হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

কলকাতা- ‘কফি হাউসের’ সেই

আড্ডাটি আজ আর নেই’

বাংলাদেশ থেকে কলকাতা গেছে আর কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত ‘কফি হাউসে’ যায়নি, তেমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। উত্তর কলকাতার অতি ব্যস্ততম এই এলাকা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক উল্টোদিকে এই কফি হাউস। দূর থেকে খুব যে একটা চোখে পড়ে তা না। চারিদিকে এতো বইয়ের দোকান যে এর প্রবেশমুখ কোনদিক সেটি জানা না থাকলে খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতেই হয়। তবে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে চোখ বন্ধ করে বলে দেবে কোনদিকে আপনাকে যেতে হবে। এই ‘কফি হাউস’ ছিল পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে নামি-দামি লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের আড্ডাখানা। এই কফি হাউস সম্পর্কে আমার মত অনেকের জানা হতো না যদি না মান্না দে’র সুরেলা কণ্ঠে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং সুরকার সুপূর্ণকান্তি ঘোষের এই অমর, অজেয় গানটি সেই ছোটবেলা থেকে শুনে না আসতাম। কেবল আমি নই, খুব কম বাঙালি পাওয়া যাবে, যারা একটু-আধটু সংগীতের খবর রাখেন, যারা এই চমৎকার এই নস্টালজিক গানটি শুনেননি। গানটি শুনলে কল্পনায় আমরা আমাদের আশপাশের অনেককে দেখি। মনে হয় গানের চরিত্রগুলো আমাদের অনেক চেনা। গানের বর্ণনায় নিজেকে খুঁজে পাই কোথায়ও। যদিও বা গানের সুরকার সুপূর্ণকান্তি ঘোষের মতে, গানের সব কটি চরিত্র কল্পনাপ্রসূত। হোক না তা, তারপরও তা মানতে মন মানে না। গানের বর্ণনায় প্যারিসে চলে যাওয়া নিখিলেশ, ঢাকার রিপোর্টার মঈদুল, গীটারিস্ট ডি’সুজা, অমল, রমা রায় কিংবা সুজাতা – সব ক’টি কল্পনা তা মানতে রাজি নয় মন। মান্না দে গেয়েছেন, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটি আর আজ নেই’। তা না থাকুক। কলকাতা এসেছি। এত কাছে এসে গানের মধ্যে দিয়ে চিরদিনের জন্যে বাঁচিয়ে রাখা ও বিখ্যাত হয়ে উঠা এই ‘কফি হাউসকে’ কাছ থেকে একবার না-দেখে ফিরে যাব, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মেনে ও মনে- দুটোর কোনটাই নিতে পারছিলাম। এদিকে সময় বৈরী। তা হোক। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে দেখি হাতে মাত্র একটি বিকেল অবসর।
হোটেল থেকে বেরিয়ে টেঙি নিয়ে রওনা দেই সে লক্ষ্যে। যেতে যেতে চোখে পড়ে ‘ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল’। গাড়ির ভেতর থেকে চোখে পড়ে চোখ ধাঁধানো মার্বেলের তৈরি সাদাটে রঙের ‘ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল’, যেটি তৈরি হয়েছিল ১৯০৬ থেকে ১৯২১ সাল এই দীর্ঘ সময়ে। রানী ভিক্টরিয়া ১৯০১ সালে মারা যাবার পর তার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ভাইস রয়, লর্ড কার্জন ঠিক করলেন মিউজিয়াম ও বাগান সহ এই ‘মনুমেন্ট’ তৈরি করবেন। তখনও কলকাতা ভারতের রাজধানী। রাজা জর্জ চতুর্থ ১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। বিশাল অর্থের প্রয়োজন। রাজা আবেদন রাখলেন। ভারত সরকার, জনগণ, বৃটিশ রাজের অধীনে ব্যক্তি পর্যায়ের অনেকে এবং লন্ডনের বৃটিশ সরকার এগিয়ে এলেন। মোট এক কোটি পাঁচ লক্ষ রুপি সংগ্রহ করা হয়েছিল এই চোখ ধাঁধানো মনুমেন্ট তৈরি করতে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পর এতে কিছু বাড়তি কাজ করা হয়েছিল। সামনে যে বাগান সেটিও বিশাল এলাকা নিয়ে, মোট ৬৪ একর। দেখাশুনা করার জন্যে রয়েছে ২১ মালি। ভেতরে আছে ‘কলকাতা গ্যালারি’ সহ ২৫টি নানা বিষয় ও সময়কে ঘিরে গ্যালারি। বিশাল যজ্ঞ বটে। দুর্ভাগ্য, সময়ের কারণে এর কোনটিই কাছ থেকে দেখা হয়ে উঠেনি। কেবল এর পাশ দিয়ে এদিক-ওদিক যাবার সময় দূর থেকে দেখেই অনেকটা ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর’ চেষ্টা করেছি। ফিরে আসি কফি হাউসে।
টেক্সি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে পেয়ে যাই ‘কফি হাউস’। ময়লা, নোংরা, অগোছাল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাই। সিঁড়ির পাশ দিয়ে দেয়ালে নানা বিষয়ে, মুখ্যত প্রকাশনা সম্পর্কিত, পোস্টার, ছবি। হোক না মান্না দে’র গাওয়া গানের চরিত্র- রমা রায় বা সুজাতা বা মঈদুল সব কল্পনা। মনে মনে এই ভেবে রোমাঞ্চিত হই যে, এই কফি হাউস তো ছিল সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, অপর্ণা সেন, শক্তি চট্টপাধ্যায়ের মত ব্যক্তিদের আড্ডাস্থল। এনারা ছাড়া আরো যাদের স্মৃতি জড়িত এই কফি হাউস তারা হলেন, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বরুন দে-র মত নামকরা শিল্পী, সাহিত্যিক। এই সমস্ত কারণে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তো এক কথায় ও নির্দ্বিধায় বিশাল। কেবল যে শিল্পী, সাহিত্যিকরা আসতেন, আড্ডা দিতেন, তা নয়, এখানে আসতেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীরাও। এখানকার আড্ডা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক নামকরা ম্যাগাজিন এবং লেখা। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে যেতেই দেখি মাঝারি আকারের হলঘরের প্রায় সব ক’টি চেয়ার; ফুল’, খালি নেই। কফি আর সিঙ্গারা, সমুসা ও অন্যান্য খাবারের সাথে চলছে ধুমসে সিগারেট, চলছে ধুমসে আড্ডা। বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। একটু এদিক-ওদিক তাকাতে দেখলাম এক কোনায় একটি টেবিল খালি। দেরী না করে আমরা তা দখলে নিলাম। দেয়ালের একদিকে রবি ঠাকুরের বিশাল ছবি। বৃটিশ আমলের মত বিশালাকার ফ্যানগুলো মাথার উপর ঝুলছে। ওয়েটারদের পরনে সেই বৃটিশ আমলে পিয়ন, ড্রাইভারদের যেমন মাথায় পাগড়িসহ সাদা পোশাক, তেমন একজন এগিয়ে এলে জানতে চাইলো আমরা, আমি আর সুমনা, কী খাবো। আমাদের খাওয়াটা মুখ্য ছিল না। মুখ্য উদ্দেশ্য কফি হাউসকে দেখা, অতি কাছ থেকে। তারপর কিছুক্ষণ বসতে হবে, দেখার জন্যে। স্ন্যাকস আর কফির অর্ডার দেই। একটা সময় এখানে কলকাতার কোন না কোন সাহিত্যিক বা শিল্পীকে দেখা যেত। শুনেছি, এখন আর তেমনটি হয় না। আগের মত ওনারা আসেন না। দেখলাম তরুণ-তরুণীদের প্রাধান্য, তাদের দেখে, তাদের ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ দেখে মনে হয় না তারা তেমন ‘ক্রিয়েটিভ’ কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত। দিন পাল্টেছে।
আমি প্রথমবারের মত এখানে, কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই, দর্শনীয়ভাবে কয়েকটা ছবি তুলি। এক ধরনের ভালো লাগা পেয়ে বসে। নিখিলেশ, মঈদুল, রমা রায়, সুজাতা কিংবা অমল- হলোই বা কল্পনার, কিন্তু এই কফি হাউসকে ঘিরেই তো এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন মান্না দে, সুপূর্ণকান্তি ঘোষ আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। চার দশক আগের এই গান এখনো কেমন যেন আমাদের নিয়ে যায় অতীতে, আমাদের যৌবনের দিনগুলোতে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে, যখন আমরাও ক্যান্টিনে বসে, চা-সিঙ্গারা বা সমুচা খেতে খেতে আড্ডার পাহাড় বানাতাম, রাজা-উজীর মারতাম। মজার ব্যাপার হলো, সুপূর্ণকান্তি ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম বাংলাদেশের কোন এক পত্রিকায়, অনেক দিন আগে। তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় এই গানটির শ্রোতারা কল্পনায় এই সমস্ত চরিত্রকে নিজের মনে দাঁড় করিয়েছেন, একটি স্থায়ী আসন দিয়েছেন’। এমন কী বলা হয়, যে রিপোর্টার মঈদুলের কথা বলা হয়েছে এই গানে, তিনি ঢাকার স্পোর্টস রিপোর্টার, নূর আহমদ মঈদুল। সুপূর্ণঘোষের ঘোষের মতে, এর সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই, মিল নেই বাকি কোন চরিত্রের। মঈদুল পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনায় ১৯৩৬ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৮ সালের দাঙ্গার সময় কলকাতা ছেড়ে ঢাকা চলে যান পরিবারের আর সবার সাথে। তিনি ১৯৬৬ সাল থেকে খেলাধুলা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন এবং দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, বাংলার বাণী, দৈনিক পূর্বদেশে নিয়মিত লিখতেন। ওই সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ২০১৪ সালে মঈদুলের বয়স যখন ৭৮, তখন অনেক পত্র-পত্রিকা লেখে যে এই মঈদুলই হচ্ছেন কফি হাউসের বিখ্যাত গানের বিখ্যাত চরিত্র ‘রিপোর্টার মঈদুল’। তার জীবিত দশায় তিনিও এমনটি দাবি করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি গানের রমা রায় ও সুজাতার সাথে আড্ডা দিয়েছেন তেমনটিও বলা হয়। মান্না দের সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু গানের সুরকার সুপূর্ণকান্তি ঘোষ তা উড়িয়ে দেন এই বলে, ‘কলকাতায় অনেক মঈদুল আছে। তারা যদি ওই গানের মঈদুল বলে নিজেকে দাবি করেন, তাহলে আমি কী বলতে পারি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার এক বন্ধু আছে, নাম সুজাতা চ্যাটার্জি, শিক্ষক, থাকে হাওড়ায়। আমি কি বলতে পারি গানের চরিত্রের সুজাতা আর আমার বন্ধু সুজাতা এক’?
আমার তর্কে গিয়ে কাজ নেই। আমার কল্পনায় রমা রায়, সুজাতা, মঈদুল, নিখিলেশ বেঁচে থাকুক, যেমনি বেঁচে আছে লক্ষ জনের মনে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাতঙ্কে আয়েশের শীতকাল
পরবর্তী নিবন্ধকলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনে শাহরুখ-মমতা