দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৯ মে, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

টক্কা মেইল,টক্কা বাস
“জনপ্রতি টিকিট হলো ১৫০ রেন মেন বি । খুব ছোট বাচ্চা না হলে তাদের টিকিটের দামও একই। তোমার বাচ্চারা কত বড়?” হাসিমুখের উত্তর মিস ইনার উত্তরটি কানে যেতেই নিজের অজান্তেই যতোটা পারা যায় ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের বা দিকটায় তাকালাম পুত্রদের খোঁজে। কিন্তু পেলাম না তাদের টিকিটিরও দেখা। বললাম ছিল তো ওরা এখানে, একটু আগে দেখো নি?
“দেখো আমি তো ব্যস্ত ছিলাম তাই লক্ষ করিনি”একগাল হাসিতে বলল ইনা। ভাবলাম আচ্ছা এই হাসিটা কি তার স্বভাবজাত? নাকি ট্রেনিংজাত হাসি? হোক তা যা ইচ্ছা তাই। ট্রেনিংজাত হাসি হলেও মিস ইনা এটাকে বেশ ভাল রপ্ত করেছে। নানান এয়ার লাইন্সের বিমানবালাদের ট্রেনিংজাত হাসি দেখলে যেমন মনে হয়, তারা জোর করে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত কেলাচ্ছে, যেদিকে তাকাই না পারতপক্ষে, আর যদি চোখ পড়েও যায় অজান্তে, লাগে তাতে বড়ই বিরক্ত, এর ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। শুধু একটা ব্যাপারই কানে লাগছে, তা হলো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠে কথা বলা! এটা কি নার্ভাসনেসের জন্য হচ্ছে নাকি? আর নার্ভাসনেসটা কি এ জন্য যে,তাকে বাধ্য হয়ে সারাক্ষন ইংরেজিতে কথা বলতে হচ্ছে আমার সাথে । কারন একটু আগে সে যখন কথা বলছিল ঐ চায়নিজ ভ্রামনিক দলটার দলপতির সাথে, তখন কিন্তু এতো জোরে কথা বলতে শুনিনি তাকে। অবশ্য ইংরেজি বলছে সে চমৎকার, আছে শুধু একটু ধ্বনিগত চিংলিশ টান, যেমন আছে আমার বাংলিশ টান । এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা এই হফ অন হফ অফ বাস ট্যুর না নিয়ে যদি আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে চাই সারাদিন বেইজিং ঘোরার জন্য তা কি ঠিক করে দিতে পারবে?
“কেন নয়? অবশ্যই। সেক্ষেত্রে তোমাকে গুনতে হবে মোট ৫৫০ রেন মেন বি। ঠিক করে ফেলব নাকি এক্ষুণি?’ উচ্ছ্বসিত জবাব মিস ইনার-এদিকে সাথে সাথেই মাথার ভেতরের ক্যালকুলেটর করে ফেলল হিসাবটা যে তাহলে তো ঐ বাস ট্যুরের চেয়ে আলাদা গাড়ি নিয়ে ঘোরাটাই সস্তা হবে। সাথে সাথে মনের ভেতরের দ্বিতীয়জন বলে উঠলো, আরে হফ অন হফ অফ বাস মানে আমাদের চাটগাঁইয়া ভাষায় যাকে সম্ভবত বলা হবে “টক্কা বাস”, তার ট্যুর নিলে এই ঠাণ্ডায়, কোন বাস স্ট্যান্ডে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে? হঠাৎ করে মনে টক্কা বাস কথাটা মনে আসতেই একদিকে পেল হাসি, অন্যদিকে মনে পড়লো উচ্চশিক্ষার্থে চট্টগ্রাম বাসকালীন, সে যে আমার নানা রঙয়ের দিনগুলোর কথা। হিরণ্‌ময় ঐ দীর্ঘ সব দিবস ও রজনীসমূহের কথা!
