হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৮ মে, ২০২১ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

‘এই পৃথিবীতে আমি একা এসেছি, মৃত্যুর ছায়া উপত্যকায় হেঁটেছি আমি একা এবং যখন সময় আসবে তখন আমি একাই চলে যাব’
– মহাত্মা গান্ধী।

সে কথা মানলাম। সময় এলে যেতে হবে এবং একা। নীরবে যাব চলে, তাও মানলাম। কিন্তু যে-মৃত্যু অসময়ে ঘরের চৌকাঠে এসে উপস্থিত এবং কিছু টের পাবার আগেই ডেকে নেয়, চিরকালের তরে, তাকে মেনে নেই কীভাবে। তেমনি বড্ড অসময়ে মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে গেল সহ-কলমযোদ্ধা মজনু ভাইকে, পুরো নাম সাখাওয়াত হোসেন মজনু। দৈনিক আজাদীর এই উপ-সম্পাদকীয় পাতায় তিনি আমার এবং আরো জনা-কয়েকের মত ফি-হপ্তায় লিখতেন। অনেকটা একই সময় থেকে আমাদের দুজনের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় লেখা শুরু, সেই ১৯৯০ সাল থেকে। আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের হাত ধরে। আজ থেকে প্রায় ৩১ বছর আগে ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে হল্যান্ড আসার পর পর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধু ও সহকর্মী বিশিষ্ট লেখক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের (প্রয়াত) অনুপ্রেরণায় দৈনিক আজাদীতে আমার লেখা শুরু। তখন তিনি (মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর) ঢাকায় বসে দৈনিক আজাদীর একটি ‘পাতা’ সম্পাদনা করতেন। যাই হোক, সাখাওয়াত হোসেন মজনুর লেখা ছিল মূলত গবেষণা-মূলক। তাতে অনেক না-জানা তথ্য তিনি দিতেন। আমার মত পাঠকদের যাদের স্মৃতি ‘ভোঁতা’ তা একটু ঝালিয়ে দিতেন। সময়-সুযোগের কারণে সব লেখা পড়া সম্ভব হতো না, তবে মাঝে মধ্যে বিষয় আকর্ষণীয় হলে পড়তাম মন দিয়ে। পাঠক-সমাদৃত ছিল তার লেখা। তার সাথে আমার পরিচয় খুব যে বেশি দিনের তাও নয়, তারপরও বলি, কম করে হলেও বছর ছয়/সাত তো হবেই। তিনি ছিলেন আমার প্রতিবেশিও। একই ছাদের নীচে আমাদের বসবাস। দেশে কাজে বা বেড়াতে গেলে যে ক’দিন থাকা হয় এবং যে ছাদের নীচে আমার থাকা, যেখানে আমার অস্থায়ী ঠিকানা, সেই একই ভবনের একটি ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন সস্ত্রীক। তার স্ত্রী শিক্ষক-কবি মর্জিনা আখতার। দেখা হলেই বন্ধু-সুলভ হাসি মেলে বলতেন, ‘কেমন আছেন বিকাশদা, কবে এলেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনো গেইটের গোড়ায়, কখনো বা লিফটের গোড়ায়। কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। নয় তলা ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের যে ‘ফ্ল্যাট ওনার্স এসোসিয়েশন’ আছে তার অন্যতম পরিচালক ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন মজনু। আমার ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের সময় তিনি ডেভেলপার ইকবাল সাহেব, সাংবাদিক বন্ধু নাসিরুল হক, একই ভবনে আর ফ্ল্যাটের মালিক চাচাতো ভাই দীপক চৌধুরী, আমার বড় ভাই সমরেশদাসহ তিনিও গিয়েছিলেন কোর্ট বিল্ডিং-সংলগ্ন অফিসে। ফ্ল্যাটের কারণে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তিনি এগিয়ে এসেছেন, বিভিন্ন মহলে ধর্ণা দিয়েছেন- সে গ্যাসের সংযোগ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, পানি, লিফট ইত্যাদি। সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন মহলে তার একটা যোগাযোগ ছিল। যে কাজ অন্যের পক্ষে কষ্টকর ছিল তা তিনি কম-কষ্টে সারতে পারতেন। তার স্বভাবের মধ্যে একটি প্রশংসনীয় ব্যাপার লক্ষ্য করেছি তা হলো যেচে পড়ে অন্যকে সাহায্য করার একটা প্রবণতা। যেমন আমার ক্ষেত্রে ওনার কোর্ট বিল্ডিংয়ে না গেলেও হতো, কিন্তু স্রেফ সহমর্মিতা দেখানোর জন্যে তাকে না-বলা সত্ত্বেও তিনি গিয়েছিলেন, কোন কিছুর প্রাপ্তির আশা না করে। কেবল আমার বেলায় নয়, সবার ক্ষেত্রে উনি এই কাজটি করতেন বলে জেনেছি।
আজকাল তো আমরা পড়াশুনা করি না। মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের মাঝেই সব কিছু খুঁজে বেড়াই। সবকিছু সহজেই পেতে চাই এবং ত্বড়িৎ গতিতে। নাম বলুন, যশ বলুন, অর্থ বলুন সব। সবাই খুঁজি ‘শর্ট-কার্ট’ রাস্তা। কোন কিছু লিখতে গেলে জানতে হয়। আর এই জানার জন্যে পড়তে হয়, প্রচুর পড়াশুনা করতে হয়। মোদ্দা কথা কোন বিষয়ে লেখার-মত ‘লেখা’ তৈরি করতে গেলে পড়াশুনা করতে হয়। সাখাওয়াত হোসেন মজনু পড়াশুনা করতেন, তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করতেন তার গবেষণামূলক লেখা তৈরি করতে। বোধকরি সে কারণে তিনি একজন নিষ্ঠাবান গবেষক হিসাবে পরিচিত ও সমাদৃত। তার বাসায় দেখেছি কাচের আলমারির ভেতর তাকে-তাকে প্লাস্টিক মোড়ানো বই সাজানো, ধুলো-বালি থেকে রক্ষার জন্যে। তিনি ছিলেন বিনয়ী। দৈনিক আজাদীর বরেণ্য সাংবাদিক কবি রাশেদ রউফের এক লেখায় জানতে পারি, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক দেশবাংলার কিশোর কর্মী হিসেবে ছোট ছোট সংবাদ লিখতে লিখতে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর লেখায় হাতে খড়ি। এরপর ‘গণকন্ঠ’ পত্রিকা এবং শিক্ষকতার মাধ্যমে ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থেকে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তিনি ক্ষেত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামকে বেছে নিয়েছিলেন।’ একই তথ্য থেকে জানতে পারি, তার গবেষণার ফল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, নির্যাতন’ ৭১, রণাঙ্গনে সূর্যসৈনিক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামের বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র, মধ্যম নাথপাড়া ও আবদুর পাড়া বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধে আমার কৈশোর। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৩টি। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম শহরের সে সময়কার তৃণমূলের অবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্র, গৌরবদীপ্ত অপারেশন, বধ্যভূমি, নির্যাতন কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়ক শক্তি মা-বোনদের গৌরবগাঁথা, ঘাতক বাহিনীর সহযোগী ও পাকিস্তান বাহিনীর দোসরদের তৃণমূলের তথ্য সংগ্রহের ২য় পর্বের কাজ শেষ করেছিলেন তিনি। প্রায় ১০০০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির দুই খন্ডে প্রকাশের ইচ্ছে ছিল সাখাওয়াত হোসেন মজনুর। এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ এর সম্পাদনায় প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন গ্রন্থের ১০ পর্বে সাখাওয়াত হোসেন মজনুর শহর চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা পর্বের অনেকগুলো গবেষণাকর্ম স্থান পেয়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন মজনুর মৃত্যু কেবল তার স্ত্রী শিক্ষক-কবি মর্জিনা আখতার ও তার পরিবার নিকট-জনের ক্ষতি নয়। দৈনিক আজাদী ও তার অগণিত পাঠক দেশে বিদেশে হারালো একজন নিষ্ঠাবান গবেষক, প্রাবন্ধিককে এবং তা বড্ড অসময়ে। দৈনিক আজাদী এমনি অসময়ে, হঠাৎ হারিয়েছিল আর এক পাঠক-সমাদৃত গুণী লেখক-সাংবাদিক ও সরকারি আমলাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার বিচার্যে নির্দ্বিধায় বলতে পারি তার মত ক্ষুরধার, ‘উইটি’ লেখা এ সময়ে আমার চোখে আর পড়েনি। তিনি রণজিৎ বিশ্বাস। এক সময় চট্টগ্রামে এক সাথে সাংবাদিকতা করেছি। পরে আমরা দু’জন অনেকটা কাছাকাছি সময়ে ঢাকা (উনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেবার পর এবং আমি চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকার পত্রিকায় যোগ দেবার পর) চলে গেলে সেখানেও ছিল যোগাযোগ, যদিওবা আগের মত নয়। হল্যান্ড বসে দৈনিক আজাদীতে তার লেখা পড়ার জন্যে উৎসুক হয়ে থাকতাম এবং আমি নিশ্চিত জানি আমার মত অনেকেই উৎসুক ছিলেন রণজিৎ বিশ্বাসের লেখা পড়ার জন্যে। দৈনিক আজাদীর ‘ঈর্ষণীয় কাটতির’ পেছনে রণজিৎ বিশ্বাসের ‘কলামের’ও যে অন্যতম অবদান ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। মৃত্যুর মাস কয়েক আগে হল্যান্ড এসেছিলেন। আমার বাসায় ছিলেন। এক সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ঘুরে এসে পানীয়ের সাথে ফেলে-আসা দিনের কাসুন্দি ঘেঁটে আমরা দুজন ড্রয়িং রুমে অনেক রাত অবধি আড্ডা মেরেছিলাম। সে কথা কোন এক সময় এই পাতায় লিখেছিলাম বলে আর সেদিকে গেলাম না। বেঁচে থাকতে তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি বলে আমার ধারণা। তার যে অসাধারণ প্রতিভা তার যথাযথ মর্যাদা আমরা দেইনি। প্রাবন্ধিক লেখক সাখাওয়াত হোসেন মজনু তার প্রাপ্য সম্মান কতটুকু পেয়েছেন তার জীবদ্দশায় আমার জানা নেই। জাতি হিসাবে এটি আমাদের বড় ব্যর্থতা। এখানে আমাদের দীনতা। জীবিতকালে তার প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা দিতে আমরা বড্ড কুন্ঠিত, দ্বিধান্বিত। যুগে যুগে বুঝি এমনটি হয়ে আসছে। হয়ে আসছে বলেই বুঝি কবি নজরুল লিখেছিলেন- ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে গেলে ফুল’। সাখাওয়াত হোসেন মজনু পরপারে শান্তিতে থাকুন এই প্রার্থনা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতার সেবায় ব্রত রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট
পরবর্তী নিবন্ধপপির অপেক্ষায় নির্মাতা রাজু আলীম