আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আলিফা মুবাশশিরা | রবিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

বিজয়ের মাস : গর্বের মাস, অহংকারের মাস

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। গর্বের মাস, অহংকারের মাস। বিজয়ের মাস উপলক্ষে অনেক কবিতা গান, সাহিত্যের আলোচনা, আবৃত্তির অনুষ্ঠান এবং নানা ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়। স্টেডিয়ামের বাইরের প্রাঙ্গণে সুন্দর পরিবেশে ষোল ডিসেম্বরে বিজয় মেলার আয়োজন খুব জমজমাট ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। তারুণ্যের পরশে যখন প্রাণবন্ত ছিলাম তখন ষোল ডিসেম্বর আমার ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করতো না। আত্নীয়স্বজনের গৃহ বা রেস্তোঁরাতে যেতে মন চাইতো না। পিচ ঢালা সড়কে হাঁটতে ও বিজয় মেলাতে মানুষের আনন্দের উদ্দীপনায় ভরপুর গান ও কবিতা উপভোগ করতে ভালো লাগতো। কলেজের সহকর্মীরা অনেকে মিলে আমরা নববর্ষে ডিসি পার্কে বা স্টেডিয়ামের বাইরের বিজয় মেলায় যেতাম। তখন জনতা উচ্ছৃঙ্খল ছিল না। সংখ্যায়ও বিপুল ছিল না। আমরা সহকর্মীরা একসাথে বিজয় মেলায় কিছু কেনার ছলে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতাম। ছোট ছেলে আবীর প্রায় সময় আমার সাথে বিজয় মেলায় যেতো। ছোটদের জন্য বিভিন্ন ধরনের দেশীয় খেলনা তার প্রিয় ছিল। তখন নানা রকম কারুকাজ করা মাটির টব ফুল গাছের জন্য পাওয়া যেতো। আমি সেগুলো থেকে স্বদৃশ্য টব ক্রয় করতাম। অর্থাৎ সামান্য উপলক্ষ করে বিজয়ের আনন্দ সহকর্মী ও সন্তানদের নিয়ে হৈ চৈ কলরব করে দিনটি উদযাপন করার জন্য আগ্রহ হতো। সন্তানদের অন্তরেও বিজয় ও স্বাধীনতার আনন্দ শৈশব থেকে অনুভব করার বীজ বপন করে দিতাম যেন দেশ ও ভাষাকে ভালবাসে। ষোল ডিসেম্বরে আনন্দের তৃপ্তি ঘটে না। ভোরে সোনালি রোদ উজ্জ্বল আলো ছড়ায়। বাতাসে মৃদু শীতের পরশ। মনে হয় প্রকৃতি যেন আহবান করছে। আয় ! আয় ! এমন আনন্দের দিনে গৃহের চার দেয়ালে বন্দী থেকে কি লাভ !

এ বছর শৈলী প্রকাশন বিজয় দিবস উপলক্ষে একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতির গ্রন্থ নিয়ে বইমেলার আয়োজন করেছে। শৈলীর কর্ণধার বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অজস্র পুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় লেখক রাশেদ রউফ বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করে ছোট ছোট শিশু, কিশোর ও তরুণদের বইমুখী করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকায় একুশের বইমেলা খুব জনপ্রিয়। দীর্ঘ লাইনে অনেকটা সময় দাঁিড়য়ে থাকতে হয় প্রবেশের জন্য। রাশেদ রউফ চট্টগ্রাম একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একাডেমির সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সহযোগিতার তিনি স্বাধীনতার উৎসব ও বইমেলার আয়োজন করে মার্চ মাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী বইমেলার দৃষ্টান্ত সমগ্র বাংলাদেশে তুলে ধরেছেন।

বীর চট্টলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বইমেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। চট্টগ্রামে কালধারা প্রকাশনার কর্ণধার শাহ আলম নিপু বর্ষা বা শরৎ ঋতু উপলক্ষে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কবিদের সমাবেশে স্বরচিত কবিতার আসরের আয়োজন করতেন। এনায়েত বাজারস্থ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ (প্রয়াত) নীলুফার খানম, অধ্যাপক তহুরীন সবুর (বর্তমানে কলেজের অধ্যক্ষ), অধ্যাপক বদরুন্নেসা সাজু এবং আমি সম্মিলিতভাবে ওই কবিতার আসরে স্বরচিত কবিতার পাঠের জন্য উপস্থিত হতাম। চট্টগ্রামের প্রায় সব স্বনামধন্য কবিবৃন্দ সেখানে স্বরচিত কবিতা পাঠ বা আবৃত্তি করতেন। দারুণ উত্তেজনায় ভরপুর ছিলাম। পরদিন চট্টগ্রামের দৈনিক ‘আজাদী পত্রিকায়’ আসরের খবর কবিতা আবৃত্তিরত আমার ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছিল দেখে আমি আনন্দে উল্লসিত হয়েছিলাম।

বাগানের ফুল যেমন মনে গভীর আনন্দ সৃষ্টি করে তেমনি সাহিত্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিগণ বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্বয়ং পাঠক এবং দর্শকদের অপরিসীম আনন্দ দান করেন। ২০০১ সাল থেকে রাশেদ রউফ চট্টগ্রাম একাডেমির উৎসাহী শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে পাঁচ দিন ব্যাপী স্বাধীনতার উৎসব ও বইমেলা বর্ণাঢ্য এবং মনোহরভাবে উপস্থাপিত করতেন। বিখ্যাত কবি, লেখক, শিল্পী, বাচিক শিল্পীকে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করার জন্য চট্টগ্রাম, ঢাকা বা ভারত থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হতো। সে সাথে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং খ্যাতনামা নৃত্য ও আবৃত্তি সংগঠনদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। আমি যে বার ডিসি পার্কে আয়োজিত স্বাধীনতার উৎসব ও বইমেলায় প্রথম গিয়েছিলাম, সে বার গভীর আনন্দে অভিভূত হয়েছিলাম। ডিসি পার্কের শ্যামল গাছপালার অপূর্ব পরিবেশ, সন্ধ্যার পর আকাশের নীল ওড়নায় গ্রহনক্ষত্রের ঝিকিমিকি,

