আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতা এবং প্রেমচেতনা

সৌভিক চৌধুরী | শুক্রবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

কবিরা প্রেমের জগতকে নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু বলে মনে করেন না। এটি হতে পারে প্রকৃতিপ্রেম, দেশপ্রেম কিংবা মানবপ্রেম, তেমনি রয়েছে নারীপ্রেমের দর্শনকে হৃদয়ঙ্গম করার অনন্য অনুভূতি। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল পঞ্চাশের দশকের কবি এবং এই দশকে ভাষা আন্দোলন, দেশভাগ এবং স্বাধিকার চেতনার মতো বিষয়গুলো কবিদের নাড়া দিয়েছিলো, জাগিয়ে তুলেছিলো স্বদেশ প্রেমের চেতনা। এসব বিষয় এই কবিকেও ভাবিয়েছিলো। বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দের মতে, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল তখনকার দিনে দেশপ্রেমের কবিতাও লিখেছিলেন, কিন্তু রাহু তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি, বাংলা কবিতায় ভাষার যে ধারাবাহিকতা তা থেকে তিনি তিলমাত্র বিচ্যুত হন নি।’ তাঁর স্বদেশ চেতনার একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আমার সত্তা।’

যেমন নদীকে তার স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না

পাখিকে তার গান থেকে

এবং ফুলকে তার সৌরভ থেকে

তেমনি আমার সত্তা থেকে এই দেশকে ।

……………………………

এদেশে আমার জন্ম, এদেশ

তোমার এবং আমার

প্রতি শস্যের কণিকা অথবা

সব শস্যের খামার

এদেশ তোমার আমার।

স্বদেশপ্রেমের অনন্য চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে কবির হৃদয়ে আর কবিতায়, এ দেশের প্রতিটি প্রান্তর, প্রকৃতির সৌন্দর্য কবির অন্তরকে যেভাবে দোলায়িত করেছে, কবিতার প্রতিটি ছত্রে তা অনুরণিত হয়েছে। আবার যদি ‘ছবি’ কবিতাটি আমরা পাঠ করি, তবে দেখবো দেশপ্রেমের আবরণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে রচিত অনবদ্য একটি কবিতা:

আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ

ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান ।

খাঁটি আর্যবংশ সম্ভুত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর

দীর্ঘ ন’টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি ।

(ছবি, আপন যৌবন বৈরি )

এই কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা হিসেবে নয়, আবু হেনা মোস্তফা কামালের সব কবিতার মধ্যেই অন্যতম দেশপ্রেমের একটি কবিতা । বিষয়, বোধ, এবং প্রকরণে উৎকর্ষতা পেয়েছে এই কবিতা । আবু হেনা মোস্তফা কামাল জীবনের কবি, প্রেমের কবি। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা মূলত প্রেমেরই কবিতা । নিম্নোক্ত কবিতাটি প্রেম, যুদ্ধ, আশাবাদিতায় পূর্ণ অনন্য কবিতা ।

এতো রক্তপাত হলো বাংলাদেশে , এতো মাংস মিশলো মাটিতে

এতো ঘর উঠে গেলো ভয়াল আগুনে

তোমাকে কি দিতে পারি বলো কি তোমাকে দিতে পারি আমি

আমি ছাদে উঠলেই গাছের আড়ালে ডোবে চাঁদ

বুক থেকে দিতে পারি, সখি, গুটিকয় বিষাক্ত বুলেট

হাতে নিয়ে দেখবে তুমি তারা সব দীর্ণ প্রেমে টকটকে লাল হয়ে আছে

(নিরন্ত বিরোধ, অগ্রন্থিত কবিতা)

আবু হেনা মোস্তফা কামাল রোমান্টিকতাকে ধারণ করে আপাদমস্তক একজন প্রেমের কবি হয়ে উঠেছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছিলেন :

এই ইভার চোখে (সুন্দরী যুবতী ইভা) দুটি নীল আকাশ নেমেছে

এই চেনা গলি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না, যাবেনা

সীমিত উঠোনে ঘাসে রোজ ভোরে এই কারুকাজ

এঁকেছেন সুন্দর বিধাতা (প্রেমিক বিধাতা) আর রাতে

নিঃসঙ্গ জলের শব্দে কলতলা যখন মুখর

তখন ভেবেছে ইভা, সমুদ্রের স্বর

আরো কই সুন্দর ?

(ইভার সুন্দর, যেহেতু জন্মান্ধ)

আবু হেনা মোস্তফা কামালের এই কবিতায় প্রেমচেতনা ধরা দিয়েছে একরৈখিক অনুভূতি হয়ে। একজন কবি তাঁর কবিতায় প্রেমকে বুনন করেন সহজাত সংবেদনশীল অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে । আবু হেনা মূলত নিখাঁদ রোমান্টিক কবি। উপরস্থ কবিতা প্রসঙ্গে বলা যায়, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সুন্দরী ইভাকে, সে যেমন ছিলো আত্মলীন, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সে কোথাও যাবে না, তেমনি আবু হেনা মোস্তফা কামালও আত্মমগ্ন একজন কবি, যিনি তাঁর মনোজাত প্রিয়াকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না, তাঁর সেই চিরন্তন প্রিয়ার জন্য মধ্য সমুদ্রেও ডুব দিতে পারেন বিবেচনা ছাড়াই।

