দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ নভেম্বর, ২০২২ at ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চীনের শেনজেন শহরের অলি গলি রাজপথ ধরে ছুটছি আমরা। ‘অলি-গলি’ কথাটি কথার কথা হিসেবে বলা। কারণ এতক্ষণ ধরে শহরটিতে ঘুরলেও কোন অলি-গলিই আমাদের চোখে পড়লো না। কিংবা আমরা তেমন কোন জায়গাতে যাচ্ছিও না। বিশাল রাজপথ, কোথাও ছয় লেন, কোথাও আট লেন আবার কোথাওবা চার লেনের। রাস্তার দুই পাশের বর্ণনা আগেই দিয়েছি, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। আসলেই আর বলতেও ইচ্ছে করছে না। যেসব অপরূপা শহরের রূপের বর্ণনা করতে গেলে আমার বুকের ভিতরের চিন চিন ভাবটা বেড়ে যায়, এই শহরটিও সেরকম। এত সুন্দর, সাজানো গোছানো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন শহর দুনিয়াতে খুব বেশি আছে বলেও আমার মনে হচ্ছিল না। চমৎকার একটি আলোকোজ্জ্বল শহর। এমন সুন্দর শহর না দেখেই ফিরে যাচ্ছিলাম! আমার সহযাত্রীদের সকলেই ইতোমধ্যে দেশে ফিরে গেছে। ইউছুপ আলী ভাই না থাকলেও আমারও লায়ন ফজলে করিমের সাথে দেশে ফিরে আসার কথা ছিল। ইউছুপ আলী ভাই আমাকে জোর করে দলছুট করেছেন। নিজের বাসায় আলাদা করে রেখেছেন। আমাদের আলাদাভাবেই ঘোরারও কথা ছিল। কিন্তু তাঁর হঠাৎ জরুরী প্রয়োজনে হংকং ফিরতে হওয়ায় আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হলো। অবশ্য আজ বিদায় না নিলেও তিনিও আমাকে এই শহরটি দেখাতে আনতেন বলে মনে হয়না। আমরা গুয়াংজু বা অন্য কোথাও ঘুরে টুরে দেশে ফিরে যেতাম, শেনজেন অদেখা থেকে যেতো!

রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার সময় শেনজেনের হেথায় হোথায় প্রচুর টেলিফোনের বিলবোর্ড দেখা গেলো, দেখা গেলো এ্যাপলের লোগো সম্বলিত একাধিক অফিস কিংবা স্টোরও। এত ফোনের দোকান? কথাটি বলতে কায়সার ভাই হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বললেন, আরে আপনাকে তো বলাই হয়নি। শেনজেন কিন্তু স্মার্ট ফোনের রাজধানী। দুনিয়ায় যত স্মার্ট ফোন তৈরি হয় তার ৭০ শতাংশেরও বেশি বানানো হয় এই শেনজেনে। বিশ্বের ২৭০ কোটি মানুষ বর্তমানে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে, যার ৭০ শতাংশের হাতেই চীনে বানানো ফোন! কী বলেন!! ৭০ পারসেন্ট ফোন এখানে বানায়? অবিশ্বাস্য মনে হলেও কথাটি যে সত্য তা অল্পক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত হলাম। শেনজেনই দুনিয়াতে স্মার্ট ফোনের রাজধানী! অতএব তথ্যপ্রযুক্তিতে শেনজেনের অবস্থান ঠিক কোন জায়গায় তা জানার জন্য অন্য খুব বেশি তথ্যের দরকার আছে বলে আমার মনে হলো না।

কায়সার ভাই বললেন, এখানে বিখ্যাত একটি থিম পার্ক আছে। চলেন, সেখানে যাই। কিছু খেয়ে ঘুরে টুরে বাসায় চলে যাবো। থিম পার্ক দেখার চেয়ে কফি খাওয়ার জন্য আমার পরাণ বেশি আকুলি বিকুলি করছিল। কায়সার ভাই কিছু খাওয়ার প্রস্তাব দিতেই আমি লুফে নিলাম।

