কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

কিশোর গ্যাং এবং আমাদের দায়
১। কয়েকদিন আগে দেয়াল ঘড়ি মেরামতের জন্য যেতে হয়েছিল। মেকানিক ভদ্রলোক এক পর্যায়ে আমার পরিচয় পেয়ে খুব সকরুণ কণ্ঠে অনুযোগ করে বললেন, দাদা আপনারা সাংবাদিক অনেক কিছু নিয়ে লেখালিখি করেন। কিন্তু কিশোর অপরাধ না কী যেন বলে সেসব নিয়ে লিখেন না কেন?। চট্টগ্রাম নগরের জামাল খান, মোমিম রোড বিশেষ করে চেরাগী পাহাড়ের নাম উল্লেখ করে অভিযোগের সুরে বললেন, ওইখানে আগে লেখক, কবি, শিল্পীদের আড্ডা ছিল। এখন সেখানে কোনো ভদ্রলোক যেতে চায় না।
বললেন, একটু লিখুন দাদা। খুব কষ্ট আর অপমান থেকে বলছি, এদের পাল্লায় পড়ে আমার ছেলেটাও বরবাদ হয়ে গেল। একদম কথা শোনে না। মাঝরাতেও ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দাদা, পারলে পুলিশ দিয়ে হলেও ছেলেটাকে একটু শাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে পুলিশ পিটাক আমি কিছু বলব না।
জিজ্ঞেস করলাম ছেলে কিসে পড়ে।
বললেন, ক্লাস নাইনে।
শুনে আমি থ। ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, একজন পিতা কতটা অসহায় হলে, কতটা নিরুপায় হলে নিজের প্রায় শিশুসন্তানকে পুলিশ দিয়ে পেটাতে চান! এমন কত লক্ষ লক্ষ অসহায় পিতা-মাতা আছেন দেশে এখন?
২। বছর তিনেক আগে আমরা কজন দাঁড়িয়েছিলাম চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের দক্ষিণে ফুটপাতে। তখন রাত আটটা কি সাড়ে আটটার মতো হবে হয়তো। হঠাৎ একযোগে অনেকগুলো গাড়ির তীব্র হর্নে চমকে উঠলাম প্রায়। দেখলাম ১৫/২০ টি মোটর সাইকেল তীব্র বেগে এবং হর্ন বাজিয়ে খাস্তগীর স্কুল ক্রস করে চেরাগী পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে। প্রতিটি মোটর সাইকেলে দুজন করে যাত্রী। সবার আচরণে উদ্ধত, দুর্বিনীত ভাব। রাস্তার সন্ত্রস্ত অন্যান্য যানবাহন তাদের দ্রুত পথ করে দিচ্ছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাতে আর আতঙ্কে ভুগছি, এই বুঝি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল। দেরি নয়, কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়িগুলো আবার ফিরে আসতে দেখলাম। প্রেস ক্লাব পার হয়ে যেতে লক্ষ করলাম কারো কারো পেছনের সিটে মেয়েও আছে। একটি মেয়েকে দেখলাম, দ্রুত ও অসঙ্গতি গতির মোটর সাইকেলের পেছনে বসে তাদের এই ‘উন্মাদনার দৃশ্য’ মোবাইল ফোনে ভিডিও করছে। চারপাশের আতঙ্কিত অনেকে এদের ‘লঙ্কাকাণ্ড’ দেখে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
রাত তখন দশটার কাছাকাছি। পত্রিকা অফিস প্রেস ক্লাব ভবন থেকে পায়ে হেঁটে চেরাগী পাহাড়ের দিকে আসছি। কয়েকটি কিশোর ধর ধর চিৎকার করতে করতে প্রেস ক্লাবের দিকে যাচ্ছে। অনেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং লক্ষ করলেন তারা বন্ধুরা ‘দুষ্টুমি’ করছিল ধর, ধর বলে ‘ধাওয়া’ দিতে দিতে।
প্রায় রাতে বাসায় ফেরার পথে মোমিন রোডে একটি পানের দোকান থেকে পান কিনি। এক খিলি পান বানাতে আর কত সময়ই-বা লাগে। মিনিট পাঁচেক। এরই মধ্যে দু’চার জন আমাকে এক প্রকার ঠেলে কিংবা কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দোকানিকে বলবে, ‘সিগারেট দেন।’ যারা আমাকে ঠেলছে কিংবা আমার কাঁধের উপর হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাইছে তারা অধিকাংশই কিশোর বয়সী, যাদের বয়স আমার ছেলের চেয়েও কম। অনেক সময় এরা দোকানির সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন, একটু এদিক-ওদিক হলেই ভাঙচুর শুরু হবে দোকানের।
এই কিশোররা যখন দলবেঁধে হাঁটে, মোটর সাইকেলে বেপরোয়াভাবে যায় কিংবা গোল করে কথা বলে তখন আমার ভেতরটা শুকিয়ে যায়। আমি এই প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না। কেবলই ভাবতে থাকি আমিও কি ওই বয়সে এদের মতো ছিলাম? মনে করতে পারি না। বয়সের কারণে, তারুণ্যের উন্মাদনায় কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে কিছুটা বেপরোয়া ছিলাম হয়তো, তবে এমন ছিলাম বলে মনে হয় না। এদের কাছে একজন বয়স্ক লোকের আলাদা কোনো সম্মান নেই। এমনকি এরা নারীদেরও সম্মান করে না।
সামপ্রতিক সময়ে কিশোরবয়সীদের এমন আচরণ, তাদের অপরাধপ্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের সমাজবিজ্ঞানীরা। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাও এখন এ বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কিশোর অপরাধীদের ভয়ংকর সব তথ্য। ২০১৭ সালে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার করা গোপনীয় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী ও এর আশেপাশে কিশোর-তরুণদের ১২টি গ্রুপ মেয়েদের উত্ত্যক্ত, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা এলাকাভিত্তিক এসব গ্রুপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশেপাশের এলাকায় সক্রিয় আছে। এসব গ্রুপে অছাত্রও আছে অনেক। প্রতিবেদনে, ঢাকার ১২টিসহ সারাদেশে এমন ৩৫টি গ্রুপের কথা বলা হয়েছে। কয়েকবছর আগে ঢাকার উত্তরা ও তেজগাঁওয়ে দুই কিশোর আদনান কবির ও আল আমিন খুনের পর কিশোর অপরাধ বিষয়টি আলোচনা উঠে আসে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে শিগগিরই এই ধরনের গ্রুপের সংখ্যা বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের সংখ্যা আলাদাভাবে বলা হয়নি। তবে অতি সমপ্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ থানা এলাকায় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচশর বেশি সদস্য সক্রিয় রয়েছে। অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব কিশোরদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের সন্তানরাও রয়েছে। এমনকি বাদ যায়নি পথ শিশুরাও। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলছে তাদের অপরাধযজ্ঞ। যার পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে কথিত ‘বড় ভাই’। অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোররা রাজনৈতিক কথিত বড় ভাইয়ের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
৩। বয়ঃসন্ধিক্ষণে অনেকের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এ সময়ে সঠিক শিক্ষা না পেলে যে কারো বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া উঠতি বয়সের বা তারুণ্যের একটি উদ্দামতা থাকে। অনেক সময় অ্যাডভেঞ্চার বা হিরোইজমের বশেও অনেক কিশোর -তরুণ বিপথে পরিচালিত হয়ে থাকে।
এ সময় তারা পড়াশোনায়ও অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এই ধরনের কিশোর-তরুণরা আসে সাধারণত দু’ধরনের পরিবার থেকে। ধনী পরিবারের সন্তান এবং যে সব পরিবারে মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কম, অর্থাৎ যাদের সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের দূরত্ব আছে তেমন পরিবারের সন্তানরাই সাধারণত এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, গরিব ও শ্রমজীবী পরিবােেরর অনেক সন্তান রাগ, ক্ষোভ হতাশা থেকেও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আবার আমি এমন আদর্শ পরিবারও দেখেছি যে পরিবারের সন্তান মাদকাসক্ত হয়েছে ওপরে বর্ণিত কারণগুলো বিদ্যমান না থাকা সত্ত্বেও। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা সন্তানের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে থাকেন। সন্তানরা বাবা-মাকে উৎপীড়ন করে। কারণ তারা জানে, এ ক্ষেত্রে বাবা-মা অসহায়। এমন পরিবারের বাবা-মায়েরা সন্তানের কথা ভেবে, পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে সন্তানের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার কথা কারো নিকট প্রকাশও করতে পারেন না।
জীবন সম্পর্কে এদের যথেষ্ট জানাশোনা না থাকায় এরা চটজলদি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এবং তা খুনোখুনির মতো নির্মম ঘটনার বেলায়ও। এরা অপরিণামদর্শী, অদূরদর্শী। এটি আমাদের নগরায়ণের কুফল বলে বলা হলেও এমন দৃশ্য গ্রামে-গঞ্জেও কম নয়। সমস্যা হচ্ছে এদের হাত থেকে এদের মায়ের বয়েসি নারীও রক্ষা পায় না। এরা ক্রমে ক্রমে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার পর নেশার খরচ যোগাতে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সচ্ছল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান ছাড়াও পথশিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা ভীষণ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দ্রুত বের করতে না পারলে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে এবং তাতে সমাজ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। কাজেই প্রশাসন ও এদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। আগে আমাদের পাড়া-মহল্লায় সর্দারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ছিল। পাড়ায়-পাড়ায় এ ধরনের কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। পাড়ার মধ্যেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা ছিল। পাড়ার কোনো ছেলে এ ধরনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়লে তার জন্য সালিশ-বিচার হতো, দোষী তরুণের পরিবারকে তার দায় নিতে হতো। এখন পাড়ায় পাড়ায় সেই সমাজবদ্ধতা নেই। কেউ কারো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। আর নতুনভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকায় কে কোথা থেকে এসেছে তার খবর কেউ রাখে না। ফ্লাটের মধ্যে সীমিত সবার জীবন।
বিষয়টিকে শুধু ভাবনার এবং সমস্যার মধ্যে রেখে দিলে চলবে না। এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কাজেই এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং ও কাউন্সিলিং করতে হবে। সমাজের আলোকিত, আলোচিত ভালো মানুষদের যুক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যে কোনো অপরাধী অপরাধ করার আগে একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে এই কিশোর-তরুণদের ব্যবহার না করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণের কথা ভাবতে হবে। অন্যের সন্তানকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে নিজের সন্তানকে নিরাপদ রাখার ভাবনা অত্যন্ত গর্হিত ও অমানবিক। তাতে শেষ পর্যন্ত নিজেকেই বিপদে ঠেলে দেওয়া হবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘দুজনে মিলেই আমরা একটা দল হয়ে উঠতাম’
পরবর্তী নিবন্ধঅভিবাসী কোভিড যোদ্ধাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে ফ্রান্স