১৯৮৬ সনের আইনে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়ন হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক

মুহাম্মদ মুসা খান | মঙ্গলবার , ২২ জুন, ২০২১ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম শহরবাসীর আপত্তির মুখে ২০১৭ সনে মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্থগিত করা ‘হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়ন (রিএসেসমেন্ট) এর ‘স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার জন্য’ অথবা ১৯৮৬ সনের আইনের আলোকে ‘নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন’ করার অনুমতি দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন গত ৩ জুন তারিখে মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদনপত্র পাঠিয়েছে। বর্তমান ‘করোনা সংকটের’ সময় মানুষ যেখানে দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে নতুনভাবে ‘হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের’ তোড়জোড় দেখে সঙ্গত কারণেই নগরবাসীর মনে অসন্তোষ দানা বাঁধছে ।
প্রসঙ্গক্রমে ১৯৮৬ সনের ‘দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ ও এর হিসাব-নিকাশ’ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। আইনটি প্রণীত হয়েছিল সামরিক শাসক এরশাদ আমলে। সামরিক সরকারের অনেক আইন, বিধি-বিধান পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক সরকার বাতিল করেছে। এরশাদ সরকারকে কখনোই দেশের মানুষ বৈধ বলে গণ্য করে নি। তৎকালীন সময়ে আওয়ামীলীগ- বিএনপিসহ সব বিরোধীদল একত্রিত হয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করেছিল। সুতরাং একটি অবৈধ সরকারের আইন বাস্তবায়ন করার জন্য ‘চসিক’ কেন তোড়জোড় শুরু করেছে – সেই প্রশ্ন করা যেতেই পারে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উক্ত আইনে ‘বাড়ি ভাড়ার উপর’ নির্ধারিত হারে ‘হোল্ডিং ট্যাক্স’ ধার্য করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাড়ির মালিক যেহেতু বাড়ি ভাড়ার উপর ‘আয়কর’ দিয়ে থাকেন, তাহলে ভাড়ার উপর আয়করের ‘আদলে’ আনুপাতিক হারে ‘হোল্ডিং ট্যাক্স’ নির্ধারণ করা হলে এটা কি ডাবল ট্যাক্সিং হবে না?
এ প্রশ্নটি তখন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড.মঈনুল ইসলাম স্যার দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত কলামে (২০ অক্টোবর ‘১৬) করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ”বিশ্বের কোন দেশেই ডাবল ট্যাক্সিং প্রচলিত নেই। ‘সিটি কর’ তো আসলে হোল্ডিং ট্যাক্স। হোল্ডিং ট্যাক্স বা প্রপার্টি ট্যাক্স নির্ধারণের নীতি-এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে, আয়কর নিরূপণ করাটা যৌক্তিক হচ্ছে না”। তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার (এনবিআর) আয়ের উপর বিভিন্ন হারে ‘আয়কর’ আদায় করার পর সিটি কর বা হোল্ডিং ট্যাক্স প্রকৃত পক্ষে বাড়ি ভাড়ার আয়ের ‘সতের শতাংশ’ হতে পারে না’। … এখানে বড় রকমের ‘ইন্টারপ্রিটিশন এরর বা ব্যাখ্যার ভুল হয়ে যাচ্ছে’।
১৯৮৬ সনের আইনের ২১ ও ২২ ধারা অনুযায়ী কোন বাড়ির মালিক যদি ৫০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পান, তাহলে তাঁকে প্রতি মাসে ৭,০৮৪/- টাকা এবং বার্ষিক ৮৫,০০০/- টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হবে [৫০,০০০/-* ১২ =৬,০০,০০০/- (-) ১০০০০০/- (দুই মাসের ভাড়া বাবদ) = ৫,০০,০০০/- * ১৭% = ৮৫,০০০/- (বার্ষিক) * ১২= ৭০৮৪/- টাকা (মাসিক)]। মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকার বাড়ি ভাড়ার উপর যেহেতু বাড়ির মালিক বার্ষিক ‘আয়কর’ দিয়ে থাকেন, তাই আবারও সতেরো শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের বিধান কোনক্রমেই যৌক্তিক নয়।