সে সময় চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার একটা ট্রেন ছিল, যেটির নাম ছিল সম্ভবত জালালাবাদ মেইল। তখন তো এখনকার মতো এক্সপ্রেস ট্রেন, নন স্টপ ট্রেন ছিল না। ছিল মুলত দু ধরনের ট্রেন, যার একটা চলতো ঢিমে তালে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে প্রতি স্টেশনে ন্য শধু অকারনে অঙ্কে সময় দুই স্টেশনের মাঝে থেমে থেমে। যে ট্রেন মিস করার সাধ্য ছিল না এমনকি “কতো রবি জ্বলেরে, কেবা আখি মেলেরে মার্কা অলস লোকেরও। তারপরও কেন জানি সেই ট্রেনগুলোকে ডাকা হতো মিস ট্রেন নামে। আর ছিল উল্কা , গ্রিন অ্যারো নামের দুদ্দাড় ধাই ধাই ছুটে চলা ট্রেন যেগুলো থামত শুধু, জংশন জাতীয় বড় স্টেশনগুলোতে। ঐ জালালাবাদ অন্য আর একটা ট্রেন ছিল এই দুই ধরণের মাঝামাঝি। সেগুলো দুই তিন স্টেশন বাদ দিয়ে একটা স্টেশনে থামতো। ফলে চট্টগ্রামের সাধারন মানুষের মুখে তার ঐগুলোর নাম বদলে হয়ে গিয়েছিল “টক্কা মেইল”।
কথা হচ্ছে “হফ অন হফ অফ : বাস যতদিন ধরে চিনি ততদিনই ভেবেছি এর যুতসই বাংলা নাম কি দিতে পারি, কিন্তু পাচ্ছিলাম না তা খুঁজে। আজ কিনা এই মিস ইনার সামনে দাঁড়িয়ে বউ বাচ্চা বোনসহ, বেইজিং ট্যুরের পরিকল্পনা করতে গিয়ে পেয়ে গেলাম সে নামটা। বাংলায় ঐ বাসকে টক্কা বাস নামেই ডাকাটাই সঠিক হবে। সাধে কি আর মধু কবি বলেছিলেন, ‘হে বংগ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’?
কারণ সেই টক্কা মেইলের মতো, এই টক্কা বাসও সব বাস স্ট্যান্ডে থামে না। প্রতিটি রুট বা লুপে এই বাসগুলো থামে শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্টপেজে। যেগুলো সাধারণত হয় ঐ শহরের দর্শণীয় জায়গা বা স্থাপনার আশে পাশে। এর বাইরে এগুলো দাঁড়ায় কিছু পিক আপ পয়েন্টে যাত্রী তোলার জন্য। যেমন যদিও জানি না, এই যে হোটেলে উঠেছি আমরা এর আশেপাশে কোন দর্শনীয় জায়গা বা স্থাপনা আছে কি না, কিন্তু এটা বুঝতে পারছি যে, এখানে টক্কা বাসের একাধিক লুপের একাধিক স্টপেজ আছে। এভাবে চালাতে গিয়ে টক্কা বাস কোম্পানি চালায় বাস তাদেরই নিজ নিয়মে, নিজেদের ঘড়ি ধরে। তাদের নিয়মের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে পরিবার সহ এই হিমসাগরে কোথায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে জমে যেতে হবে তার তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তারচে নিজেদের ভাড়া করা গাড়ি হলে চলবে তা আমাদের ইচ্ছায় আর নিয়মে ।
এমনিতে সারাক্ষন ঠোকাঠুকি করতে থাকলেও এ ব্যাপারে দুইমনের এরকম বিরল ঐক্যমত সৃষ্টি হওয়ার পরও সাথে সাথেই মিস ইনাকে হ্যাঁ না বলে, জিজ্ঞেস করলাম আছো তুমি এখানে কতোক্ষণ?
‘তা আছি তো। রাত দশটা পর্যন্ত আছি তো। কেন?’
আমার হার হাইনেসের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাব আমাদের সিদ্ধান্ত । আচ্ছা ঐ হফ অন হফ অফ বাসের টিকিট কোথায় পাওয়া যাবে ?