ছুটছিল আমাদের গাড়ি। ফুলে ফুলে ভরা চমৎকার একটি ছয় লেনের রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু একেবারে আচমকা আমার চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। সড়কটির পাশে প্যারিসের ল্যূভর মিউজিয়ামের সামনের সেই বিখ্যাত কাঁচের উল্টো পিরামিড! শেনজেনে প্যারিস আসলো কোত্থেকে! এই ধরনের কাঁচের উল্টো পিরামিড দুনিয়ার আর কোথাও আছে বলে তো শুনিনি। এটি এখানে কি করে! হুবহু একই জিনিস। খোলা চোখে দেখে বুঝার উপায় নেই যে, এটি শেনজেনের, প্যারিসের নয়। প্যারিসের ল্যূভর মিউজিয়াম, যেখানে মোনালিসার সেই বিখ্যাত ছবিসহ তাবত দুনিয়ার আলোচিত, আলোড়িত কিংবা প্রসিদ্ধ সব জিনিসে ভরে রাখা হয়েছে সেই ল্যূভরের সামনের কাচের পিরামিড কেন যে চীনের শেনজেনে তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কায়সার ভাই বললেন, আমরা এখানেই যাবো, এটিই সেই থিম পার্ক। এই থিমপার্কে শুধু কাচের পিরামিডই নয়, পুরো দুনিয়ার তাবত দর্শনীয় স্থাপনার হুবহু নকল তৈরি করে রাখা হয়েছে। এটির নাম ‘উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। আসলেই তো, আমার চমকের মাত্রা কেবলই বাড়ছিল। এতক্ষণ কাচের উল্টো পিরামিড দেখে আশ্চর্য হচ্ছিলাম, এবার উঁচু দেয়ালের ওপারে আস্ত আইফেল টাওয়ার দেখে আমার ভিমরি খাওয়ার উপক্রম হলো! আরে এই কি অবস্থা!! চীন কৃত্রিমভাবে চাল ও ডিম বানিয়ে বাজারে ছেড়েছে বলে শুনেছিলাম। এখনতো দেখছি ল্যূভরও বানিয়ে ফেলেছে!! শুধু কী ল্যূভর, এ তো দেখছি আইফেল টাওয়ারও বানিয়ে ছেড়েছে! যে আইফেল টাওয়ার নিয়ে প্যারিসের অহংকারের অন্ত নেই, শেনজেনে হুবহু সেই টাওয়ার!!

কায়সার ভাই এবং জোবায়ের আগেও এই থিম পার্কে বেড়িয়েছেন। এতে করে সবই তাদের দেখা এবং চেনা। কিন্তু উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা দুনিয়ার জানালাখ্যত এই থিম পার্কটি আমার কাছে প্রথম। দুনিয়াতে এমন একটি পার্ক আছে, যেখানে সারা দুনিয়ার সব গুরুত্বপূর্ণ এবং দর্শনীয় স্থাপনার নকল তৈরি করে রাখা হয়েছে তাও ছিল আমার কাছে অজানা। কায়সার ভাই বললেন, এটি না দেখে ফেরা মানেই আপনার ট্যুর ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। দুনিয়ার জানালা না দেখে ফেরত গেলে পরে আফসোস করতেন। তাই স্যারের পরামর্শে আপনাকে নিয়ে আসা।

উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডের টিকেটের দাম খুবই চড়া। প্রতিজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ২২০ আরএমবি বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় আড়াই হাজার টাকা। (বাচ্চাদের জন্য ১০০ আরএমবি।) আমি অনেক জোরাজুরি করেও টিকেটের টাকা দিতে পারলাম না। কায়সার বললেন, স্যার দিয়ে গেছেন। স্যার মানে ইউছুপ আলী ভাই। আর কতভাবে যে মানুষটি আমাকে ঋণী করে রাখতে চান কে জানে! যাক, আমরা তিনটি টিকেট নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আর ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে আমার বিস্ময় হু হু করে বাড়তে লাগলো। চোখের সামনে ডানা মেলতে শুরু করলো পৃথিবীর বিখ্যাত সব স্থাপনা। প্রায় সবগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হওয়ায় বিস্ময়ের মাত্রাটা বেড়েছে। কী করে সম্ভব!! এভাবে কী হুবহু নকল করা যায়!!! আকৃতিতে কিছুটা ছোট হলেও প্রতিটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে অবিকল। নকল করার বিষয়টি এত নান্দনিকভাবে করা হয়েছে যে, আসল নকলের পার্থক্য ধরা বেশ কঠিন! আকৃতি ছাড়া অবকাঠামোগুলোর নির্মাণশৈলিতে কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হলো না। বিশাল পার্কটিকে আটটি পৃথক অঞ্চলে ভাগ করে এশিয়া, ইউরোপ, ওশেনিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। পুরো বিশ্বের ১৩০টি ল্যান্ডমার্ক বা সিগনেচার স্থাপনার নকল রয়েছে পার্কটিতে। প্রতিটি অঞ্চলে ওই অঞ্চলের স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। যেমন এশিয়ার তাজমহল, থাই রাজার বাড়ি, চায়না গেট, কিংবা জাপান গার্ডেন কিংবা মাউন্টেন ফুজি সবই করা হয়েছে অবিকলভাবে।

