দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩১ আগস্ট, ২০২২ at ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমাদের ধারেকাছে সবগুলো টেবিলেই চলছে ভোজনোৎসব। চমৎকার এক উৎসবমুখর পরিবেশে খাওয়া দাওয়া করছেন অসংখ্য মানুষ। নানা বয়সের নারী পুরুষ ব্যস্ত নানা ধরনের খাবার নিয়ে। কোন কোন টেবিলে শিশু কিশোরও রয়েছে। ফুডকোর্টের চারদিকে ঘিরে থাকা ছোট ছোট খাবারের শোরুম টাইপের দোকানগুলোতেও প্রচুর ভীড়। কেউ কেউ ব্যস্ত অর্ডার করতে, কেউবা ব্যস্ত খাবারের সরবরাহ নিতে। প্রতিটি দোকানের সামনেই কাস্টমার। কেউ কেউ অর্ডার করতে সঙ্গীর সাথে শলাপরামর্শ করছেন, আবার কেউবা ট্রে ভর্তি করে খাবার নিচ্ছেন। সঙ্গীকে বগলদাবা করে খাবারের ট্রে নিয়ে টেবিলের খোঁজ করছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ খাবার শেষ করে চলে যাচ্ছেন, তাদের শূন্য চেয়ারগুলোতে এসে বসছেন অন্যকেউ। খাবার শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় নিজের উচ্ছিষ্টসহ প্লেট তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে ফুডকোর্ট ত্যাগ করছেন তারা। চীনা ফুডকোর্টে ইউরোপ আমেরিকার কালচার! দারুণ ব্যাপার। ফুডকোর্টে দোকানের সংখ্যা অনেক। দোকানগুলোতে কাস্টমারও মনে হচ্ছে বেশুমার। এতে করে ফুডকোর্ট এলাকাটি মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে, কিছুটা কোলাহলও। চীনে খাবারের বাজারও বুঝি মাছ বাজারের মতো গমগম করে!!
পৃথিবীর কোন অঞ্চলে প্রচুর মানুষ, কোথাও মানুষ নেই। কোথাও রাস্তায় পা ফেলার সুযোগ থাকে না, আবার কোথাও রাস্তায় একজন মানুষও দেখা যায় না। জনবহুল দেশ চীনের গুয়াংজুতে একটি ফুডকোর্টে যত মানুষ দেখা যাচ্ছে দুনিয়ার অনেকগুলো দেশের কোন একটি শহরের আস্ত একটি পাড়ায়ও এত মানুষ থাকে না। এমন কোলাহল দুনিয়ার বহু দেশেই নেই। এমন কোলাহল বহু দেশের আরাধ্য হলেও অধরা রয়ে গেছে।
চীনের গুয়াংজুর অভিজাত শপিং মলটির ফুডকোর্টে বসে দুনিয়ার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। গল্পে গল্পে সময় পার করছিলাম সময়। আমি এবং আমার বন্ধু ইউছুপ আলী ভাই কথা না থাকলেও কথা বলি, কত কিছু নিয়ে যে আমরা গল্প করি! ফুডকোর্টে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি আমরা। শুধুমাত্র দুই কাপ কফি নিয়ে এতক্ষণ বসে থাকা বেমানান। বিশেষ করে এমন সিট ক্রাইসিসের একটি স্থানে শুধুমাত্র দুই কাপ কফি নিয়ে বসে থাকা বেমানান। তবে আমাদের কেউ কিছু বলছেন না। কেউ আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। কোন সিট কার দখলে, কে কতক্ষণ কোন সিটে বসে আছেন এসব দেখার মতো কোন লোকবল ফুডকোর্টে নেই বলেও আমার মনে হলো। অনেকক্ষণ ধরে আমরা বসে থাকলেও আমাদের দিকে কারো কোন খেয়াল আছে বলেও মনে হলো না। দুই কাপ কফি নিয়ে এতক্ষণ বসে থাকার মতো সময় চীনাদের কারো নেই, তারা ভাবতেও পারছে না যে শুধুমাত্র দুই কাপ কফি বিক্রি করে ফুডকোর্টের দুইটি চেয়ার বেদখল হয়ে রয়েছে! ইউছুপ আলী ভাই অন্য কিছু খাবো কিনা, কোন খাবারের অর্ডার দেবেন কিনা বারবার জানতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু কফি ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার হচ্ছিল না।