প্রেম’ শব্দটি যেহেতু বহুমাত্রিক, আদি এবং অকৃত্রিম, সেহেতু আবু হেনা মোস্তফা কামাল একে পরিশীলিত আচরণে কবিতায় নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন মাত্রায় । কখনো লৌকিক, কখনো দেহজ, কখনো প্লেটোনিক আদর্শে কিংবা ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির আবরণে। তিনি বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখেছেন বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো টুকরো কাগজে, শিরোনামহীন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি প্যাডে অসম্পূর্ণ নামহীন প্রেমের কবিতা:

কতোটুকু ঝুঁকি নিতে পারি, জানতে চাওনি তুমি নারী

আমিও বলিনি,

চন্দনগাছের গায়ে কোনো নামফলক নেই

তবু তার হৃদয় থেকে সুবাস ওঠে নিঃশব্দে নীরবে ।

ভালোবাসার জন্য কবি ঝুঁকি নিতে পারেন, নিয়েছেনও, কিন্তু প্রিয়তমা উপেক্ষা করেছে একে। কবিতো অকৃত্রিম ভালোবাসার ধারক, তাইতো ভালোবাসা প্রকাশ করেন নীরবে। তবুও তাঁর সবুজ ভালোবাসা ব্যবচ্ছেদ হয় নির্দয় কুঠারে। এর চেয়ে মর্মন্তুদ আর কিইবা হতে পারে ।আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রেমের কবিতায় চিরন্তন কিছু অনুভূতি জেগে থাকে আবশ্যিকতায়, যা তাঁকে দিয়েছে কবি খ্যাতি। তাঁর দুটি কবিতা উল্লেখ করতে পারি:

তোমাকে দেখলেই তবু বন্দরে জ্যোৎস্নার মতো জেগে উঠি;

অসম্ভব অরণ্যের সীমা বিদেশি বৃক্ষের ঘ্রাণ কাছে পাই

(প্রতিজ্ঞা, যেহেতু জন্মান্ধ)

ভালোবাসা তুমি অতর্কিতে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছো

নিরাপদ বন্দর থেকে মধ্যসমুদ্রে যেন এক জলদস্যু

(ভালোবাসা অতর্কিতে, যেহেতু জন্মান্ধ)

প্রিয়তমাকে দেখার অনুভবে জ্যোৎস্না প্লাবিত হয়ে যায় কবির হৃদয়, ভালোবাসা অতর্কিতে তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় জলদস্যুর মতো, ইপ্সিতার জন্যে কবি মাঝসাগরে ডুবে যেতে পারেন, তলিয়ে যেতে পারেন পাতালে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার উপস্থাপনা সরল, প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ততা আছে।

কবি রফিক আজাদের ‘প্রতীক্ষা’ কবিতাটি আমরা পড়েছি, কিন্তু আবু হেনা মোস্তফা কামাল চিরকাল প্রতীক্ষায় থাকার মতো সহিষ্ণু কবি নন। তাই তাঁর কাব্যে প্রতীক্ষার মতো আবেগময়তা অনুপস্থিত।

মনে পড়ে এই পাশে কাউকে তুমি কথা দিয়েছিলে

চোখের ভাষায় কবে, বলেছিলে তৃষ্ণাই জীবন ।

অমরতা কোনোদিন কাঙ্ক্ষিত ছিল না তবু তুমি

কি করে ভাবলে আমি চিরকাল বয়ে যাবো পিপাসার পণ?

(পিপাসার পণ, আক্রান্ত গজল)

আবু হেনা মোস্তফা কামাল রোমান্টিক কবি। প্রায় চার দশক ধরে কবিতা লিখেছেন তিনি, ফলে তাঁর কবিতা স্বাভাবিকভাবেই অপরিবর্তিত থাকেনি। পরিবর্তিত হয়েছে বিভিন্ন ব্যাঞ্জনায়, ভাবে এবং অনুষঙ্গে। তিনি কাব্য রচনা শুরুই করেছিলেন রোমান্টিক কবিতা দিয়ে, এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারাই বজায় রেখেছিলেন। দীর্ঘদিনের আত্মমুখিতা পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খানিকটা বিষয়মূখ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি, জীবনের শেষ কয়েক বছরে নারী ও কবিতার বাইরে মৃত্যুচেতনা যুক্ত হয়েছিল তাঁর কবিতায় । জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘আপন যৌবন বৈরি, ‘যেহেতু জন্মান্ধ’ এবং ‘আক্রান্ত গজল’ প্রকাশিত হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তাঁর কবিতা রচনার সূচনাকাল ১৯৫২ সালে এবং এভাবেই তাঁর কাব্যযাত্রার সূচনা। আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাদের আধুনিক কবিদের একজন। তাঁর কবিতায় নিসর্গ আছে , স্বদেশ বন্দনা আছে, প্রেম আছে, আছে আবেগ, উচ্ছ্বাস, বিশুদ্ধ অনুভূতি। তাঁর কবিতার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ শরীরী সংরাগ। এইসব কারণে তাঁর কবিতা পুনঃপঠনযোগ্য। ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর ৩৪ তম প্রয়াণবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনোয়ার হোসেন মিছিলের পুরোভাগে জ্বলন্ত মশালের মুখ
পরবর্তী নিবন্ধসরকারিভাবে কমল হজের কোটা