আগ্রার তাজমহল ঝলমল করছিল। থাই রাজার প্রাসাদ যেনো দিচ্ছিল হাতছানি। মিশরের পিরামিড, স্ফিংস অব গিজা, রোমের টাওয়ার, কলোসিয়াম, আফ্রিকার গ্রাম!!! কী নেই সেখানে! লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ, টেমস নদীসহ পুরো এলাকাটি যেন তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান ওয়াটারসাইড ভিলেজ, মাওরি ডেভেলিংস, ভেনিস দ্য সিটি অফ ওয়াটার, পিসার হেলানো টাওয়ার, নায়াগ্রা জলপ্রপাত, আমাজন জঙ্গলসহ অগুনতি স্থাপনার প্রতিরূপ বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চীন।

থিম পার্কের ভিতরে নানাধরনের রাইড এবং গেমসও রাখা হয়েছে। ওই সব গেমস এবং রাইডের জন্য আলাদা করে টিকেট কাটতে হচ্ছে। প্রতিটি জোনে রয়েছে ফুডকোট। ওখানের রেস্তোরাগুলোতে ওই অঞ্চলের খাবার, পোশাক এবং সাজগোজ বিক্রি করা হচ্ছে। আপনি থাই পোষাক পরে থাই রাজার প্রাসাদের পাশে বসে খেতে পারবেন চা কফিসহ হালকা খাবার। আবার আফ্রিকান বসতবাড়ির পাশে বসে খেতে পারবেন আফ্রিকান খাবার। ভারতের তাজমহলের পাশে বসে ভারতীয় খাবারের সুযোগ যেমন রয়েছে তেমনি পোশাকে আশাকে ওই অঞ্চলের মানুষ হয়ে উঠার সুযোগও অবারিত।

উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডের গেট থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্লকেই দর্শনার্থীদের বিনোদনের নানা আয়োজন রাখা হয়েছে। একইসাথে দর্শনার্থীদের একটি ঘোর লাগা আবহের মাঝেও বুঝি আচ্ছন্ন করে রাখতে চান উদ্যোক্তারা। কারণ এই থিম পার্কের পরতে পরতে ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিস্ময়। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার লসএঞ্জেলসের বিখ্যাত হলিউডের আদলে এই পার্কেও তৈরি করা হয়েছে জুরাসিক পার্ক। হলিউডের মতো ব্যাপক না হলেও জুরাসিক পার্কে বেশ ভীড় দেখা গেল। কৃত্রিম বৃষ্টি এবং ভয়াল বন্যার পাশাপাশি ব্রিজ ভেঙ্গে যাওয়া, বানের পানিতে ভেসে যাওয়ার সাথে ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর পুরো এলাকাটিকে আলাদা একটি আবহ দিয়েছে। রাতে দিনে চব্বিশ ঘন্টা দেশ বিদেশের শত শত পর্যটক দুনিয়ার এই জানালায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হোটেল ওয়েস্টিন এবং হোটেল রেডিসন থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি ফাইভ স্টার হোটেলসহ অসংখ্য হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট মিলে বিশাল এক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে এলাকাটিকে ঘিরে।

আমরা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে স্থাপনাগুলো দেখলাম। বিখ্যাত স্থাপনাগুলোর প্রায় সবগুলোরই আসলটি দেখায় নকল নিয়ে আমার মাতামাতি করার কিছু ছিলনা। তবুও অনেকক্ষণ ধরে ঝিম মেরে ছিলাম। কি করে সম্ভব! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধরবিন ঘোষ : মনে পড়ে অজস্র স্মৃতি