কখনো বা চাঁদের উঁকিঝুঁকি, বিশাল মঞ্চ, সোপানের গ্যালারিতে অজস্র দর্শক। এক অপরূপ দৃশ্য। আমার তখন একটি মাত্র কবিতার বই ‘নক্ষত্রহীন রাতে’ প্রকাশিত হয়েছে। নিজেকে কবি ভাবতে ভালো লাগতো। তাই স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির জন্য গভীর আগ্রহ অনুভব করেছিলাম। মনে আছে আমি সেইদিন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। দেশপ্রেমের আবেগ, স্বাধীনতার প্রতি অসীম ভালবাসার জোয়ার আমার হৃদয়কে সিক্ত করে দিয়েছিল। দৈনিক চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক অমিত বড়ুয়া কবিতা পাঠের আসবের মাধ্যমে অনেক সৃজনশীল কবি ও লেখকদের উৎসাহিত করছেন। বর্তমানে কিশোরদের জন্য মাসিক ‘কিশোরবেলা’ প্রকাশ করে প্রশংসিত হয়েছেন। নারী প্রকাশকরাও পিছিয়ে নেই। ‘বলাকা’ প্রকাশন থেকে কবি শরীফা বুলবুল এখনোা গ্রন্থ প্রকাশনা চালিয়ে যাচ্ছেন। শাহরিয়ার ফারজানা ‘নারীকণ্ঠ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লেখা প্রকাশ করে সুনাম অর্জন করছেন। ফারজানা এ বছর ‘অনন্যা’ পুরস্কার পেয়েছেন এবং আলোকচিত্রী হিসেবে দেশবিদেশের পুরস্কার অনেকবার লাভ করেছেন।

রুনা তাসমিনা ইতোমধ্যে লেখালেখিতে পাঠকের প্রশংসা লাভ করেছেন ও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত ‘অনন্য ধারা’ পত্রিকাটি একটি অনবদ্য পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। চট্টগ্রামের ‘রাদিয়া’ ‘অক্ষরবৃত্ত’ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকাশনা চট্টগ্রামের লেখালেখির জগতকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।

স্বাধীনতা, বিজয় দিবস ও একুশকে অবলম্বন করে প্রকাশক ও কবি লেখকদের সম্মিলিত উৎসাহ ও উদ্দীপনা পাঠকদের বইমুখী করে তোলার সাথে সাথে কম্পিউটার ও মোবাইলের আকর্ষণ থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও অবকাশের আনন্দ কিশোর ও তরুণদের অনুভব করতে সহায়তা করছে। একজন মানুষের প্রকৃত সঙ্গী হলো বই। বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ পাঠ করে পাঠকের মন উদার হয়। মানুষ ও প্রকৃতির সাথে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয়। পাঠক ভালমন্দ বুঝতে পারে, সৎ চরিত্র গঠন করতে পারে। তাই গ্রন্থ পাঠের তুলনা নেই।

চট্টগ্রামে গত ২৬ ও ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ মৈত্রীর উদ্যোগে আগরতলার সুলেখক ড. দেবব্রত দেবরায় সম্পাদিত বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর শত জন্মবার্ষিকী এ দু’টি গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব। সংস্কৃতিমনা কবি শাওন পান্থ সস্ত্রীক তার প্রতিষ্ঠিত ও ‘ত্রিতরঙ্গ’ একাডেমির সদস্যদের উদ্যোগে ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রকাশনা উৎসব অত্যন্ত চমৎকার ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়।

ভারত থেকে শ্রদ্ধেয় ড. দেবব্রত দেবরায়ের সাথে আগরতলা, ত্রিপুরা ও কলকাতা থেকে প্রায় ২৭/২৮ জন কবি, নৃত্যশিল্পী, গায়ক এবং বাচিক শিল্পী এসেছিলেন। তাঁরা এবং ত্রিতরঙ্গের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দু’দেশের জাতীয় সংগীত, নৃত্য, গান ও আবৃত্তি এবং খাগড়াছড়ির অসাধারণ নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশনা উৎসব বর্ণিল, মাধুর্যময় ও আকর্ষনীয় করে তুলেছিলেন।

শ্রদ্বেয় ড. দেবব্রত দেবরায় আগরতলার বাসিন্দা। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসা। তিনি ভারতের অনেক লেখকশিল্পীসহ গ্রন্থ প্রকাশনা উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অবিস্মরনীয় অবদান এবং ত্রিশ লাখ শহীদের আত্ন বলিদানের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা আমরা তাঁদের সাথে গভীর শ্রদ্ধাসহ স্মরণ করেছি। বাংলা ভাষা পৃথিবীর সমগ্র বাঙালির একান্ত আপন ভাষা ও বাংলাদেশ সব বাঙালির অনাদিকালের আশাআকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন পূরণের দেশ। বিজয় দিবস তাই বাংলাদেশ, ভারত ও পৃথিবীর সব বাঙালির প্রিয় দিবস। আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ তা যেন এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করে। তাহলেই বিজয় দিবস সার্থক ও সফল হবে।

লেখক : সাহিত্যিক। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজচট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধকৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হোক