ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২২ জুন, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

ড. বিধান চন্দ্র রায়
কলকাতার কিংবদন্তি

ভারতের পশ্চিম বাংলার কলকাতায় যাদের যাওয়া আসা আছে তারা নিশ্চয়ই কলকাতার একটা ছোট্ট শহরতলি বিধান নগরের নাম শুনেছেন। ব্রিটিশ কলকাতার বাইরে বিধান নগর নতুন স্যাটেলাইট শহর। সুন্দর প্ল্যান করা উপনগরএ এই উপনগর গোড়াপত্তন করেছিলেন পশ্চিম বাংলার কিংবদন্তি মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। এই ব্যক্তি যেমনি তুখোড় রাজনীতিবিদ তেমনি ম্যাজিক ডাক্তার ছিলেন। তাকে আধুনিক পশ্চিমবাংলার রূপকার বলা হয়।
অনেক ডাক্তার পৃথিবীতে রাজনীতি করেছেন, দেশের মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধানও হয়েছেন। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই সমান কৃতিত্বের উচ্চতায় পৌঁছানো মানুষ খুব কম দেখা যায়। ডাক্তার বিধান রায় সেই বিরল ব্যক্তিত্ব।
তার বাবা পাটনায় ছোট্ট সরকারি চাকরি করতেন। তখন বাংলাভাষী বহু মানুষ পাটনা এলাকায় বাস করতেন। তিনি ১লা জুলাই ১৮৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন পাটনায়। তার বাবা প্রকাশচন্দ্র যশোরে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর হলেও আর্থিক অবস্থা দুর্বল ছিল। বিধান রায়ের বাবা ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের সেই সময় রবীন্দ্রনাথের পরিবারসহ অনেক সনাতন ধর্মী ব্রাহ্মণ সমাজে দীক্ষিত হন। ব্রাহ্মরা সাধারণত সংস্কার মুক্ত ও উচ্চ সংস্কৃতির চর্চা করতেন। বিধানবাবুর মা সমাজকর্মী ছিলেন। তার পাঁচ সন্তান। ৩ ছেলে ও ২ কন্যা। বিধান রায় পাটনা থেকে দশম ক্লাস পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯০১ সালে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৫ সালে একদিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, অন্যদিকে স্বরাজ আন্দোলন, উভয় মিলে অনেক তরুণ ছাত্রকে লেখাপড়া থেকে আন্দোলনে টেনে আনে। বিধান বাবুর বন্ধু লালা রাজপথ, বিপিনবিহারী প্রমুখ প্রত্যক্ষ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেও বিধানবাবু চিন্তা করলেন, আগে ডাক্তার হই , পরে আন্দোলন।
কলকাতা মেডিকেল কলেজের ফটকে একটা ইংরেজি লেখা ছিল Whatever Thy Handeth Findeth To Do, Do It With Thy Right এগুলো ভিক্টোরিয়ান ইংরেজি। আজকাল এভাবে ব্যবহৃত হয় না। যা-হোক কথাগুলোর অর্থ হচ্ছে- হাতের সামনে যে কাজই আসুক, তোমার সর্বশক্তি দিয়ে সম্পাদন কর।
ডা. বিধান বাবু ডাক্তারি পড়ার সময় পরিবর্তিত রাজ্য পরিচালনায় উপরোক্ত বাক্য সামনে রেখেই কাজ করতেন। ডাক্তারি পাস করার পর তিনি বেঙ্গল হেলথ সার্ভিস এ যোগ দিয়ে পেশায় উৎকর্ষতা তো আনেনেই, আবার রোগীর সেবায় অনন্য সব উদাহরণ রেখে গেছেন যা আজকালকার ছোট-বড় কোন ডাক্তারের পক্ষেই সম্ভব নয়। অবসর সময়ে তিনি অনেক রোগীর বাড়িতে নার্স বা ওয়ার্ড বয়ের কাজও করতেন সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। ডা: বিধান রায় ১৯০৯ সালে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য ১২০০ রুপি হাতে নিয়ে বিলাত রওনা হন। তিনি লন্ডনের সেন্ট বার্থলোনোস হাসপাতালে দরখাস্ত করেন। কিন্তু হাসপাতালের প্রধান (ডীন) একজন ভারতীয়কে ভর্তি করতে অনীহা প্রকাশ করেন। ডা. বিধানচন্দ্র পরপর ৩০ বার ভর্তির দরখাস্ত করেন। অবশেষে শ্বেতাঙ্গ (ডীন) তাকে ভর্তি করেন। মাত্র দুই বছরে বিধান রায় এমআরসিপি ও এফআরসিএস অর্জন করে ব্রিটিশদের হতবাক করে দেয়।