আমরা মনে করি, ‘হোল্ডিং ট্যাক্স’ বা ‘সিটি ট্যাক্স’ হওয়া উচিত- ”সিটি কর্পোরেশনের প্রদত্ত নাগরিক সুবিধা ও ভবনের আয়তন অনুযায়ী”। যেমন- সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদের জন্য রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ করে (রাস্তাঘাট নির্মাণ করে সিডিএ), সড়ক বাতির ব্যবস্থা করে, ময়লা- আবর্জনা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে, নালা-নর্দমা নির্মাণ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, সর্বোপরি নাগরিকদের নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিত করে। তাছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণ নাগরিকদের জাতীয়তা/জন্ম সনদ এবং সালিশ-বিচারসহ অন্যান্য সেবা দিয়ে থাকেন। মোট কথা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো-নাগরিক সেবা নিশ্চিত করে নাগরিকদের নিরাপদ বসবাস সুনিশ্চিত করা। সুতরাং এই সেবামূলক কাজের জন্য হোল্ডিং ট্যাক্স বা সিটি ট্যাক্স হওয়া উচিত ‘ভবন অনুযায়ী’ বা ‘ভবনের আয়তন’ অনুযায়ী। ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ৫ তলা বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স কত হওয়া উচিত, তা বিবেচনা করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। কারণ ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ৫ তলা বাড়ি নির্মাণ করতে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি টাকার অধিক ব্যয় হয়। এই তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়ি হতে ভাড়া আসে এলাকা ভেদে হয়তো ৬০/৭০ হাজার টাকা (অথচ ব্যাংকে জমা রাখলে এই টাকার উপর আড়াই লক্ষ টাকার অধিক মুনাফা পাওয়া যায়)। এই টাকা দিয়ে সংসারের সবার ভরণপোষণ, ছেলেমেয়ের লেখা-পড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল প্রদান ও মেইনটেনেন্স ব্যয়সহ যাবতীয় খরচের পর অবশিষ্ট কিছু থাকে না। এখন যদি এধরনের ভবনের ভাড়ার উপর মাসিক ৮/৯ হাজার টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হয়, সেটা হবে রীতিমত অবিচার।
প্রসঙ্গক্রমে হোল্ডিং ট্যাক্সের বিপরীতে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নাগরিক সেবার চিত্রটি একটু দেখা যেতে পারে, কেননা ১৯৮৬ সনের আইনে ‘হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের’ পাশাপাশি ‘নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার’ কথাও উল্লেখ আছে, যা হয়তো দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। কিন্তু আগে তো নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, তারপরই তো ট্যাক্স। কথায় বলে ‘পেটে দিলে পিঠে সয়’। আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবা সমূহ যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে- ২০% নাগরিক সেবাও তারা নিশ্চিত করতে পারছে না, যেমন- অধিকাংশ সড়কে সড়কবাতি নেই, অনেক স্থানে ময়লা-আবর্জনা সমূহ দিনের পর দিন পড়ে থাকে (পরিস্থিতি এখন একটু ভাল), পাড়া-মহল্লার ছোট-বড় নালা/খাল সমূহ বছরে একবারও পরিষ্কার করা হয় কিনা সন্দেহ (হতে পারে জনবল স্বল্পতার জন্য)। শহরের রাস্তা সংলগ্ন ফুটপাত গুলো অবৈধ দখলদারদের দখলে থাকার কারণে পথচারীরা হাঁটতে পারে না। অবৈধ রিকশার কারণে যানজট লেগেই আছে। শহরের রাস্তাঘাট সমূহ অনেক স্থানে গর্ত-খানা-খন্দকে ভরা। প্রতিবছরের জলাবদ্ধতা তো ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায় বর্ষাকালে প্রতিটি বাড়ির নীচতলা পানির নীচে থাকার কারণে ৪/৫ মাস খালি পড়ে থাকে, ভাড়া হয় না। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীদের শতশত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় (চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ক্ষতিসহ)। এসবের ক্ষতিপূরণ কি সিটি কর্পোরেশন কখনও দিয়েছে? সুতরাং নাগরিক সুবিধার ২০% মাত্র পূরণ করে বর্তমান হারের দ্বিগুণ/তিনগুণ বা ১৭% ট্যাক্স নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত আদৌ উচিত কিনা বা নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন কিনা-তা অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে।