কফির কাপে আলতো আলতো করে চুমুক দিচ্ছিলাম আমি। রয়ে সয়ে খাওয়া বলতে যা বুঝায় ঠিক সেভাবে। কফির মগটি বিশাল। মনে হলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়। চীনের সবকিছু বড় বড়। তাই কফির কাপ বড় হওয়াও স্বাভাবিক। মগভর্তি করে কফি দেয়া হয়েছে। অসংখ্য চুমুকেও শেষ হচ্ছিল না কফি। অবশ্য দারুণ টেস্টি কফি দ্রুত ফুরিয়ে যাক তাও আমি চাচ্ছিলাম না। আহ, মন ভরিয়ে দেয়া গন্ধ। এমন স্বাদ এবং গন্ধের কফি যত দেরি করে ফুরোবে ততই ভালো। বিলাসবহুল শপিং মলের ফুডকোর্টের কফির স্বাদ সচরাচর খারাপ হয় না। তবে এটি যেন একটু বেশিই ভালো। কফি নিয়েও গল্প করছিলাম আমরা। দুনিয়ার কোন দেশে সেরা কফি খেয়েছিলেন সেই গল্পও করলেন ইউছুপ ভাই। আমি স্টারবাকসের কফি খাওয়ার গল্প জুড়ে দিলাম, জুড়ে দিলাম গ্লোরিয়া জিনস কিংবা রিও কফির গল্পও। আহা, কত বিষয় নিয়ে যে গল্প চলছিল। যে গল্পের যেন কোনো শেষ ছিল না!
আমার ফোনের দুয়ার এখন অবারিত। পুরো পৃথিবীর নানা তথ্য উপাত্ত আমার ছোট্ট ফোনটির ভিতরে। নানা সাইটে ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারছিলাম আমি। ফেসবুক হোয়াটসআপ ভাইবার সবকিছু চলছিল। আমার সফরসঙ্গীদের নিয়ে লায়ন ফজলে করিম লিটন গুয়াংজুর নানা অঞ্চলে ঘুরছেন। ফেসবুকে বিভিন্ন ছবি পোস্ট দিচ্ছেন। বন্ধুরা খুব আনন্দে আছেন। তাদের আনন্দ যেন আমাকেও ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। ইউছুপ আলী ভাই অফিসে ফোন করে চীনা মেয়েটিকে কি কি সব বলে দিলেন। তারা চীনা ভাষায় কথা বলাতে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। আমরা রয়ে সয়ে কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ফিরতে হবে।
শহরের বুক ধরে ছুটছি আমরা। দুইপাশে সুউচ্চ সব ভবন রেখে কেবলই ছুটছে আমাদের গাড়ি। নদী পার হলাম, পার হলাম বিস্তৃত খাল। কোথাও ফ্লাইওভার, কোথাও রাস্তা, কোথাওবা ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে আমরা ছুটছি গন্তব্যে। অফিসে পৌঁছার পর চীনা মেয়েটি ৩টি টিকেট এনে ইউছুপ আলী ভাইর হাতে দিলেন। চীনাভাষায় কি কি যেন বললেন। ইউছুপ আলী ভাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন তাকে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্ধ্যা ৬টার আগে পৌঁছাতে হবে। আমি কিছু না বুঝে কোথায় ৬টার আগে যাবো জানতে চাইলাম। ইউছুপ ভাই টিকেটগুলো আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, পার্ল রিভারে ক্রুজের টিকেট। আজ সন্ধ্যায়, একসাথে যাবো। জাহাজে ঘোরাঘুরি, ঘন্টা দেড়েক সময় লাগে। খাওয়া দাওয়া এবং আনন্দফুর্তি হয় আরকি! রিভার ক্রুজের অভিজ্ঞতা আছে বলে জানিয়ে টিকেট তিনটি পকেটে পুরলাম। বুঝতে পারলাম যে, আমার সাথে ইউছুপ আলী ভাই এবং শাহীন ভাবীও ক্রুজে যাবেন।
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বেলা বেশ গড়িয়ে গেল। ইতোমধ্যে শাহীন ভাবী বার দুয়েক ফোন করেছেন ইউছুপ ভাইকে। খাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথাও নাকি বলেছেন। ঘরে ফেরার পর দেখা গেল যে টেবিল ভর্তি খাবার। চীনা মহিলাকে নিয়ে শাহীন ভাবী টেবিল সাজিয়ে বসেছিলেন। ঘরোয়া আয়োজনে খাওয়া দাওয়া হলো। চীনে বসে বাঙাালি খানা! চীন সফরে আমাদের বাঙালিদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় খাওয়া-দাওয়ায়। বিশেষ করে ভাষাগত সমস্যার কারণে ঠিকঠাকভাবে অর্ডার দেয়া যায় না। আবার তাদের অনেক খাবারই মুখে নেয়া যায়না। আবার খাদ্য অখাদ্য কিংবা হারাম হালালের একটি ব্যাপার থাকায় সংকট আরো প্রকট হয়ে উঠে। অথচ আমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। কোন ধরনের চিন্তাও করতে হচ্ছে না। একইভাবে খাবার নিয়ে কোন ধরনের সংকটেও পড়তে হচ্ছে না। ইউছুপ আলী ভাইর বাসায় দারুণ আয়োজনে খাওয়া দাওয়া চলছে।
দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়ার কথা বললেন ইউছুপ আলী ভাই। বললেন, বিকেলে চা খাওয়ার পর বের হবো। এখান থেকে জেটিতে যেতে আধাঘন্টারও বেশি সময় লাগবে। বিকেলে রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক থাকে। কিছু সময় হাতে নিয়ে বেরুতে হবে। ইউছুপ ভাই নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি আমার রুমে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ঘুমাবো না। এখন ঘুমালে শরীর গোলমাল করবে। রিভার ক্রুজ এনজয় করতে পারবো না। সময় কাটানোর জন্য আমি মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি কিংবা কিছুক্ষণ চ্যাটিং করে সময় কাটাতে লাগলাম।
ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম বলতে পারি না। ইউছুপ আলী ভাইর ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। না ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে মোবাইল ঘাটাঘাটি করলেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে কে জানে! দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। চা খেতে খেতে ইউছুপ আলী বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আপনি কায়সার এবং জোবায়েদকে নিয়ে রিভার ক্রুজে চলে যান। নাহয় টিকেটগুলো নষ্ট হবে। হঠাৎ করে শরীর কেন এমন খারাপ হলো বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বললেন, ‘রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ইদানিং প্রায়শ শরীর দুর্বল লাগে, খারাপ হয়ে যায়। আগের মতো এনার্জী পাইনা।’ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করবো! অসুস্থ বন্ধুকে ঘরে রেখে রিভার ক্রুজের মতো বিনোদনে যাওয়া আমার ঠিক হবে কিনা তা ভাবছিলাম। ইউছুপ ভাই বললেন, ‘আমি রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবো। দুর্বলতা কেটে যাবে। টিকেটগুলোর অনেক দাম, নষ্ট করা ঠিক হবে না। আপনারা চলে যান। আমি কায়সারকে বলে দিয়েছি।’
কী আর করা। আমরা বেরিয়ে গেলাম। গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম জেটিতে। নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো জাহাজ। আমাদেরকে টিকেট দেখিয়ে চড়তে হবে জাহাজে। পরবর্তীতে ওই জাহাজ পার্ল রিভার জুড়ে ভাসতে থাকবে। লাইটারেজ জাহাজের মতো জাহাজগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে ক্রুজের জন্য তৈরি করা হয়। ভিতরে প্যাসেঞ্জারের বসার সিটের পাশাপাশি ডেকের উপরেও থাকে নানা সব আয়োজন। সেখানে খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে চলে নানা ধরনের অবাধ বিনোদন। চীনে প্রথম হলেও অতীতে বহুবার রিভার ক্রুজ করেছি। ফলে আগামী ঘন্টা দুয়েক কী হবে বা কী হতে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম আমি। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই শোক চিরদিনের
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