বিলাত থেকে এসে তিনি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন । তিনি মাত্র ২ টাকা ফিস নিয়ে চেম্বার করেন ও গরিবদের থেকে ফিস নিতেন না। তার কিংবদন্তি চিকিৎসা সারা ভারত ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের সমন্ত নামী মানুষ তার রোগী ছিলেন। গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, সুভাষ বসু সবাই তার রোগী। ভারতের বাইরে জন এফ কেনেডি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ও বিধান রায় থেকে চিকিৎসা নিতেন।
কলকাতার এক নামি চিকিৎসক ড. নীলরতন সরকার বিধান রায়কে অসচ্ছল পরিবার থেকে আগত বলে কন্যা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ড. বিধান রায় চিরকুমারী থেকে যান।
বিধান রায়ের রাজনৈতিক জীবন ও চমকপ্রদ। ১৯২৫ সালে প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরাজিত করে তার রাজনীতি শুরু হয়। তিনি আগাগোড়া কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। ১৯৩৩ সালে গান্ধীজী অনশন করেন পুনা শহরে। কংগ্রেস বিধান রায়কে গান্ধীর অনশন ভঙ্গ ও চিকিৎসার জন্য পাঠান। গান্ধী এই বলে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন- বিধান তুমি কি ৪০ কোটি ভারতবাসীকে ফ্রি চিকিৎসা দিতে পারবে?
বিধান রায় বলেন- আমি ব্যক্তি গান্ধীকে চিকিৎসা দিতে আসেনি, ৪০ কোটি ভারতের নেতাকে চিকিৎসা দিতে এসেছি। ডাক্তার বিধান রায় কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের মেয়র কলকাতা ভার্সিটির ভিসি ছিলেন। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে পুরো বাংলায় যক্ষ্মা ক্লিনিকগুলো তিনি চালু করেন। ১৯৪৮ সালে গান্ধীর অনুরোধে তিনি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। এসময় তিনি পশ্চিম বাংলায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে একদিকে পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থী সমস্যা, অপরদিকে নতুন নতুন স্যাটেলাইট শহর, অন্যদিকে বন্দর, দুর্গাপুর ট আয়তন, ফারাক্কা ব্যারেজসহ অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। এজন্য তাকে আধুনিক পশ্চিম বাংলার রূপকার বলা হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ পয়সার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়, ডাক্তার বিধান রায় সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করান। বাকিটা ইতিহাস ও সত্যজিৎ রায়ের উত্থানের পর্ব।
ডাক্তার বিধান নিয়ে অনেক বই আছে। একটা বই হচ্ছে নীতিশ সেন গুপ্তের টহসধশরহম ড়ভ ধ হধঃরড়হ. কলকাতা দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ডাক্তার বিধান রায় চিকিৎসা ও রোগীদের নিয়ে কয়েকটি ধারাবাহিক গল্প লিখতেন। তার দুটো বিখ্যাত গল্প বিধান রায়ের রোগীদের কে নিয়ে একটি পেরেকের কাহিনী, বৈদ্যনাথ এর কাহিনী বাংলা সাহিত্য বিধানচন্দ্রকে অমর করে রেখেছে।
১৯৬১ সালে ভারত সরকার ড. বিধান চন্দ্রকে ‘ভারতরত্ন’ উপাধি দেন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যেখানেই সফরে যেনেত উনার জন্য সকালে ১০ জন রোগী নাম লিখিয়ে চিকিৎসা করতেন। সমস্ত অর্থসম্পত্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের রিসারসর জন্য দান করে গেছেন। ঘটনাচক্রে তার মৃত্যু ও জন্মদিন একই ১ জুলাই। ১৯৬২ সালের ১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এত বড় মাপের চিকিৎসক রাজনীতিবিদ ও কলকাতায় নিন্দুকরা রেহাই দেয়নি। কংগ্রেস বিরোধীরা তার মন্ত্রিসভা সদস্য শ্রীমতীনলীনীকে নিয়ে তার ছবির পোস্টে দিয়ে কলকাতায় দেয়াল ভরে দেয়, কিন্তু গোটা ভারত তাকে চিনতে ভুল করেনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়কে স্মরণীয় রাখতে পহেলা জুলাই ভারতের ডক্টরস দিবস পালিত হয় ও বিধান চন্দ্র রায় স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৯৮৬ সনের আইনে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়ন হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক
পরবর্তী নিবন্ধআধুনিক বাস টার্মিনাল হচ্ছে বান্দরবানে