চসিক একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। কর্পোরেশনের আয় সমূহ হলো- হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ প্রাপ্ত আয়, অন্যান্য আয়বর্ধক প্রকল্প হতে প্রাপ্ত আয় এবং সরকারি অনুদান। চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভাগ্য হলো- চসিক বরাবরই সরকার হতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবহেলিত। দীর্ঘ সময়ের মেয়র- মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ব্যর্থ করানোর জন্য বিএনপি সরকার বরাদ্দ কমিয়েছিল, প্রাক্তন আওয়ামী লীগের ও বিএনপি’র টিকেটে মেয়র নির্বাচিত হওয়া মনজুরুল আলমকে ব্যর্থ করানোর জন্য বরাদ্দে অবহেলা করেছিল আ.লীগ সরকার। সর্বশেষ মন্ত্রণালয় হতে অর্থ বরাদ্দের জন্য ঘুষ দাবীর অভিযোগ তুলে পূর্ববর্তী মেয়র আ.জ.ম.নাছিরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিরাগভাজন হয়ে বরাদ্দ লাভে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামবাসী সবসময় অবহেলার শিকার হয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে চট্টগ্রামের ছয়জন মন্ত্রী থাকলেও নিজেদের দলাদলির কারণে চট্টগ্রামের কোন উন্নয়ন হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের মত সোনারডিম পাড়ার হাঁস থাকলেও চসিক এখান থেকে বাড়তি কোন আর্থিক সুবিধা পায় না।
চট্টগ্রামবাসী মনে করেছিলেন, বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে চসিকের ব্যয় কমিয়ে, দুর্নীতি বন্ধ করে ও মন্ত্রণালয় হতে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে করপোরেশনকে সচল রাখবেন। কিন্তু তিনি আবারও ৩০ বছর আগের স্বৈরাচারি সরকারের একটা আইন বাস্তবায়নের চিন্তা করছেন! একটি বিষয় সভ্য মানব সমাজে বহুল প্রচলিত যে, ‘আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয়’। মেয়র মহোদয় যদি মনে করেন যে, তিনি আইনের কারণে হোল্ডিং ট্যাক্স পূর্বের হারে রাখতে পারছেন না বা কমাতে পারছেন না, তাহলে কাউন্সিলর মহোদয়গণের এবং সুধিজনের মতামত নিয়ে আইনটি পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারেন। তাছাড়া বিগত ৩০ বছর যাবৎ (আইন থাকা সত্ত্বেও) পূর্ববর্তী মেয়রগণ নাগরিকদের কথা চিন্তা করে হোল্ডিং ট্যাক্স অযৌক্তিক হারে না বাড়িয়ে যৌক্তিক ভাবে বা সহনীয়ভাবে নির্ধারণ করেছিলেন, এবারও সেভাবেই হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ণয় করা হলে- নগরবাসী স্বস্তি পাবেন, উপকৃত হবেন এবং খুশী হবেন ।
বর্তমান সিটি মেয়র মহোদয় হঠাৎ করে মেয়রের চেয়ারে বসেন নি। তিনি সুদীর্ঘ দিন মাঠের রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। তিনি যেহেতু রাজনীতির জগতের মানুষ-তাঁর তো গণমানুষের মনোভাব বুঝা উচিত। একটি অদূরদর্শী ও ভুল আইনের বাস্তবায়নের চেয়ে নগরীতে বসবাসরত মানুষদের সুযোগ-সুবিধা এবং মতামতকে প্রাধান্য দেয়াই মেয়র মহোদয়ের উচিত বলে আমরা মনেকরি ।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেদিন সুদূর নয় : বিশ্ব দেখবে নতুন নেতৃত্ব, স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিত্র
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল