হয়ে আসে। আমাদের আশপাশে অনেক অর্থবানকে দেখি। তাদের কারো কারো রণদা প্রসাদের চাইতেও অনেক বেশি অর্থ, সম্পদ। কিন্তু রণদা প্রসাদ সাহার যা ছিল তা তাদের মাঝে নেই। সেটি মানবপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও অসহায়ের জন্যে সহায় হবার মনোভাব। যেটি ছিল রণদা প্রসাদ সাহার। আর এই জন্যে রণদা, রণদাই।
গেল জুলাই মাসের এক রৌদ্রস্নাত সকালে রণদা প্রসাদ সাহা স্থাপিত জনগণের কল্যাণে নির্মিত এই বিশাল ‘কুমুদিনী কমপ্লেক্স’ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর মুগ্ধ ও অবাক হচ্ছিলাম। কিন্তু আমার জন্যে যে আর এক ‘সারপ্রাইস’ অপেক্ষা করছিল তা জানতাম না। আমাদের ঘুরে ঘুরে এই অবাক করা প্রতিষ্ঠান দেখাচ্ছিলেন কুমুদিনী ট্রাস্ট্রের প্রকৌশলী, মৃদুল কান্তি বড়ুয়া। সেখানেই থাকেন স্ত্রী সহ। স্ত্রী আভা বড়ুয়া দীর্ঘদিন ভারতেশ্বরী হোমস্‌েস শিক্ষকতা করে এখন অবসরে আছেন। তাদের দু’সন্তান- মেয়ে প্রতিষ্ঠা ও ছেলে প্রত্যয়। দুজনেরই বেড়ে ওঠা এই ভারতেশ্বরী হোমস্‌েস। আমাদের নিয়ে মাইক্রোবাসটি যখন কুমুদিনী ট্রাস্ট্রের মূল ফটকে পৌঁছায় তখন দারোয়ান এসে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাব। বলা হলো, মিঃ বড়ুয়ার বাসায়। গেইট খুলে গেল। তখনই জানলাম ভারতেশ্বরী হোমস সহ যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে সবার নাম ধরে ডাকা হয়। নামের আগে মিস্টার বা মিস, কাউকে স্যার বা ম্যাডাম না, এমনকী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের শিক্ষিকাকে মিস মিনতি বা মিস করবী বলে ডাকে। বিষয়টি জানা ছিল না।
জানালো আমাদের দলে থাকা প্রতিষ্ঠা। যাই হোক, গেইট খোলা হলে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে নির্দিষ্ট বাসার দিকে। লোহগঞ্জ নদীর (যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে) পাড়ে সারিবদ্ধ পাকা দো-তলা বাসা। অনেকটা পুরানো ধাঁচের। মনে হলো শান্তিনিকেতনী স্টাইলে। শিক্ষক, বোধকরি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও থাকার আবাসন। এক একটির এক এক নাম। কোনটির নাম ভবানী ভবন, কোনটির খগেন্দ্র কুঠীর। আমাদের লক্ষ্য খগেন্দ্র কুঠীর। প্রতিটি বাসার সামনে ছোট বাগান, তাতে ছোট-বড় গাছ। বাসার সামনে নিজেদের গাড়ি-রাস্তা। পাশেই উঁচু পাকা দেয়াল। দেয়ালের অপর পাশে বহমান স্ত্রোতধারা। সেটি পার হবার জন্যে আছে একটি কাঠের নৌকা। সেটি বাঁধা একটি শক্ত রশির সাথে। সেটি টেনে টেনে পৌঁছুতে হয় অন্য পাড়ে। পারাপারের জন্যে আছে দুজন লোক। ওপারে পৌঁছেই ঘাট থেকে উঠে গেছে পাকা সিঁড়ি। দশবারটি সিঁড়ি পেরোলেই গ্রিল দেয়া পাকা গেইট। ভেতরে দৃষ্টিনন্দন মন্দির তাতে দুর্গাপূজা সহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়, তাতে অংশ নেয় ভারতেশ্বরী হোমস সহ কুমুদিনী ট্রাস্ট্রের অধীনে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান তার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অন্যান্য সদস্যরা। আসেন ঢাকা থেকে সরকারি কর্মকর্তা, কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠানের জন্যে আছে মাথার উপর ছাদ দেয়া বড় আকারের উন্মুক্ত হল। পাশেই ‘আটচালা ঘর’ বা ‘ট্রাডিশনাল হাউস’। জানা যায় এই ঘরটি রণদা প্রসাদ সাহা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন তার দাদার (বাবার বাবা) কাছ থেকে। ছোট আকারের কাঠ ও বাঁশের তৈরি এই ঘরের সাথে জড়িয়ে আছে তার অনেক স্মৃতি। ছিমছাম গোছানো এই ঘরে ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন আর পি সাহা। অবাক হই অসাধারণ এই ব্যক্তিটির কী সাধারণ চালচলন। একেই বুঝি বলে ‘শেকড় ভুলে না যাওয়া’। আমরা তো দু-পয়সা কামালে মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে পারিনা। কেউ কেউ বলে এই সমস্ত দেখে কী লাভ! তাদের বলি, লাভ এই তুমি অর্জন করছো শিক্ষা। ‘আটচালা ঘর’ পেরিয়ে পেছনের দিকটায় দেখি একটি বজরা। আদি বজরাটি কাঠের হলেও এখন এটি স্টিলের তৈরি। ২০০৮ সালে মূল বজরার আদলে এই বজরা নির্মাণে হাত ছিল আমাদের গাইড মি: বড়ুয়ার। বজরার কাছাকাছি ২৭ ফুট উঁচু, ১৭ ফুট লম্বা ও ১৭ ফুট প্রস্থের বিখ্যাত ধামরাই-রথ। কয়েকশত বছরের পুরানো এই রথে ছিল খোদাই করা হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি ও নানা শিল্পকর্ম। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ঐতিহাসিক রথটি জ্বালিয়ে দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে দানবীর রণদা প্রসাদ ছিলেন এই রথযাত্রার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তার অবর্তমানে এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তার কন্যা জয়া পাতি।
শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম আমার জন্যে যে ‘সারপ্রাইস’ অপেক্ষা করছে তা জানা ছিল না। আমাদের গাইড ইঞ্জিনিয়ার মৃদুল বড়ুয়া আমাদের নিয়ে গেলেন বিশাল ভারতেশ্বরী বিদ্যালয়ে। গেইট পেরিয়ে ঢুকতেই মুগ্ধ হতেই হবে আপনাকে। বিশাল ভারতেশ্বরী হোমসসের দৃষ্টিনন্দন ভবন। সেই ১৯৩৮ সালে রণদা প্রসাদ সাহার স্ত্রী কিরণ বালা সাহা এর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছিলেন। মনে পড়ে এই অন্যন্য বিদ্যাপীঠ স্কুল-বয়সে আমাদের বেশ আকর্ষণ করতো, বিশেষ করে এর মেয়েরা। মেয়েদের হাঁটুর নিচ অবধি সাদা-গভীর নীল রংয়ের ড্রেস, শরীরের উপরের অংশে সাদা জামা, সবার একই স্টাইলে মাথার চুল বেণী করা, পায়ে জুতো- দেখতে আমাদের খুব ভালো লাগতো। এই প্রতিষ্ঠানের পড়াশুনা, কঠোর নিয়মাবলী, স্বাবলম্বী হয়ে উঠার নাম ছিল ভারতেশ্বরী হোমস। দেশের নানা জাতীয় দিবসে স্কুল-ড্রেস পড়া ভারতেশ্বরী হোমসসের মেয়েদের শারীরিক কসরৎ ছিল দেখার মত। আমাদের স্কুল বয়সে মেয়েরা অত স্মার্ট ছিলনা, যেমনটি ছিল ভারতেশ্বরী হোমসসের মেয়েরা। রেসিডেন্সিয়াল এই স্কুলটিতে ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষা দেয়া হয় বলে শুনেছি। এখন প্রায় ১২০০ ছাত্রীর থাকা-খাওয়া ও পড়াশুনার ব্যবস্থা রয়েছে ভারতেশ্বরী হোমসসে। বিদ্যালয় ভবনের সামনে বিশাল মাঠ। গেইট গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বিদ্যালয়ের সাইজ দেখে আমার অবাক হবার পালা। হঠাৎ দেখি আমাদের গাইড নেই। তিনি কোথায় উধাও হয়েছেন আমাদের না-জানিয়ে। মিনিট কয়েক বাদে আবার দেখি তিনি ফিরে আসছেন, সাথে শাড়ি আর সাদা এপ্রোন-জাতীয় কোট পরনে এক মহিলা। অনুমান করি, শিক্ষিকা। মহিলা কাছে এসে হাত জোড় করে নমস্কার করার আগেই আমাকে এক পলক দেখে বলে উঠলেন, ‘আপনি কি বিকাশ?’ নামের শেষ অংশ উচ্চারণ করার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘তা আমি বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া বটে, কিন্তু আপনি, এই মির্জাপুরে আপনার অবস্থান, আমাকে চেনেন কী করে? ইঞ্জিনিয়ার মৃদুল বড়ুয়া পরিচয় করিয়ে দিলেন,বললেন, ইনি ভারতেশ্বরী হোমসসের বর্তমান প্রিন্সিপাল। নাম ত্রয়ী বড়ুয়া। মৃদু হেসে ত্রয়ী বড়ুয়া বললেন, ‘দৈনিক আজাদীতে আপনি তো নিয়মিত লেখেন, সেই সূত্রে।’ সে তো চাটগাঁ, আপনি থাকেন ঢাকা। উত্তরে বলেন, ‘এখানে যোগ দেয়া আমার খুব বেশিদিন হয়নি।’ ‘আপনার কথা বলায় মিস ত্রয়ী বড়ুয়া বোর্ড মিটিং ফেলে চলে এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে,’ জানালেন আমাদের গাইড। মিস ত্রয়ী বড়ুয়াকে ধন্যবাদ জানাই। আর ধন্যবাদ জানাই দৈনিক আজাদীকে। মনে মনে বলি, ‘জয়তু আজাদী, যুগ যুগ জিয়ো, তুম জিয়ো হাজারো সাল’। অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন ত্রয়ী বড়ুয়া, জনা কয়েকের নাম বললেন যারা আমাদের দুজনেই চেনা। তার মধ্যে অন্যতম, আমার শিক্ষাগুরু ও নিকট আত্মীয়, কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক বিমল কান্তি বড়ুয়া। ত্রয়ী বড়ুয়া জোর করলেন তার বাসায় বিকেলে যাবার জন্যে। ইচ্ছে ছিল যাই, তার সাথে বসি, আলাপ করি, তাতে এই বিদ্যাপীঠের আরো অনেক কিছু জানা যেত। কিন্তু সময় যে আমার বরাবরের বৈরী।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদোষীদের শাস্তি কার্যকর করে সড়কে নিরাপদ জীবন চাই
পরবর্তী নিবন্ধগণতন্ত্র ও মানবাধিকার : রহস্যাবৃত অপাঙক্তেয় সবক