“সেটাও আমি তোমাকে ম্যানেজ করে দেব। তোমাদের শুধু হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে যেতে হবে ঐ বাসস্টপ পর্যন্ত । আর কোন লুপের বাসে উঠবে তার উপর নির্ভর করবে, যাবে তোমরা কোন বাস স্ট্যান্ডে আর তাতে হাটতেই হবে কতোটা। তিনটা লুপের কোনটাতে উঠবে প্রথম তার উপর নির্ভর করবে, কোন কোন সময়ে , কোন স্টপে থাকতে হবে। আর নিজেদের ভ্যান নিলে তো উঠতে পারবে তাতে একদম এই হোটেলের সামনে থেকেই, নিজেদের ইচ্ছেমাফিক সময়ে।“ একটানা কথাগুলো বলে কৌতুক মিশ্রিত হাসিচোখে তাকাল মিস ইনা।
তার কৌতুকমাখা দৃষ্টি আর কথার ভঙ্গিতে মনে হল টক্কা বাসের টিকিট বিক্রি করার চেয়ে, মনে হচ্ছে আমাদের জন্য ভ্যান বা গাড়ি ভাড়া করে দেবার ব্যাপারেই উৎসাহ বেশি তার! কিন্তু কারণ কি এর? যতোটা জানি বাসের টিকিট বিক্রি করলেও সে কমিশন পাবে। তার মানে কি যে ভ্যান ভাড়া করে সে ঐ বাসের টিকিট বিক্রি করার চেয়ে বেশি কমিশন পাবে, সে জন্যই কি তা নিয়ে এতো আগ্রহ তার?
একই সাথে তখন ঐক্যবদ্ধ দুই ঝাড়ি মেরে বলে উঠলো ফের, আরে দূর রাখো তো তুমি মিস ইনার কমিশনের হিসাব । ঠিক করে নাও একটা ভ্যান এক্ষুনি, যেমন ছিল বন্ড মিয়া কুনমিং এ, তেমনি এখানে একজন শার্লক হোমস মিয়া না হলেও নিদেনপক্ষে একজন ওয়াটসন মিয়াকে নিয়ে নাও ।
দুইমনের এরকম বিরল ঐক্যবদ্ধ ঝাড়ি সত্ত্বেও, হার হাইনেসের অনুমতি ছাড়া ওটা কনফার্ম করার সাহস হলো না । যদিও জানি, লাজুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ওর নিরাবেগ হাজিরজবাব হবে
“তুমি যা ভাল বোঝ, সেটা কর। আমি জানি না কি এসব।“ তারপরও এক্ষুনি তা নিশ্চিত করার সাহস হল না । কোন কারনে যদি ঠিক করা গাড়িটা খারাপ পড়ে বা ড্রাইভারটা সেই জেমস মিয়ার মতো না হয়, তবে তো তার অনিবার্য দায় যে এই বেচারা স্বামীপ্রবরের ঘাড়েই চাপবে, তা নিয়ে তো নতুন করে কোন গবেষণা করতে হবে না।
অতএব মিস ইনা কে বললাম , আসছি আমি একটু পরেই । আমার তো দল আছে একটা, দলের সাথে কথা বলেই জানাব সিদ্ধান্ত । বলেই তাকে হাত নেড়ে সাময়িক বিদায় জানিয়ে ঘুরে লবির দিকে হাঁটা দিতেই দেখি কোত্থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে দৌড়ে হাজির হয়ে গেছে দু পুত্র, হোটেল থেকে বেরুবার সেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘূর্ণায়মান বৃত্তাকার গেইটের সামনে। বুঝলাম এই লবির যেখানেই থাকুক না তারা, সতৃষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল এতক্ষণ এই মুহূর্তটির জন্যে, দ্রুত তাই পা বাড়ালাম নিজেও ওদের দিকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতাই মহাশক্তি
পরবর্তী নিবন্ধলাইলাতুল কদর হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রাত